বাংলাদেশে পোড়া রোগীদের চিকিত্সার একমাত্র জায়গা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট৷ শুধু রাজধানী নয়, দেশের আর কোথাও পোড়া রোগীদের চিকিত্সার বিশেষায়িত কোন হাসপাতাল বা ইউনিট নেই৷
বিজ্ঞাপন
দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে৷ রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রতিদিনই কোন না কোন যানবাহনে আগুন দেয়া হচ্ছে৷ অগ্নিদগ্ধ হচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷ কিন্তু এই পোড়া রোগীদের চিকিত্সা দিতে গিয়ে চরম হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষায়িত এই ইউনিটটি৷ সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিরোধী দলের ডাকা অবরোধের মধ্যে রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা৷ এতে ১৯ জন দগ্ধ হন৷ এর মধ্যে মারা গেছেন দুই জন৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শঙ্কর পাল জানন, বার্ন ইউনিটে বর্তমানে রোগীর ধারণ ক্ষমতা ১৫০ জনের মতো৷ কিন্তু শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে ভর্তি ছিল ৩৫৫ জন৷ বিছানা ছাড়াও ফ্লোরে বা বারান্দায় রোগীদের চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘পোড়া রোগীদের অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের কোন সুযোগ নেই৷ কারণ বাংলাদেশের অন্য কোথাও পোড়া রোগীদের চিকিত্সার বিশেষায়িত কোন হাসপাতাল নেই৷ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও এই চিকিত্সার কোন ব্যবস্থা নেই৷ তাই যত কষ্টই হোক রোগীদের ফেরত দেয়া হয় না৷ তাদের হাসপাতালে রেখেই চিকিত্সা করতে হচ্ছে৷''
ডা. পার্থ শঙ্কর পাল বলেন, ‘‘রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পোড়া রোগীর সংখ্যা এখন অনেক বেড়ে গেছে৷ আগে যেখানে বর্হিবিভাগসহ বিভিন্নভাবে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১১০ জন রোগীকে চিকিত্সা দেয়া হতো, এখন সেখানে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা দেড়শ' পার হয়ে যাচ্ছে৷''
রাজনৈতিক সহিংসতায় আসা রোগী আর সাধারণ দুর্ঘটনায় আসা রোগীদের ভাগ করে একটা হিসাব কিছুদিন থেকে বার্ন ইউনিট কর্তৃপক্ষ রাখতে শুরু করেছে৷ গত এক মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার ১০৭ জন রোগীকে চিকিত্সা দিয়েছে ঢাকা মেডিকেলের এই ইউনিট৷ এর মধ্যে এখনো ২৯ জন ভর্তি আছেন৷ যাদের ৯ জনের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন৷ হাসপাতালে ভর্তি থাকা অন্য রোগীদের সবাই সাধারণ দুর্ঘটনার শিকার৷ তবে চিকিত্সা না নিয়ে কাউকে ফেরত যেতে হয় না৷
নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করা ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, খুবই ছোট পরিসরে এই ইউনিটটি কাজ শুরু করেছিল৷ কিন্তু পোড়া রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় এর শয্যা একশ' থেকে বাড়িয়ে ১৫০ করা হয়েছে৷ এখন আরো বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি৷
ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ওষুধপত্রে কোন সংকট নেই বলে দাবি করেন তিনি৷ শিক্ষানবিশ চিকিত্সকসহ বর্তমানে ৬২ জন চিকিত্সক এখানে দায়িত্ব পালন করেন৷ ঢাকা মেডিকেলের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বার্ন ইউনিট খোলার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এটা এখন সময়ের দাবি৷ সবাই মিলে কিছু কিছু রোগীর চিকিত্সা দিলে কোন রোগীকেই আর বিনা চিকিত্সায় মারা যেতে হবে না৷''
উল্লেখ্য, গত ২৬ অক্টোবর থেকে শনিবার পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার ৮ জন বার্ন ইউনিটে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেছেন৷ এখন যে ২৯ জন ভর্তি আছেন তার মধ্যে একটি ঘটনারই ১৬ জন৷ এর মধ্যে পাঁচ জনের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন ডা. পার্থ শঙ্কর পাল৷