প্যারিসে যাওয়ার, প্যারিস ঘুরে দেখার স্বপ্ন তো দেখে সারা পৃথিবীর লোক৷ কিন্তু প্যারিসে ট্যাক্সি চালানো? বিরাট শহর, লক্ষ লক্ষ মানুষ, পর্যটক; ভালো লোক, মন্দ লোক; ট্যাক্সি কিন্তু চলে দিনে-রাতে৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে পড়ে প্যারিস৷ ট্যাক্সি থেকেও এই শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো উপভোগ করা যায়৷ কিন্তু ২২ লাখ মানুষের মহানগরীতে গাড়ি চালাতে গেলে, শক্ত স্নায়ুর প্রয়োজন৷ নাদিয়া আলিলি গত ন'বছর ধরে ফ্রান্সের রাজধানীতে ট্যাক্সি চালাচ্ছেন৷ তিনি বলেন:
‘‘প্রচুর ধৈর্য থাকা দরকার, নয়ত বেশিদিন এ কাজ করা যায় না৷ এখানে বড় বেশি চাপ, বড় বেশি স্ট্রেস, বড় বেশি ট্র্যাফিক৷ সেই সঙ্গে আবার যাত্রীরা রয়েছেন, যাঁরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গন্তব্যে পৌঁছাতে চান৷''
শুধু ওয়েটিং চার্জই নয়
সতেরো হাজার তিনশো'র বেশি ট্যাক্সি প্রতিদিন দু'লাখের বেশি ট্রিপ দেয়, যাত্রীদের প্যারিসের কোণায়-কোণায় পৌঁছে দিতে৷ ভাড়া: ১০ কিলোমিটার যেতে ১৩ ইউরো, গড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই৷ তবে প্যারিসে সেই সঙ্গে যোগ হয় ওয়েটিং চার্জ, কেননা সর্বত্র যানজট: কাজেই অধিকাংশ যাত্রীর কাছে মিটারে যে ভাড়া ওঠে, তা বেশি বলেই মনে হয়৷ তাছাড়া প্যারিসের ট্যাক্সিচালকদের ভাবসাব খুব একটা অমায়িক নয়৷ এক মার্কিন টুরিস্ট বললেন:
‘‘অ্যামেরিকায় যেরকম, এখানকার ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ততটা ফ্রেন্ডলি নয়৷ আমাদের সাথে কথা বলেনি, শুধু নিজের মনে কথা বলেছে৷ আজকের ট্যাক্সি ড্রাইভারটাও সেই রকম৷ আমরা মোবাইল ফোনে ঠিকানা দেখাতে, একটি কথা না বলে সেখানে পৌঁছে দিল৷ আমরাও নেমে গেলাম৷ ব্যাস, ঐ পর্যন্ত৷''
নাদিয়া আলিলি প্যরিসের ট্যাক্সিচালকদের বদনামের কথা জানেন৷ তাঁর বক্তব্য হলো:
‘‘আমার মনে হয়, ট্যাক্সিচালকরা আগে বিশেষ কেয়ার করতেন না – গ্রাহকরা কী ভাবছে না ভাবছে, গাড়ি পরিষ্কার না ময়লা, নিজের জামাকাপড় পরিষ্কার না ময়লা, এ সব ব্যাপারে৷ কিন্তু প্রতিযোগিতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়েছে৷''
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ট্যাক্সি
সারা বিশ্বেই ‘ট্যাক্সি’ আজ শুধু যানবাহন নয়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের একটা জায়গা হয়ে উঠেছে৷ ট্যাক্সিটি নতুন, পুরনো, ভাঙা বা বিলাসবহুল – যাই হোক না কেন, সেটায় বসেই যাত্রী সে দেশটিকে, দেশের মানুষকে দেখতে, ও জানতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উজ্জ্বল হলুদ রঙের ট্যাক্সি
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের হলুদ রঙের এই ট্যাক্সিগুলো পরিচিত ‘ইয়েলো ক্যাব’ নামে৷ বিশ্বখ্যাত এই ট্যাক্সিগুলো মজবুত এবং আয়তনে বেশ বড় হলেও, ১৯৮০ সালের পর থেকে আর তৈরি হয়নি৷ তাছাড়া পুরনো এই ট্যাক্সিগুলো চালাতে বেশি পেট্রোল লাগলেও, আজও নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মাঝে মাঝেই এগুলি চোখে পড়ে৷ শোনা যায়, ১৯৯৯ সালে এই হলুদ ক্যাবের দাম নিলামে ১৩৪,৫০০ অ্যামেরিকান ডলার পর্যন্ত উঠেছিল৷
ছবি: imago/Manfred Segerer
মেয়েদের জন্য গোলাপি রঙের ট্যাক্সি
মেক্সিকোয় বড় শহরগুলোর রাস্তা তেমন নিরাপদ নয়৷ তাই মেক্সিকো-সিটি এবং পুয়েব্লার পৌরসভা সেখানে ‘পিংক ক্যাব’ ট্যাক্সি চালু করেছে৷ উজ্জ্বল গোলাপি রঙের এই ট্যাক্সির চালকরা যেমন মেয়ে, তেমনি যাত্রীও শুধুই মেয়ে এবং শিশুরা৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে, নারীচালিত এই ট্যাক্সিতে জিপিএস, ইমারজেন্সি বোতাম এবং কসমেটিক্স বক্স – এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সবসময় থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অতীতে ফিরে যাওয়া
কিউবার রাস্তায় এখনো পুরনো গাড়ি, মানে ‘ওল্ডটাইমার’ চলতে দেখা যায়৷ এদের মধ্যে অধিকাংশই মার্কিনি৷ ১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকের এমন অনেক গাড়ি ইতিমধ্যেই ১০০,০০০ কিলোমিটারের ঘর পার করেছে৷ তাই আজকের এ যুগে ঐ গাড়িগুলোয় চড়া পর্যটকদের জন্য এক অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা৷ তার ওপর এগুলো ‘শেয়ার ট্যাক্সির’ মতো কাজ করায়, পথে যাত্রী ওঠা-নামা করে৷ ফলে স্থানীয়দের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় সহজেই৷
ছবি: picture-alliance/Horst Galuschka
ইচ্ছে মতো যাত্রী তোলা
গণ প্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসার ট্যাক্সিগুলিতে কতজন যাত্রী তোলা হবে – তার কোনো নিয়ম-কানুন নেই৷ ফলে ট্যাক্সিতে চালকের ইচ্ছেমতো যাত্রী তোলা হয়৷ তবে এ ছবি শুধু আফ্রিকায় নয়, বাংলাদেশের রাস্তাতেও নিত্যদিনের দৃশ্য৷ আসলে বেশিরভাগ সময় যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য আর কোনো বিকল্প উপায় থাকে না বলেই শেষ পর্যন্ত এরকম ভর্তি ট্যাক্সিতে ওঠেন তাঁরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুবাইয়ের ‘লাইফলাইন’ জলট্যাক্সি
এখানে যতগুলো সেতু আছে, তারচেয়েও বেশি আছে জলট্যাক্সি৷ খাঁড়িগুলিতে অবশ্য শুধুমাত্র কাঠের তৈরি জাহাজগুলোরই চলাচলের অনুমোদন আছে৷ তবে ‘আব্রাস’ নামের ছোট্ট এই নৌকাটিও অন্ততপক্ষে ২০ জন মানুষকে তুলতে পারে৷ আর এই জলট্যাক্সিতে শ্রমিক, ম্যানেজার, পর্যটক – যেই উঠুন না কেন, সবার জন্যই ভাড়া মাত্র ২০ সেন্ট৷ সম্ভবত বিশ্বের আর অন্য কোথাও এত কম ভাড়ায় ট্যাক্সি চড়া যায় না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অমানবিক কাজ
জাপানে আবিষ্কৃত রিক্সা প্রথমে এশিয়ার দেশগুলিতে পরিচিতি পেলেও, ইতিমধ্যে সাইকেল রিক্সা হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর চল রয়েছে৷ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবশ্য টানা রিক্সা শহরের প্রায় সব জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ আজকের যুগে মানুষ-টানা রিক্সাকে রাজনীতিবিদ সহ অনেকেই অমানবিক বলে মনে করেন৷ তাই তাঁরা এ ধরণের রিক্সা একেবারেই তুলে দেওয়ার পক্ষে৷
ছবি: Gemeinfrei
সন্নাসীরাও ট্যাক্সিতে ওঠেন
থাইল্যান্ডে ট্যাক্সি চড়ে ঘুরে বেড়ানোটা বেশ মজার একটা ‘অ্যাডভেঞ্চার’৷ তবে ওখানকার তিন চাকাওয়ালা ‘টুক-টুক’-এ চড়তে শক্ত নার্ভ আর স্থিতিশীল পাকস্থলী থাকা প্রয়োজন তা না হলে মুসকিল৷ অন্যদিকে আরামদায়ক গাড়ির মধ্যে লিমোজিন অন্যতম৷এই গাড়িতে ওঠার আগে পর্যটকদের ভাড়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা ভালো৷ থাইল্যান্ডে সন্নাসীদের বিশেষ অবস্থানের কারণে তাঁরা এই ব্যয়বহুল লিমোজিনে উঠতে পারেন, তাও আবার বিনা পয়সায়৷
ছবি: picture-alliance/Sebastian Kahnert
বিরক্তিকর!
কম্বোডিয়ায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য সাইকেল রিক্সা, মোফাট্যাক্সি, মিনিবাসের মতো নানান যানবাহন রয়েছে৷ তবে ‘পিকআপ’ হচ্ছে সস্তা যানবাহনের একটি৷ আরাম যার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে এতে চড়তে পারেন৷ তবে ‘পিকআপ’-এ চড়ার আগে এটা ধরেই নিতে হবে যে, তাঁকে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে কষ্ট করে বসতে হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
সবুজ চা পান
চীনের প্রধান শহরগুলোতে ট্যাক্সিই মূল যানবাহন৷ শুধুমাত্র পেকিংয়েই চলে প্রায় ৬৬,০০০ ট্যাক্সি৷ শুধু তাই নয়, ট্যাক্সিতে খুব কম খরচে এবং সহজে যাতায়াত করা যায়৷ তবে বেশিরভাগ ট্যাক্সি চালক ইংরেজি না জানায়, গন্তব্যস্থলটি চীনাভাষায় লিখে চালককে ধরিয়ে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ পর্যটকদের এটাও জানা দরকার যে চীনা ট্যাক্সি চালকরা যখন-তখন সবুজ চা পান করেন৷ তাই আপনাকেও যদি সেই চা খেতে বলা হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জলের ওপর বিলাসবহুল ট্যাক্সি
ইটালির ভেনিস শহরে হাতে গোনা পিচ ঢালা সমান্তরাল রাস্তা রয়েছে৷ কারণ শহরটি রাস্তার বদলে সরু সরু খালে ভর্তি৷ দেড় হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরের বুকে শহরটির গোড়াপত্তন হয়৷ আর তখন থেকেই ছোট ছোট নালা বা খালের ভেতর দিয়ে চলতো কাঠের তৈরি সোনালি-কালো গন্ডোলা৷ দাঁড় বেয়ে মাঝিরা এই রোম্যান্টিক নৌকা চালান, রাতের বেলায় যাতে ৪০ মিনিট চড়তে খরচ হয় ১০০ ইউরো৷ আজকাল অবশ্য ইলেক্ট্রিক জলট্যাক্সিও পাওয়া যায় ভেনিসে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
পুরুষালি দুনিয়া
বলতে কি, প্যারিসের ট্যাক্সিগুলো কোনো বিশেষ মডেলের গাড়ি নয়৷ নাদিয়া আলিলি একটি কালো টয়োটা চালান – দিনে ১১ ঘণ্টা করে৷ ট্যাক্সিচালকদের পুরুষালি দুনিয়ায় নারী হিসেবে তিনি নিজের জায়গা করে নিয়েছেন:
‘‘দিনে অন্তত দু'বার করে শুনি: এই প্রথম একজন মহিলা ট্যাক্সি ড্রাইভার দেখলাম৷ আমাদের পেশায় অনেকেই বেশি ‘মাচো' ভাব দেখায়৷ তা কী করে ম্যানেজ করতে হয়, সেটা শিখতে হয়৷ ওদেরও আমার মতো মহিলা ড্রাইভারদের মেনে নিতে হবে৷ আর গ্রাহকরা তো মহিলা ড্রাইভার পেলে খুব খুশি৷''
ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাজটা খুবই ‘স্ট্রেনুয়াস'৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও নাদিয়ার এই স্বাধীনতা ভালো লাগে:
‘‘আমি নিজেই আমার ট্যাক্সির মালিক এবং আমার কোনো বাঁধাধরা কোনো কাজের সময় নেই৷ নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও ভালো লাগে: সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মন্ত্রী৷ একবার তো নাম-করা সাবেক টেনিস খেলোয়াড় ইয়ানিক নোয়া-র সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷''
‘‘রাত আর দিনের যাত্রী একরকম নয়৷ দিনের বেলা বিজনেসম্যান আর টুরিস্টরা ট্যাক্সি চড়েন৷ রাতে যাঁরা নাইট ক্লাবে অথবা ডিস্কোয় যাচ্ছেন, তাঁরা আর সেই সঙ্গে নানা ধরনের লোক৷ ভালো লোকও হতে পারে, আবার খারাপ লোকও হতে পারে৷ কাজেই রাতে অত ট্যাক্সি চলে না৷ অনেক ট্যাক্সিচালক রাতে ট্যাক্সি চালাতে ভয় পান৷''