জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের ভবিষ্যত আজ অনিশ্চিত৷ অভিযোজনের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য তাই প্রয়োজন পারিসে একটি বাধ্যতামূলক চুক্তি৷
বিজ্ঞাপন
জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম৷ ভূমির কম উচ্চতা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, কৃষি নির্ভরতা এবং দারিদ্র্যের সংমিশ্রণ দেশটিকে করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ৷
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের লাখো মানুষের বাড়ি ঘর ও ফসলি জমি সমুদ্র পৃষ্ঠে তলিয়ে যাবার ঝুঁকির মুখে৷ শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল বাংলাদেশে অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবনের অস্তিত্বও আজ হুমকির সম্মুখীন৷
পানির উপর হচ্ছে সবজি চাষ
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামের বেশিরভাগই বছরের পুরোটা সময় জলাবদ্ধ থাকে৷ এ সব গ্রামের মানুষেরা ভাসমান পদ্ধতিতে গাছের চারা এবং সবজি উৎপাদন করে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছেন৷
ছবি: DW
কৃষকের কৌশল
বছর জুড়েই জলাবদ্ধতা, সাথে কচুরিপানার মিছিল৷ ফলে পিরোজপুরের নাজিরপুর এলাকার নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক উপায়ে কৃষিকাজ কার্যত অসম্ভব৷ তবে বৈরী এই পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে নাজিরপুরের কৃষকরা নিজেদের কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষিকাজ৷
ছবি: DW
ভাসমান কৃষিক্ষেত্র
নাজিরপুরের মুগাঝোর এলাকার জলাভূমিতে ভাসমান কৃষিক্ষিত্র৷ নিজেদের উদ্ভাবিত ‘ধাপ’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন এ সব এলাকার মানুষরা৷ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘কৃষি ঐতিহ্য অঞ্চল’ হিসেবেও স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে নাজিরপুরে উদ্ভাবিত ভাসমান পদ্ধতির এ চাষাবাদ৷
ছবি: DW
যেভাবে তৈরি হয় ধাপ
নাজিরপুরের পানিতে ডোবা নিম্নাঞ্চল কচুরিপানা, দুলালীলতা, শ্যাওলা ও বিভিন্ন জল সহিষ্ণু ঘাসসহ নানান জলজ উদ্ভিদে ভরপুর৷ এ সব জলজ উদ্ভিদকে স্তূপ করে পচিয়ে তারা তৈরি করেন ভাসমান এক ধরণের ধাপ৷ এই ভাসমান ধাপের উপরেই চাষাবাদের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তাঁরা৷
ছবি: DW
পুরনো ধারা
কৃষি জমির বিকল্প হিসেবে জলাশয়ে ভাসমান চাষাবাদ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে এ অঞ্চলে৷ কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদ্ধতিতে কৃষির উৎপাদনশীলতা জমির চেয়ে ১০ গুণ বেশি৷
ছবি: DW
জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ
ধাপ পদ্ধতির এ চাষাবাদ হয় সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে৷ রাসায়নিক সারের ব্যবহার নেই বললেই চলে৷ ফলে উৎপাদন খরচও কম এবং স্বাস্থ্যকর৷
ছবি: DW
ভাসমান বীজতলা
জলাভূমিতে প্রথমে কচুরিপানা, শ্যাওলা ও বিভিন্ন জলজ ঘাস স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই ফুট পুরু ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়৷ এগুলো কয়েকদিন ধরে পচানো হয়৷ একেকটি ভাসমান ধাপ ৫০-৬০ মিটার লম্বা ও দেড় মিটার চওড়া হয়৷
ছবি: DW
চাষ করা যায় অনেককিছু
ভাসমান এ সব ধাপে সাধারণত লাউ, সিম, বেগুন, বরবটি, করলা, পেঁপে, টমেটো, শশা, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, মরিচ ইত্যাদি শাকসবজি ও মশলার চারা উৎপাদন করে থাকেন কৃষকরা৷ অনেক কৃষক আবার লাল শাক, ঢেঁড়স, হলুদ ইত্যাদিও চাষ করে থাকেন৷
ছবি: DW
নেই কোনো কৃষিঋণের ব্যবস্থা
মুগারঝোরের চাষীদের জন্য কৃষি ঋণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে চরা হারে সুদ নিয়ে গরিব এ চাষীরা তাঁদের কৃষি কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন৷ স্থানীয় কৃষক আশুতোষ জানান, সরকার সহজশর্তে ঋণ দিলে তাঁরা ভাসমান এ চাষাবাদের আরও বিস্তৃতি ঘটাতে পারবেন৷
ছবি: DW
বিক্রি হয় কচুরিপানা
নাজিরপুরের মুগারঝোরে নৌকা বোঝাই কচুরিপানা নিয়ে ক্রেতার খোঁজে এক বিক্রেতা৷ এক নৌকা কচুরিপানা সাধারণত বিক্রি হয় ২-৩ হাজার টাকায়৷ এছাড়া নাজিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় এসব কচুরিপানার হাটও বসে৷
ছবি: DW
9 ছবি1 | 9
কৃষি নির্ভর এই দেশটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চাষের জমিতে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ বাড়ছে, যার ফলে এ সকল জমি হয়ে উঠছে চাষবাসের অযোগ্য৷ এর সাথে খরা ও বন্যার মাত্রা ও বেড়ে চলেছে যাতে ফসলের আবাদ নষ্ট হচ্ছে৷ এমতাবস্থায় কৃষিকাজ নির্ভর মানুষজন তাদের জীবিকা নির্বাহের পন্থা হারিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে৷
যদিও বহু বছর ধরেই বাংলাদেশ ঘুর্ণিঝড়ের প্রকোপে আক্রান্ত, খুবই কম সময়ের ব্যবধানে দুটি প্রকট সাইক্লোন – সিডর এবং আইলা – দেশটির ইতিহাসে অবিস্বরনীয়৷ ঘনঘন দুর্যোগের তাণ্ডবে শুধু জানমালের ক্ষতি হচ্ছে না, অনেক মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে ৷ বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত চার লাখ মানুষ ঢাকায় চলে আসে, যাদের মধ্যে অনেকেই জলবায়ু উদ্বাস্তু৷
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ নিজস্ব ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ দ্বারা একটি জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড তৈরি করেছে, যার মাধমে দেশের ৭০ ভাগ এরও বেশি অভিযোজন প্রকল্প অর্থায়িত হচ্ছে৷ কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই অর্থ অত্যন্ত অপ্রতুল৷
বাংলাদেশের মত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর অভিযোজনের জন্য উন্নত বিশ্বের আর্থিক সহায়তা অত্যন্ত প্রয়োজন৷ এই প্রেক্ষাপটে প্যারিসে চলমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে অভিযোজনের জন্য উন্নত বিশ্বের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষে একটি বাধ্যতামূলক চুক্তি বাংলাদেশের লাখো মানুষের ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিশ্চিতার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷