রশিদা বেগমের কাছে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়াটা একসময় আতঙ্কের ব্যাপার ছিল৷ চুপিসারে জঙ্গলে গিয়ে একটু আড়াল আছে এমন জায়গা খুঁজে নিতে হতো তাঁকে, কেননা, অনেকের মতো তাঁর বাড়িতেও টয়লেট ছিল না৷
বিজ্ঞাপন
কিন্তু গত এক দশকে পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ ঢাকার একটু বাইরে রশিদা বেগমের গ্রাম এবং আরো অনেক জায়গায় এখন আর মানুষকে জঙ্গলে যেতে হয়না প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে৷ টয়লেট নির্মাণে জোর প্রচারণা এবং প্রকাশ্যে মলত্যাগের কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ দেশটির সরকার সফলতা পেয়েছে৷ ২০০৩ সালে যেখানে দেশটির ৪২ শতাংশ মানুষ প্রকাশ্যে মলত্যাগ করতো, বর্তমানে সেই হার কমে হয়েছে মাত্র এক শতাংশ৷
বর্মি গ্রামের বাসিন্দা বেগম বলেন, ‘‘একসময় পাশের বাগান বা জঙ্গলে গিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়াটা ছিল আমাদের অভ্যাস৷ এখন এটা একটা লজ্জার ব্যাপার৷ এমনকি আমাদের শিশুরাও এখন আর প্রকাশ্যে মলত্যাগ করে না৷ আর এটা আমাদের তাদেরকে বলেও দিতে হয়নি, তারা নিজেরাই শিখেছে৷''
স্যানিটেশনে বাংলাদেশের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বড় ধরনের অর্থায়ন৷ এক্ষেত্রে প্রচারণা বাড়াতে বেশ বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেছে সরকার৷ ফলে প্রতিবেশী দেশ ভারত যে কাজে এখনো সাফল্য পায়নি, বাংলাদেশ পেয়েছে৷
বাংলাদেশে স্যানিটেশন কাভারেজ বাড়ছে, রয়েছে বিতর্কও
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের হার ক্রমশ বাড়ছে৷ তবে এখনো অনেক মানুষের কাছে এই সুবিধা পৌঁছায়নি৷ ঠিক কত শতাংশ মানুষ টয়লেট ব্যবহার করছে তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক৷
ছবি: DW
বেড়েছে টয়লেটের ব্যবহার
একটা সময় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ির কোনায় খোলা শৌচাগার দেখা যেত৷ খালের পাশে, পুকুরের কোনায় থাকতো মলত্যাগের স্থান৷ এখন পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে৷ সরকারি হিসাব বলছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবার স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করছে৷
ছবি: DW/K. James
শতাংশের হিসাব
বাংলাদেশে ঠিক কত শতাংশ মানুষ টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন তার একটা হিসেব পাওয়া যায় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে৷ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে দেওয়া বাজেট বক্তৃতায় জানান, ‘‘আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ৯০ শতাংশ পরিবারকে স্যানিটেশনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে৷’’
ছবি: DW/A. Chatterjee
তবুও সমালোচনা
তবে অর্থমন্ত্রীর দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করেননি এসংক্রান্ত একজন বিশেষজ্ঞ৷ ওয়াটারএইড বাংলাদেশের ডা. মো. খায়রুল ইসলাম ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতায় লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে ২০১৩ সালের মধ্যে সবার জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল৷’’ কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক অনেক বলেই মনে করেন খায়রুল৷
ছবি: Lalage Snow/AFP/Getty Images
প্রতিশ্রুতি কি পূরণ হয়েছে?
জুন মাসে প্রকাশিত লেখায় খায়রুল অর্থমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ের বাজেট বক্তৃতা পর্যালোচনা করেছেন৷ এতে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে স্যানিটেশনের কভারেজ এক শতাংশ কমেছে৷ খায়রুল ইসলাম তাঁর নিবন্ধে আরেকটি হিসেব দিয়েছেন যার সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের কোন মিল নেই৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের সদ্যপ্রকাশিত যৌথ প্রতিবেদন ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে উন্নত ল্যাট্রিনের হার ৫৫ শতাংশ৷’’
ছবি: PRAKASH SINGH/AFP/Getty Images
তবে কাজ চলছে
স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিতে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও কাজ এগিয়ে চলেছে৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ২৪৮টি উপজেলার গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের নিকট টেকসই ও সমন্বিত ওয়াটার, স্যানিটেশন ও হাইজিনসেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে অস্বাস্থ্যকর ল্যাট্রিন, দূষিত পানি এবং অনিরাপদ স্বাস্থ্য অভ্যাসের কারণে সৃষ্ট দূষণচক্রের অবসানকল্পে কাজ করছে সংস্থাটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যে কারণে প্রয়োজন স্যানিটেশন
স্যানিটেশনের অভাবের কারণে পৃথিবীতে প্রতিদিন পাঁচ হাজার শিশু প্রাণ হারায়৷ যেখানে-সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করলে তা আশেপাশের পরিবেশে এবং পানিতে রোগ, জীবাণু ছড়ায়৷ আর সেই পানি ব্যবহার করলে মানুষের শরীরে দেখা দেয় কলেরা, ডায়রিয়াসহ নানা রোগ৷ এতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্প ব্যবস্থা
স্বল্প খরচে নিরাপদ টয়লেট নিশ্চিতে চলছে নানাবিধ গবেষণা৷ সম্প্রতি জার্মানির বিজ্ঞানীরা এক নতুন ধরনের কমোড আবিষ্কার করেছেন যা ব্যবহার অত্যন্ত সহজ৷ আর তৈরিতে খরচও কম৷ এই কমোড থেকে রোগ, জীবাণু সহজে বাইরে যাবে না৷ বরং এতে থাকা মলমূত্র দিয়ে সার তৈরি সম্ভব হবে৷
ছবি: DW
7 ছবি1 | 7
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক-এর আকরামুল ইসলাম এই বিষয়ে বলেন, ‘‘সরকার একটা বড় অঙ্গীকার করেছে৷ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বরাদ্দকৃত অর্থ একেবারে দরিদ্রদের কাছে, অর্থাৎ যাঁদের বাড়িতে কোনো শৌচাগার নেই, তাঁদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে৷''
সরকারের প্রকৌশলীরাও গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদ এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে মিলে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছেন, বাড়িতে শৌচাগার থাকা কেন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অন্যতম শর্ত৷
তবে শৌচাগার নিশ্চিত করা গলেও সমস্যা এখনো পুরোপুরি কাটেনি৷ ওয়াশিংটনভিত্তিক পানি, স্যানিটেশন এবং হাইজিন বিষয়ক সংস্থা পিএসআইয়ের পরামর্শক জন সাওয়ার জানান, মানুষ টয়লেট ব্যবহার করলেও মানববর্জ্য শেষ পর্যন্ত কোথায় ফেলা হচ্ছে, সেটাও দেখার বিষয়, কেননা, এসব বর্জ্য মাটির নীচে থাকা পানি দূষিত করলে কিংবা শিশুরা যে মাঠে খেলে বা যে মাঠে ফসল ফলানো হয়, সেখানে ফেলা হলে, তা ক্ষতিকরই থেকে যাবে৷
বিশেষ করে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের কথা উল্লেখ করে সাওয়ার আরো বলেন, ‘‘আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে মানববর্জ্য কোথায় যাচ্ছে, সেগুলো কোন উপায়ে ধ্বংস বা পুনরায় ব্যবহার করা হচ্ছে৷''
নিরাপদ পয়ঃপ্রণালি রোগকে দূরে রাখে
বিশ্বে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ টয়লেট ব্যবহার করে না৷ উন্নত পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, এমনকি অর্থনীতির উন্নয়নেও সহায়তা করে৷
ছবি: Patrick Baumann
মানবাধিকারের জন্য সোচ্চার
বার্লিনের কেন্দ্রীয় স্টেশনে এই ব্যক্তিদের মতো বিশ্বের অনেক দেশেই এখন উন্নত স্যানিটেশনের জন্য সোচ্চার হচ্ছে মানুষ৷ বিশ্বে প্রতি তিনজন মানুষের মধ্যে একজনের পরিষ্কার, নিরাপদ টয়লেট নেই৷ খারাপ পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী৷ বিশ্বে ম্যালেরিয়ার চেয়ে খারাপ স্যানিটেশনের কারণে বেশি মানুষ মারা যায়৷
ছবি: John Macdougall/AFP/Getty Images
সুস্থ বিনিয়োগ
খারাপ স্যানিটেশনের কারণে পানিবাহিত রোগ, যেমন টাইফয়েড এবং পাতলা পায়খানা খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে৷ আফ্রিকার অন্যতম বড় বস্তি কিবেরায় স্যানিটেশন একটি বড় সমস্যা৷ তারা প্লাস্টিক ব্যাগেই টয়লেট করে সেটা যেখানে সেখানে ফেলে রাখে৷ তবে এখন এধরনের টয়লেট গড়ে ওঠার কারণে সেখানে রোগের প্রকোপ কমেছে৷
ছবি: DW
যারা শৌচাগার পরিষ্কার করে
ভারতের বেশিরভাগ গ্রামে পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থার এই চিত্রই লক্ষ্য করা যায়৷ ছবিটি ভারতের উত্তরাঞ্চলের মুদালি গ্রামের৷ এখানে মানুষই টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটি করে থাকে৷ ২০ বছর আগে এ ধরনের শৌচাগার নিষিদ্ধ করা হলেও এখনও এ প্রক্রিয়া চলছে৷
ছবি: Lakshmi Narayan
সংকটময় পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ
সংকটময় পরিস্থিতি বা জরুরি কোনো অবস্থায় নিরাপদ স্যানিটেশন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়৷ বিশেষ করে শরণার্থী শিবিরগুলোতে এ সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে
এই ছবিটি ইরাকের কুর্দিস্তানের৷ সিরিয়া সীমান্তের এই এলাকাটিতে শরণার্থীদের চাপ দিন দিন বাড়ছে৷ কিন্তু মানুষের তুলনায় স্থান সংকুলান না হওয়ায় গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে অনেক মানুষকে৷ ফলে নিরাপদ স্যানিটেশন না থাকায় খুব দ্রুত পোলিও ও অন্য পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে৷
ছবি: DW/M. Isso
পরিবেশবান্ধব শৌচাগার
বলিভিয়ার রাজধানী লাপাজ-এর বাইরে এল-আলতো-তে এই শৌচাগারগুলোর অবস্থান৷ নিরাপদ স্যানিটেশনের জন্য তারা এই ব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছে৷ বিশেষভাবে তৈরি এই টয়লেটগুলো পরিবেশবান্ধব, কেননা এখান থেকে পয়ঃবর্জ্য সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ এতে স্থানীয় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন৷
ছবি: Sustainable Sanitation/Andreas Kanzler
ভুল ধরনের শৌচাগার
কেবল উন্নয়নশীল দেশেই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২ কোটি মানুষের ভালো স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই৷ ইউরোপের প্রত্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় মাটিতে গর্ত করে তৈরি শৌচাগার বেশি ব্যবহৃত হয়৷ এর ফলে মাটির নীচ দিয়ে খাবার পানিতে মিশে যায় পয়ঃবর্জ্য৷
ছবি: picture-alliance/CTK
পাহাড়ের চূড়ায় পয়ঃনিষ্কাশন
বিশ্বের এমন কিছু স্থান আছে যেখানে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এমনকি বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই৷ সেখানে কিভাবে স্যানিটেশন ব্যবস্থা কাজ করে তা নিয়ে সক্রিয় টয়লেট বিশেষজ্ঞ লিউক বার্কলে৷ তিনি বিশ্বের প্রত্যন্ত কিছু এলাকা পরিদর্শন করে এ বিষয়ে ‘আ লু উইথ আ ভিউ’ নামে একটি বই লিখেছেন৷ আলাস্কা-র মাউন্ট ম্যাককিনলে এমন একটি জায়গা৷ উত্তর অ্যামেরিকার সুউচ্চ পর্বতচূড়ার দৃশ্য এটি৷