পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে তাত্ত্বিক তর্কবিতর্কের পথে না গিয়ে নিজস্ব জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে হাতেনাতে বিকল্প জীবনধারার দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে ব্রিটেনের এক পরিবার৷
বিজ্ঞাপন
ম্যাথিউ ওয়াটকিনসন নিজের এক স্বপ্ন পূরণ করেছেন৷ প্রকৃতির উপহার দিয়েই উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছেন তিনি৷ স্ত্রী ক্যারিস ও তিনি পশু চিকিৎসক হিসেবে নিজেদের পেশা ছেড়ে ওয়েলস প্রদেশের নিউপোর্টে সমুদ্রের ধারে নিজেদের ছোট্ট জমিতে চাষবাস করছেন৷ ম্যাথিউ মনে করেন, ‘‘সামান্য কল্পনাশক্তি থাকলেও অঢেল সুযোগ ও সম্ভাবনা চোখে পড়বে৷ শুধু ভিন্ন কিছু করার তাগিদ থাকতে হবে৷ আমরা সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি কাজে লাগিয়ে ভেড়া চরানোর মাঠে প্রাণ ভরিয়ে দিয়েছি৷''
ওয়াটকিনসন পরিবার বেশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে৷ তাঁদের বাড়ি বিদ্যুতের গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত নয়৷ ওয়াশিং মেশিনের বদলে তারা হাতে চালানো যন্ত্র দিয়ে কাপড় কাচেন৷ মিনি উইন্ড মিল ও সৌর প্যানেল দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা মেটে৷
কিন্তু বাতাস চলাচল কমে গেলে বা আকাশে মেঘ করলে বিদ্যুতের জোগানও কমে যায়৷ সব কিছুই জোড়াতালি দিয়ে চলে৷ সব কিছু পুনর্ব্যবহার করা হয়৷ এমনকি পুরানো গাড়িও বাদ যায় না৷ চ্যারিস ওয়াটকিনসন সেগুলি দেখিয়ে বলেন, ‘‘এটির মধ্যে আমরা সব বীজ রাখি, সেখান থেকেই বীজ বপন করা হয়৷ এটির মধ্যে বাড়তি শোবার ঘর রয়েছে৷ আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এলে থাকতে পারে৷''
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার স্বামী ম্যাথিউ বলেন, ‘‘আমরা ঘোড়ার লরি দিয়ে শুরু করেছিলাম, যেটা বাসের যোগ্য করে তোলার সবচেয়ে দ্রুত উপায় মনে হয়েছিল৷ আরও বেশি জায়গার প্রয়োজন মেটাতে আমরা কিছু ট্রাক্টরের ট্রেলার জোগাড় করলাম৷ সবকটি জুড়ে উপরে কাঠের ছাদ বসিয়ে এই ফল পেয়েছি৷ সে সময়ে এমন এলোমেলো সব জিনিস জুড়তে হয়েছিল৷''
অরগ্যানিক জীবনধারার পথিকৃত হিসেবে স্বীকৃতি পেতে এই পরিবারকে অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ গ্রামের বাসায় সেই পরিবার যথেষ্ট উৎপাদন করছে কিনা, প্রতি বছর কর্তৃপক্ষ তা পরীক্ষা করে৷ কারণ তার সঙ্গে জাতীয় পার্কের মাঝে নির্মাণের অনুমতির বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে৷ চ্যারিস বলেন, ‘‘ইকলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট দেখাতে ব্যয়ের সব হিসেব পেশ করতে হয়৷ সব খাবারদাবার, স্টেশনারি, ব্যবহৃত জামাকাপড়, নতুন জামাকাপড়, জুতা – সবকিছু৷''
‘আধুনিকতা’ ছেড়ে প্রকৃতির সঙ্গে বাস করা ব্রিটেনের পরিবার
04:28
ছয় বছর ধরে ওয়াটকিনসন পরিবার সেখানে বাস করছেন৷ এখন তাদের প্রতিবেশীরা নিজেদের জমিতে প্রবেশের পথ কঠিন করে তুলতে চায়৷ এই পরিবার আগে এমন আশঙ্কা করে নি৷ ম্যাথিউ মনে করেন, ‘‘নিজের বিশ্বাসের মূলে বাধাই সবচেয়ে কঠিন বিষয়৷ জমির এই ফালি মানুষ ও বন্যপ্রাণীর জন্য আরও বাসযোগ্য করে তোলায় আমি বিশ্বাস করি৷''
ওয়াটকিনসন পরিবার অনেক কিছু ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ পুরানো ট্রেলারের মধ্যে থাকা মোটেই আরামদায়ক নয়, বিশেষ করে শীতের সন্ধ্যাগুলিতে বেশ কষ্ট হয়৷ তা সত্ত্বেও সেই বাসার প্রতি হৃদয়ের টান আরও জোরালো হয়েছে৷ তাছাড়া তাঁরা নিজেদের সন্তানদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চান৷ চ্যারিস ওয়াটকিনসন বলেন, ‘‘আমরা পরিবেশের উপর অনেক কম প্রভাব রাখছি৷ ফলে তারা দেখতে পাচ্ছে, কীভাবে ভবিষ্যতেও তারা এমনটা করতে পারে৷ বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলিভিশন ও ইন্টারনেট পুরোপুরি বর্জন না করেও এমনটা করা যায়৷ সে সব থাকা সত্ত্বেও আমরা এটা করতে পারছি৷''
কয়েকজন প্রতিবেশির ভ্রুকুটি সত্ত্বেও ওয়াটকিনসন পরিবার আশা করছে, যে এভাবে আরও মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাস করার প্রেরণা জোগানো যাবে৷
বির্গিট মাস/এসবি
মানবজাতির অবলুপ্তির আশঙ্কায় সোচ্চার যারা
যুক্তরাজ্যের ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’ অ্যাক্টিভিস্টরা আবার পথে নামলেন৷ লকডাউনের পরেই এই পরিবেশপ্রেমী মঞ্চের অভিনব বিক্ষোভ কেমন ছিল, দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Reuters/T. Melville
এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন কী?
২০১৮ সালের অক্টোবরে শতাধিক সমাজকর্মী, অধ্যাপক ও অন্যান্য পেশাজীবীদের তৎপরতায় লন্ডনে যাত্রা শুরু করে ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’ বা ‘এক্স আর’৷ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি ঠেকাতে অবিলম্বে যুক্তরাজ্য সরকারকে কঠোর কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, এই দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে তারা৷ অভিনব পদ্ধতিতে আন্দোলন ও প্রতিবাদের নিত্যনতুন ধারার কারণে প্রতি বছরই শিরোনামে উঠে আসে তাদের কাজ৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক কর্মসূচি
‘ইন্টারন্যাশনাল রেবেলিয়ন’ নামের দুই সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচির মাধ্যমে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে এক্স আর বিশ্বের ৬০টি শহরে তাদের বার্তা ছড়াতে সক্ষম হয়৷ লন্ডনেই তাদের প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দেন ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ৷ ব্যতিক্রমী দেওয়াল-লিখন, রঙবেরঙের পোশাক ও স্লোগানে ভরে ওঠে লন্ডন, নিউইয়র্ক, তেল আবিব, ইস্তাম্বুল, আমস্টারডাম, মেক্সিকোসহ আরো অনেক শহর৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
করোনার ২০২০: এবার যা হলো
২০২০ সালে করোনা সংকটের কারণে যুক্তরাজ্যে জনজীবন এতদিন ছিল স্তব্ধ৷ লকডাউন উঠতেই পথে নামলেন এক্স আর-কর্মীরা৷ পরিবেশের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম, সমাজ ও গণতন্ত্রও উন্মুক্ত নয়, এমন বার্তা নিয়ে পথে নামেন তারা৷ ‘দ্য সান’, ‘দ্য টাইমস’, ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’ ও অন্যান্য সংবাদসংস্থার অফিসের বাইরে ধর্ণায় বসেন তারা৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
সারা বিশ্বে ‘এক্স আর’
যুক্তরাজ্যের বাইরেও হয়েছে একই ধাঁচের প্রতিবাদ৷ ২০১৯ সালের ইন্টারন্যাশনাল রেবেলিয়নের দিনগুলি ছাড়াও এই ধরনের কর্মসূচি দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, সিডনি, অ্যাডিলেড ও ব্রিসবেনে৷ এছাড়া জার্মানির বার্লিন, মিউনিখ, হাইডেলবার্গ, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস, লাউজান, স্পেনের মাদ্রিদ, সুইডেনের কোপেনহাগেন, নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতেও নানা ধরনের প্রতিবাদ দেখা যায়৷
ছবি: Imago Images/AAP/J. Carrett
জেল ভরায় বিশ্বাসী
নিজেদের আদর্শের কথা কর্তৃপক্ষের কানে তুলতে দলে দলে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যেতে প্রস্তুত এক্স আর-কর্মীরা৷ এ বছর শুধু লন্ডনেই গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭২জন এক্স আর-কর্মী৷ এক্স আরের ওয়েবসাইট বলছে, এই পন্থার অনুপ্রেরণা তারা পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল রাইটস আন্দোলন, অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভোটাধিকার আন্দোলন, পোলিশ ও পূর্ব-জার্মান গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
সোশাল মিডিয়ায় ‘এক্স আর’
‘দ্য অবজার্ভার’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালের ইন্টারন্যাশনাল রেবেলিয়নের সময় ৭০ হাজারেরও বেশি বার অনলাইনে উঠে এসেছে এই মঞ্চের কথা৷ এর মধ্যে প্রায় ৪৪ শতাংশই ছিল যুক্তরাজ্যে৷ ১৫ শতাংশ জার্মানি থেকে, ১৫ শতাংশ অস্ট্রেলিয়ায় ও ১২ শতাংশ অ্যামেরিকা থেকে৷ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়াতেও এক্স আরের উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
জনগণের প্রতিক্রিয়া
২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় লন্ডনের কিছু অঞ্চলের বাসিন্দাদের মতামত নেওয়া হয়৷ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ জানান, তারা এক্স আরের কর্মসূচি সমর্থন করেন৷ শুধু তাই নয়, এরপর আরেকটি বড় আকারের সমীক্ষায় সেই একই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ শতাংশতে৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
বিখ্যাত এক্স আর সমর্থক
ব্রিটিশ অভিনেত্রী এমা টমসন, পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবের্গ, মহাকাশবিজ্ঞানী জেমস হানসেন ও সমাজতাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কির মতো ব্যক্তিত্বরা ইতিমধ্যেই তাদের এক্স আর-সমর্থনের কথা বলেছেন৷ এছাড়াও, ২০১৯ সালের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক, ডাক্তার, বিজ্ঞানী ও সংস্কৃতিকর্মী৷