আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীমউদ্দিনের অভিযোগ, সোমবার বিকেলে ঢাবির প্রক্টর কার্যালয়ের দুজন কর্মকর্তা-কর্মচারী তার বিভাগীয় কার্যালয়ে গিয়ে তল্লাশি চালান৷ তারা তার ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে যান৷ এছাড়া একই দিন সন্ধ্যায় তার স্থায়ী ঠিকানায় পুলিশ দিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে বলে ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে জানিয়েছেন তিনি৷
তিনি লিখেছেন, ‘‘১৭ অক্টোবর ২০২২, সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যকে শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দিয়ে আসি সাড়ে বারোটা -একটা নাগাদ৷ এরপর বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ প্রক্টর অফিস থেকে দুজন কর্মচারী আমার বিভাগের অফিসে গিয়ে আমার ব্যক্তিগত ফাইল তল্লাশি করে! আমার স্থায়ী ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য নিয়ে যায়! আমার যাবতীয় তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে আছে! সেই তথ্য যোগাড় করতে বিভাগে কেন কর্মচারী গেল আমার ব্যক্তিগত ফাইলের জন্য? কোনো তথ্য দরকার হলে তো রেজিষ্ট্রার ভবনই যথেষ্ট!''
বাংলাদেশে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের নীতিমালা নেই৷ বাকিগুলোতে নিয়ম আছে কাগজে৷ ভিসি নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয়ই মুখ্য হয়ে উঠছে৷
ছবি: sust.eduঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার কথা ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের আলোকে৷ নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিনেট তিনজন শিক্ষাবিদকে উপাচার্য হিসেবে মনোনীত করবে৷ সেই তিনজনের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দিবেন আচার্য অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DWসংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত আড়াই দশকে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয়নি৷ জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও নির্বাচন ছাড়াই উপাচার্য নিয়োগ হয়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সরাসরি ভিসি নিয়োগ দিয়েছেন আচার্য৷ (ছবি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম)
ছবি: bdnews24.comএই চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারপন্থি শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বা সরকারের আস্থাভাজনরাই উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান৷ বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদা দলের রাজনীতি সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরা উপাচার্য হয়েছেন৷ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নীল দলের নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষকরা পেয়েছেন উপাচার্য পদ৷ (ছবি:ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান)
ছবি: Mortuza Rashed/DWঅন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারপন্থি দলের শিক্ষক নেতারা৷ যেমন শাবিপ্রবির আলোচিত ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ (ছবিতে) ঢাবি শিক্ষক সমিতিতে নীল দল থেকে তিনবারের নির্বাচিত সভাপতি৷ ইউজিসির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে অর্ধশত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে৷ এর মধ্যে ১৩ টিতেই উপাচার্য হিসেবে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা৷
ছবি: sust.eduসরকারি চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিগুলোতে উপাচার্য নিয়োগের কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা নাই৷ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের কোনো নীতিমালা নাই৷ কে উপাচার্য হবেন, সেটা কেউ জানে না৷ যিনি উপাচার্য হবেন তিনিও জানেন না৷’’
ছবি: bdnews24.comবেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৮টি৷ সেগুলো এখন চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর অধীনে৷ এই আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড অব ট্রাস্টিজের প্রস্তাবিত যোগ্য ব্যক্তিকে চার বছরের জন্য উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিবেন আচার্য বা রাষ্ট্রপতি৷ বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সুপারিশে উপাচার্যকে তিনি অপসারণও করতে পারেন৷ (ছবি: ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন)
ছবি: Harun Rashid Swapan৭৩-এর অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে তৎকালীন চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো এই স্বায়ত্তশাসন রক্ষা ও জ্ঞান চর্চার পরিবেশ তৈরিতে কাজ করবে, যার নেতৃত্ব দিবেন উপাচার্য৷ তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা এই দায়িত্ব পালন করেন কিনা তা বড় প্রশ্ন৷ সাম্প্রতিক সময়ে নানা কার্যক্রমে ভিসিদের বিরুদ্ধে বরং দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে৷
ছবি: brur.ac.bd৬৪টি জেলায় ৬৪টি বিশ্ববিদ্যালয় করতে চায় সরকার৷ সে অনুযায়ী প্রতি বছরই কোন না কোন জেলায় চালু হচ্ছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়৷ কিন্তু সেগুলো চালানোর মতো এত যোগ্য উপাচার্য দেশে আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে৷ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকায় ভিসি বা গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন শিক্ষা ও গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে৷
ছবি: Sawpan Chandra Dash তার প্রশ্ন, কোন ক্ষমতাবলে প্রক্টর একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত ফাইল তল্লাশি করতে তার দুজন কর্মচারীকে আমাদের বিভাগের অফিসে পাঠিয়েছে? তাকে এই এখতিয়ার কে দিলো?
তিনি আরও লিখেছেন, ‘ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি! সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় আমার স্থায়ী ঠিকানায় একজন এসআই গিয়ে জানায় যে, উনি আমার সম্পর্কে ভেরিফিকেশনের জন্য গেছেন৷ ওখান থেকে আমাকে ফোন দেওয়া হলে পুলিশ কর্মকর্তা জানান, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটা তালিকা করা হচ্ছে, সেই জন্য গেছেন! আবার জানালেন, উনার বস বলতে পারবেন আসল কারণটা কী? সবকিছু মিলিয়ে আমি নিশ্চিত, প্রক্টর তার আত্নমর্যাদাহীন এই মহাকাণ্ডটি'র সাথে আছেন৷ ঘটনার পরম্পরা তাই নির্দেশ করে!'
সবশেষে তিনি লিখেছেন, আমার প্রশ্ন, একজন প্রক্টর কি আসলে শিক্ষক নাকি অন্যকিছু? ভিন্ন চিন্তার নিজ সহকর্মীদেরকে কি চোর-ডাকাত মনে করেন? কোন্ আত্নমর্যাদা নিয়ে শিক্ষক হিসেবে শ্রেণি কক্ষে যান? অপরাজনৈতিক সেবাদাসের মানসিকতা নিয়ে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা কীভাবে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন? এই শিক্ষকেরা রাতের ঘুমানোর আগে ভালো কিছু কি চিন্তা করতে পারেন?
তানজীমউদ্দিন খান দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের একটি অংশের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক৷ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে গত সোমবার ঢাবির প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানীর অপসারণ দাবি করা শিক্ষকদের একজন তিনি৷ নেটওয়ার্কের পক্ষে গত সোমবার দুপুরে তানজীমউদ্দিনসহ কয়েকজন শিক্ষক ঢাবির প্রক্টরের অপসারণসহ চার দফা দাবিতে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন৷
তবে অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রক্টর বলছেন, এটা কল্পিত মিথ্যাচার, ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে মিথ্যাচার করছেন তানজীমউদ্দিন৷ তানজীমউদ্দিন জানিয়েছেন, বিষয়টি তিনি লিখিতভাবে উপাচার্যকে জানাবেন৷
তানজীমউদ্দিনের ব্যক্তিগত নথি তল্লাশি করতে যে দুজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন, তাদের একজনের নাম জানতে পেরেছে প্রথম আলো৷ তিনি প্রক্টর কার্যালয়ের সেকশন অফিসার রেজাউল করিম৷ তার বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য প্রক্টরের কথার মিল পাওয়া যায়নি বলে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷ রেজাউল প্রথম আলোকে বলেন, প্রক্টরের নির্দেশেই তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন৷
এপিবি/কেএম