‘প্রগতিশীল রাষ্ট্র হতে হবে’
৭ জানুয়ারি ২০১৯ডয়চে ভেলে: গেল বছরটি আপনার দৃষ্টিতে কেমন ছিল?
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: ভালো-মন্দ মিশিয়ে ছিল৷ ভালোটা হলো দেশের অগ্রগতির ধারাটা অবিচ্ছিন্ন ছিল৷ আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি মোটামুটি ভালো ছিল৷ এটি একটি ভালো লক্ষণ৷ আমাদের সমাজের মধ্যে একটা গতিশীলতা ছিল৷ আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিস্তার বেড়েছে, যদিও মান নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ প্রচুর মেয়ে এখন স্কুলে যাচ্ছে এবং তারা ঝরে পড়ছে না৷ এটা ভালো লক্ষণ৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শিক্ষাব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়েছে৷ এটিও ভালো৷ তাছাড়া ২০১৮ সালে উন্নন্নয়নের ধারাটা অব্যাহত আছে৷ এটা আমাদের একটা বড় প্রাপ্তি৷
২০১৮ সালে আমাদের কোন চাওয়াটা পূরণ হয়নি?
যেটা খুব উচিত ছিল– আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উন্নতি হওয়া৷ সেটা হয়নি৷ আমরা আশা করেছিলাম ২০১৮ সালে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনেক বেশি উন্নত হবে, যাতে ২০২১ সালে আমাদের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে আমরা গর্ব করে বলতে পারি যে, আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্রের দেশের মানুষ৷ কিন্তু সেটা বলার পর্যায়ে আমরা এখন আর নেই৷ তারপরও গণতন্ত্র টিকে আছে, এটিও একটি বড় অর্জন৷ আর নির্বাচনে তরুণদের অংশগ্রহণ বেড়েছে এটি আমার কাছে একটি ভালো বিষয়৷ আগামীতে হয়তো তরুণরাই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ঠিক করবেন৷ সেটিও বিভিন্ন দেশে হয়েছে৷ আসলে তরুণরা জাগলে একটা ঠিকানা আমরা পেয়ে যাই৷ শিক্ষার মানটা আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্যে নিতে পারিনি৷ এখন টিউশন বাণিজ্যের হাতে শিক্ষাব্যবস্থাকে তুলে দিচ্ছি৷ আর সামাজিক বৈষম্য বেড়েছে৷ এটা খুবই প্রকট৷ স্বাধীনতার পরপরই বলা হয়েছিল যে উক্তিটা, সেটাকে আমরা বিখ্যাত বা অখ্যাত বা কুখ্যাত যা-ই বলি না কেন, সেই ‘তলাবিহিন ঝুড়ি'র দেশে এখন আমরা অনেক উন্নত হয়েছি৷ এখানে সামাজিক সাম্য আসার কথা ছিল৷ অর্থনীতিতে বৈষম্যটা এত প্রকট যে, প্রচুর ধনী আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে৷ অথচ প্রচুর মানুষ আছে এখনো হতদরিদ্র৷ এটা এখনো ১৩, ১৪ বা ২০ শতাংশ৷ আর গ্রাম-শহরের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে৷ যেসব সুযোগ-সুবিধা শহরে আছে সেগুলো কিন্তু এখনো গ্রামে পৌঁছায়নি৷ এটাও কমা দরকার৷
নতুন সরকারে যাঁরা এলেন, তাঁরা তো তাঁদের ইশতাহারে গ্রাম আর শহরের ব্যবধান ঘোচানোর একটা অঙ্গীকার করেছে...
এখন দেখেন, সেটা করতে গিয়ে যদি শহরের অবকাঠামো গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে সেটা হবে মর্মান্তিক বিষয়৷ আমি তো গ্রামের রাস্তায় যানজট চাই না৷ আমরা তো গ্রামে শহরের বস্তি চাই না৷
ঘিঞ্জি এলাকা বানাতে চাই না৷ যে অর্থে সুখী হতে পারে, সেটা হচ্ছে, গ্রামে শহরের সকল সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেয়া৷ গ্রামের মানুষ যেন বৈষম্যহীন সুন্দর একটা জীবন যাপন করতে পারে৷ শহরের মধ্যবিত্তরা যে সুযোগ-সুবিধা পায় সেটা যদি গ্রামের মানুষ পায় আমি সেটাকে স্বাগত জানাব৷ কিন্তু গ্রামে কতগুলো দালান করে দিলাম, কতগুলো পাকা রাস্তা করে দিলাম, সেটা কিন্তু একমাত্র সূচক নয়৷ যে অর্থে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, গ্রামগুলি জাগানো- এটা হলো গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষের সমতা বাড়ানো৷ এটাই আমার চাওয়া৷
বিদায়ী বছরের কোন পরিবর্তনটা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়?
বিদায়ী বছরে তো কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ একেবারে শেষে নির্বাচন হয়েছে৷ এর আগে দুটো বিষয় একটু বলে নিই৷ আমাদের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট যেটা হয়েছে, তার অপব্যবহার বছরের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে৷ এটা আমার কাছে একটা হতাশার জায়গা৷ মুক্ত চিন্তা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতা আমরা জাতি হিসেবে মেনে নিতে পারি না৷ যে জাতি মুক্তিযুদ্ধে এত প্রাণ দিয়েছে সেই জাতির মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, তা তো হতে পারে না৷ তবে যে পরিবর্তনটা হয়েছে সেটা হলো তরুণদের মধ্যে একটা উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে৷ কিছুদিন আগে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে যে তরুণরা রাস্তায় নামলো, সেখানে তো বছরের শ্রেষ্ঠ স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে'৷ এখানে আমি একটা বিরাট পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি৷ যাঁদের আমরা ভাবতাম, বিশেষ করে শহুরে তরুণদের, যে তাঁরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের মধ্যে ঢুকে থাকে, মাঠে যায় না, যদিও মাঠ পাবে কোথায়? কম্পিউটার গেম খেলে, এদের মাথায় আর কিছু নেই৷ সেই তরুণরাই যে সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করতে পারে, সে তো অবিশ্বাস্য৷ এবার দুই দলেরই প্রার্থী তালিকাতেই আমরা একটা পরিবর্তন দেখেছি৷ তারা কিন্তু একটা বার্তা দিচ্ছে৷ যেমন ধরেন, মাশরাফি বিন মোর্তজার প্রচারের সময় তিনি তো চূড়ান্ত পরিবর্তনের সূচনা করেছেন৷ নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি প্রতিপক্ষদের যে সম্মান দেখিয়েছেন, সেটি আমার কাছে উদাহরণমূলক মনে হয়েছে৷ এটা সবারই শেখা উচিত৷ রাজনীতিতে তরুণদের জায়গাটা শেখ হাসিনা খুলে দিয়েছেন৷ আমার তো মনে হয় আগামী দশ বা পনের বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন হবে৷
বছর শুরুতে একজন রাজনীতিবিদ বিদায় নিয়েছেন, তিনি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম৷
আমার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল৷ আমি তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলাম৷ একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন৷ তাঁর আরো ১০-১৫ বছর কমপক্ষে বেঁচে থাকা উচিত ছিল৷ এই সরকারকে গতিশীল নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে প্রয়োজন ছিল৷ তাঁকে দেখে শেখার আছে৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানো হচ্ছে, তাতে করে অন্য নেতৃত্বের কাছে আমরা আশা করব যে, তাঁরা ইতিহাসে একটা ফুটনোট হয়ে না থেকে মানুষের মর্যাদার আসনে জায়গা করে নেবেন৷
নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী হবে?
আমি খুব মাথাভারী সরকার চাই না৷ সবাইকে স্থান দিতে গিয়ে বড়-সড় মন্ত্রীসভা হোক, তা আমরা দেখতে চাই না৷ আমি চাই মন্ত্রীসভা ছোট কিন্তু গতিশীল এবং কর্মময় হোক৷ ৫০-৬০ জনের একটা মন্ত্রীসভা করলে তাতে বার্তাটি পৌঁছে যে, আমরা সবাইকে নিয়ে চলতে চাচ্ছি, যাঁরা যোগ্য না তাঁদেরও দিতে হচ্ছে, কারণ, তাঁরা দলের মধ্যে আছেন৷ এটার দরকার নেই৷
সরকারের সামনে নতুন বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী হতে পারে?
আমি মনে করি, সরকারের সামনে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে৷ প্রথমত, সরকারের এখন বিরোধী দল বলে কিছু নেই৷ কিন্তু বিরোধী দল না থাকলেই যে আত্মসমালোচনা বা আত্মশুদ্ধির পথ বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা নয়৷ আমি কিন্তু খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছি প্রধানমন্ত্রীর একটা বক্তব্যে৷ সেখানে তিনি বলেছেন, আপনারা দৈত্য হবেন না৷ এটা তিনি নবনির্বাচিত এমপিদের বলেছেন৷ দ্বিতীয়ত হচ্ছে বিরোধী দল বলে যা-ই আছে বা যা-ই থাকুক না কেন, আমি শুধু বলছি জামায়াতে ইসলামের কথা, তাদের বাদ দিতে হবে৷ যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে, তাদের বাদ দিতে হবে৷ একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র হতে হবে৷ প্রগতিশীল রাজনীতি থাকতে হবে৷ পাশাপাশি দুই নম্বর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসন৷ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দুর্নীতি কমাতে শূন্য সহনশীল মাত্রা নেবেন৷ এটা শুধু কাগজে-কলমে রাখলে হবে না৷ এটা রাজনৈতিক বিশ্বাস হিসেবে প্রতিফলিত করতে হবে৷ যেসব সহযোগী সংস্থা এ লক্ষ্যে কাজ করছে, যেমন টিআইবিসহ যারা আছে, সরকারের উচিত তাদের সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি নির্মূলে কাজ করা৷ প্রত্যেক মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারি চাকরি যাঁরা করেন, তাঁদের সকলের সম্পদের হিসাব নিতে হবে৷ আবার সরকারি কর্মচারীদের ধরা যাবে না, এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে৷ দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার জন্য সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে৷ আমি তো মনে করি, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ৮ থেকে ১০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে তিনি নিয়ে যাবেন৷ সেই সম্ভাবনা বা সেই সমতা আমাদের আছে৷ আমাদের সমাজে পুরুষ- নারীর বিভাজন তৈরি হয়ে আছে৷ সেটা দূর করে যাতে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী, ২০২১ সালে আমাদের সুবর্ণজয়ন্তী এবং একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী- সবগুলো উৎসব যেন আমরা সবাই মিলে একত্রে করতে পারি, সেটা করতে হবে৷
বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের নতুন সরকারের কী করা উচিত?
প্রথমত শিক্ষার মান নিশ্চিত করা প্রয়োজন৷ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব তখনই তৈরি হয়, যখন আমাদের দক্ষতা আমরা অর্জন করতে পারি৷ আমাদের শিক্ষাতে সেই দক্ষতা অনুপস্থিত৷ ভাষায় দক্ষতার অভাব, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের অভাব, এগুলোতে আমরা নিম্নপর্যায়ে আছি৷ ফলে ভারতীয় ব্যবস্থাপক নিয়ে আসতে হয় আমাদের গার্মেন্টস বা ওষুধ শিল্পের শূন্যস্থান পূরণ করতে৷ শূন্য কেন? কারণ সেগুলো দাবি করার মতন যোগ্যতাসম্পন্ন আমাদের দেশীয় জনশক্তি তৈরি করতে পারিনি৷ এগুলো অর্জনের প্রধান উপাদান হচ্ছে শিক্ষা৷ তারপর জীবন রক্ষা, আর্থসামাজিক কৌশল এবং এগুলো মিলিয়ে সবকিছুই নিশ্চিত করতে হবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷