জার্মান সামরিক বাহিনী ‘বুন্ডেসভের'-এর সরঞ্জাম সেকেলে বলে সমালোচনা আছে৷ তবে এবার তারা নতুন অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জামের জন্য কোটি কোটি ইউরো ব্যয় করতে চায়৷ ইসরায়েলের কাছ থেকে জঙ্গি ড্রোন লিজ নেওয়ার পরিকল্পনাও আছে তাদের৷
বিজ্ঞাপন
জার্মান সামরিক বাহিনীর সাজসরঞ্জাম মান্ধাতার আমলের– এই সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন কেনা প্রয়োজন এমন সরঞ্জামের লম্বা এক তালিকা সরকারের কাছে পেশ করেছেন৷
জার্মানির দু'টি সংবাদপত্র ফন ডেয়ার লাইয়েনের সেই ফর্দের কপি সংগ্রহ করেছে৷ দৃশ্যত ফন ডেয়ার লাইয়েন ১৮টি পৃথক পৃথক আইটেমের জন্য ৪৫ কোটি ইউরো বরাদ্দের অনুরোধ করেছেন৷বুন্ডেসভের শীঘ্রইজার্মান সংসদের কাছে এই তালিকা পেশ করবে বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন৷
প্রার্থিত বরাদ্দের একাংশ যাবে জার্মানির পুমা ট্যাংকগুলির আধুনিকীকরণে ও এনএইচ৯০ হেলিকপ্টারগুলির রক্ষণাবেক্ষণে৷ এছাড়া ইসরায়েলের ‘হেরন টিপি' ড্রোনের একাধিক নমুনা নয় বছরের জন্য লিজ করা হবে৷ এই ড্রোনগুলিতে সমরাস্ত্র বহণ করতে পারে৷ গোটা লিজে খরচ পড়বে প্রায় ১০০ কোটি ইউরো৷
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
গত মার্চ মাসে রক্ষণশীল সিডিইউ-সিএসইউ ও সামাজিক গণতন্ত্রী এসপিডি দলের মধ্যে জোট সরকার গঠন সম্পর্কে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে নির্দিষ্ট করা আছে যে, ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ইউনিয়নের আঙ্গিকে একটি ইউরোপীয় ড্রোন সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত মধ্যকালীন সমাধান হিসেবে ইসরায়েলি ড্রোন লিজ করা যাবে৷
জোট সরকার গঠন সংক্রান্ত চুক্তিতে জার্মান সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য ১,০০০ কোটি ইউরো বিনিয়োগের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে৷ তবে ঐ অর্থ পর্যাপ্ত হবে বলে ফন ডেয়ার লাইয়েন মনে করেন না৷ তাঁর সাম্প্রতিক বরাদ্দের আবেদন ২০১৮ সালের সরকারি বাজেট পেশ করার সময় অনুমোদিত হতে হবে৷
এ বছরের গোড়ার দিকে জার্মান সামরিক বাহিনীর একটি অভ্যন্তরীণ মেমো ফাঁস হয়৷ সেই মেমোর ভিত্তিতে সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন ওঠে, বুন্ডেসভের তার বিভিন্ন কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম কিনা – বিরোধীপক্ষ এই পরিস্থিতিকে ‘কেলেংকারি' বলে অভিহিত করে৷
২০১৭ সালে জার্মানি প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় ৩,৭০০ কোটি ইউরো ব্যয় করেছে, যা কিনা বিশ্বের নবম বৃহত্তম প্রতিরক্ষা বাজেট৷ ২০১৮ সালে ঐ বাজেট বেড়ে ৩,৯০০ কোটি ইউরো হবার কথা৷ তা সত্ত্বেও ন্যাটো যে তার সদস্য দেশগুলির কাছ থেকে প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির দুই শতাংশ ব্যয় প্রত্যাশা করে থাকে, জার্মান সামরিক বাহিনী তার ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারবে না৷
জার্মান সেনাবাহিনীর যত কেলেঙ্কারি
জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতে, ২০১৭ সাল ভয়ঙ্কর, বিভৎস, ভয়াবহ এবং খারাপ বছর৷ নিজের সেনাবাহিনীকে সমর্থন না করে বরং তাদের কেলেঙ্কারি তুলে ধরে ক্ষোভের মুখে পড়েছেন তিনি৷ জেনে নিন জার্মান সেনাবাহিনীর কেলেঙ্কারির কথা৷
ছবি: picture alliance/akg-images
এক ভুয়া শরণার্থী
সিরীয় শরণার্থী সেজে এক জার্মান সেনা কর্মকর্তা সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল৷ সমান্তরাল এক দ্বিতীয় জীবন শুরু করেছিলেন ফ্রাংকো৷ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সিরীয় শরণার্থী হিসেবে নথিভুক্ত হন তিনি৷ তার লক্ষ্য ছিল শরণার্থীদের উপর হামলার দোষ চাপানো৷ ২০১৪ সাল থেকেই ফ্রাংকো’র ডানপন্থি আচরণের কথা জানতেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা৷ এাই ফ্রাংকো ধরা পড়ার থেকে জার্মান সেনাবাহিনিকে শুরু হয় বিতর্ক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Rumpenhorst
বাড রাইশেনহাল পর্বতে রেঞ্জার ইউনিটে হয়রানি
ডানপন্থি সন্ত্রাসী আচরণের অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য সেনাবাহিনী বর্তমানে ২৭৫ টি মামলার তদন্ত করছে৷ চলতি বছরের মার্চে জনগণ একজন ল্যান্স করপোরালের কথা জানতে পারেন, যিনি কয়েক মাস ধরে বাভেরিয়া পর্বতের রেঞ্জার ইউনিটে হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতিত ব্যক্তি জানিয়েছেন, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে যৌন নীপিড়ন করা হয়েছে৷ এ ঘটনার জন্য ১৪ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
নারীদের পোল ড্যান্সে বাধ্য করা
প্রতিরক্ষামন্ত্রী সবচেয়ে বড় যে কেলেঙ্কারির কথা বলেছেন তাহলো, ফুলেনডর্ফে স্টাওফের সেনাঘাঁটির ভয়াবহ ঘটনা৷ জানুয়ারিতে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের নগ্ন করা ও যৌনতা প্রকাশ পায় এমন আচরণ করতে বাধ্য করেছিলেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, সেগুলো ভিডিও করা হয়েছিল৷ সদ্য নিয়োগ পাওয়া নারীদের ‘এনট্র্যান্স পরীক্ষা’র অংশ হিসেবে পোল ড্যান্সে বাধ্য করা হয়েছিল৷ একারণে সেনাবাহিনীর শীর্ষ প্রশিক্ষক কমান্ডারকে বরখাস্ত করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Warnack
ডানপন্থি সন্ত্রাসবাদের অনেক ঘটনার তদন্ত চলছে
জার্মান সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি কমিশনারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সাল জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য মোটেই ভালো বছর ছিল না৷ ডানপন্থি সন্ত্রাসবাদ বা ‘জার্মানির মুক্ত গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক চেতনার লঙ্ঘন’ এর মোট ৬০টি অভিযোগের ঘটনা পাওয়া গেছে৷ এমনকি সেনারা নিজেদের নাৎসি চেতনা নিয়ে একে অপরের সাথে আলোচনা করে, নাৎসি সংগীত শোনে ও নাৎসি স্যালুটও দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Sauer
জাহাজে মৃত্যু
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে কোনো মাথা ঘামায়নি সেনাবাহিনী৷ ২০১০ সালের একটি ঘটনা জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তা হলো, গর্ক ফক-এ নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের সময় ২৫ বছরের এক সদস্যের মৃত্যুর ঘটনা৷ প্রশিক্ষণের সময় ঐ নারী জাহাজের পাল থেকে নীচে পড়ে মারা যান৷ ফলে অন্যান্য ক্যাডেটরা পালে উঠতে আর রাজি হননি৷ পরে ঐ প্রশিক্ষণ বাতিল করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Rehder
জার্মান সেনাবাহিনীর জন্ম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে ছিল না৷ পশ্চিম জার্মানিতে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে৷ পুনরেকত্রীকরণের পর পূর্ব জামানির সেনাবাহিনী থেকে ২০ হাজার সদস্য নেয় কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী৷ ১৯৯৯ সালে যখন জার্মান সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক সংঘাতে (কসোভো যুদ্ধ) জড়িয়ে পড়ে, তখন এতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়৷ এর আগ পর্যন্ত কেবল বিদেশে শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অংশগ্রহণ ছিল৷
ছবি: picture alliance/akg-images
বাধ্যতামূলক সেবা নয়
বর্তমানে জার্মান সেনাবাহিনীতে সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৭৮ হাজার ২০০৷ ২০১৭ সালের মার্চের হিসেব অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর মোট সদস্যের ১১.৪ শতাংশ নারী৷ ২০১১ সাল পর্যন্ত জার্মান সেনাবাহিনীতে পুরুষদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল৷ এই মেয়াদকাল ছিল ৯ থেকে ১৮ মাস৷ বর্তমানে তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়৷ তবে সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারির কারণে এই আবেদনে তাদের সাড়া দেয়াটা সত্যিই কঠিন৷