মথের পাখা ঝাপটানো, পিঁপড়ার হাঁটা, শামুকের যাওয়ার দাগ বা প্রজাপতির পাখা থেকে মানুষ, পতঙ্গ ও প্রকৃতির বিবর্তনের বিমূর্ত ছবি আঁকেন মাক্সিমিলিয়ান প্র্যুফার৷ প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা থেকে জন্ম নিয়েছে তাঁর শিল্প ও জীবনদর্শন৷
বিজ্ঞাপন
ইংরেজি নাম ‘মথ’, প্রজাপতিরই জাতভাই৷ তারা পাখা নেড়ে নেড়ে ছবি সৃষ্টি করে৷
মথ বস্তুত চাঁদের আলোয় পথ চেনে৷ এখানে তারা ইলেকট্রিকের বাতিকে চাঁদ ভেবে তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে৷
একটি পতঙ্গের ভ্রম বা ভ্রান্তির ছবিটি ধরে রেখেছেন শিল্পী মাক্সিমিলিয়ান প্র্যুফার৷
মাক্সিমিলিয়ান বললেন: ‘‘ভাবুন, যেন কাগজের উপর একটা মিহি স্তর পাতা রয়েছে, পোকাদের প্রতি নড়াচড়ায় যা সরে গিয়ে কাগজের আসল রংটা বেরিয়ে পড়ছে৷ এবং এই স্তরটা এতোই সংবেদনশীল যে, একটি পিঁপড়ার পায়ের দাগও ফুটিয়ে তোলা যায়৷ এমনকি আমার মাথার একটা চুলও যদি ঐ কাগজের ওপর পড়ে, তাহলে তার ছাপ থেকে যায়৷’’
প্রজাপতি সব কোথায় গেল?
প্রজাপতি কার না পছন্দ? সুন্দর এই প্রাণী কাউকে কামড়ায়ও না, হুলও ফুটায় না৷ কিন্তু গত কয়েক দশকে পৃথিবীতে নাটকীয়ভাবে কমেছে প্রজাপতির সংখ্যা৷ কারণগুলো আরো কষ্টদায়ক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Schmitt
বিলুপ্তির পথে প্রজাপতি
পৃথিবীজুড়েই হুমকির মুখে প্রজাপতি৷ জার্মান ওয়াইল্ড লাইফ অ্যানিমেল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী গত ৩০ বছরে শুধু জার্মানিতেই প্রজাপতি এবং মথের প্রজাতির সংখ্যা অর্ধেক হয়েছে৷ দিনের বেলায় যেসব প্রজাপতি বাইরে বের হয়, তাদের সংখ্যা কমেছে ৭০ শতাংশ৷ ছবিতে কলিয়াস হ্যালে নামের এক প্রজাতির প্রজাপতি দেখা যাচ্ছে৷ ২০১৭ সালের জার্মানির বর্ষসেরা প্রজাপতি হয় এই প্রজাতি৷
ছবি: picture alliance /Nothegger, A./WILDLIFE
মিষ্টি রস
ফুল থেকে মিষ্টি রস খেতে ভালোবাসে প্রজাপতি৷ কিন্তু উদ্ভিদের বৈচিত্র্যও ধীরে ধীরে কমছে৷ বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ ধরনের ফসল উৎপাদনের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে৷ ফলে প্রজাপতির খাদ্যাভাসেও আসছে পরিবর্তন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Weihrauch
কীটনাশকের থাবা
শস্য রক্ষা করতে গিয়ে জোর দেয়া হচ্ছে নানা ধরনের কীটনাশক, আগাছানাশকের ওপর৷ এতে ফসলের উৎপাদন সাময়িকভাবে বাড়ছে ঠিকই৷ কিন্তু জমি এবং স্বাস্থ্যের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির আশংকা থেকেই যাচ্ছে৷ বিভিন্ন উদ্ভিদে কৃত্রিম এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ, প্রজাপতিকেও করছে বিপন্ন৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/S. Ott
পতঙ্গরাজ্যে হাহাকার
শুধু প্রজাপতি না, জমিতে রাসায়নিক ব্যবহারে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো কীটপতঙ্গের রাজ্যই৷ গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু কিছু এলাকায় ৩০ বছর আগের তুলনায় পোকামাকড়ের সংখ্যা কমেছে ৮০ শতাংশ৷ এর মধ্যে আছে মৌমাছি, ভোমরা, ফড়িং, বোলতা এবং মাছিও৷ যারা বেঁচে আছে, তারাও চালিয়ে যাচ্ছে অস্তিত্বের লড়াই৷
ছবি: picture-alliance/K. Nowottnick
খাদ্যচক্রে অস্থিরতা
পোকামাকড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে পাখিদের ওপরও৷ জার্মানির কোনো কোনো এলাকায় ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পাখির সংখ্যা কমে গেছে ৮০ শতাংশ৷
স্বাভাবিক ধারণা বলে, শহরের তুলনায় গ্রামে প্রকৃতির পরিমাণ বেশিই হবে৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে জার্মানির শহরগুলিতে প্রজাপতির সংখ্যা গ্রামের তুলনায় বেশি৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামে কৃষিকাজে জোর দিতে গিয়ে কমছে উদ্ভিদের বৈচিত্র্য৷ অন্যদিকে, শহরের পার্ক, বাসাবাড়ির বাগান, এমনকি কবরস্থানেও নানা ধরনের উদ্ভিদ থাকায়, এদিকেই আকৃষ্ট হচ্ছে আরো বেশি সংখ্যক প্রজাপতি৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images/L. Werle
6 ছবি1 | 6
পিঁপড়ারা দু'টি গোল টিনের বাক্সে ঘুরে চলেছে; নীচে ডানদিকে কিছু পিঁপড়া পালাতে সমর্থ হয়েছে৷
একটি ঢাকনার ওপর শামুকদের ছবি: শামুকের যাত্রাপথ দেখে আমরা কি কিছু বুঝতে পারি? একটি শামুক কোন পথে যায়? গোটা দলটাই বা চলে কীভাবে? তাদের যাওয়ার পথ কি বদলানো যায়? খুব সোজা: পাতটাকে একটু ঢালু করে ধরলেই শামুকরা সেদিকে যাবে৷
মাক্সিমিলিয়ান বললেন, ‘‘এটা হলো এমন একটা মৌলিক নীতি, যা সব জীব বিবর্তন থেকে শিখে গিয়েছে: আমরা সকলেই যতটা সম্ভব কম শক্তি খরচ করতে চাই, সবচেয়ে সোজা পথটা নিতে চাই; শামুকরাও তাই করে৷ এভাবে শামুকদের কোনো একটা দিকে পাঠানো সম্ভব৷’’
মাক্সিমিলিয়ান প্র্যুফার যে জীবগুলিকে নিয়ে কাজ করেন, তাদের স্বভাবতই মানুষের প্রতিনিধি বলেও ধরে নেওয়া যেতে পারে৷ তাঁর মতে, আমরা মানুষরাও সর্বাগ্রে প্রকৃতির অঙ্গ – নিজেদের সৃষ্ট একটি কৃত্রিম জগতে বাস করার ফলে যা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই৷
মাক্সিমিলিয়ান প্রধানত মুক্ত প্রকৃতিতে কাজ করেন; শুধু শীতের অধিকাংশ সময়টা আউগ্সবুর্গে তাঁর নিজের স্টুডিওয় কাটান৷
রুশ উলকি শিল্পী ক্ষত ঢাকতে প্রজাপতি আঁকেন
রাশিয়ায় পারিবারিক সহিংসতা একটি ব্যাপক সমস্যা; এমনকি সম্প্রতি কয়েক ধরনের নিপীড়নকে অপরাধ নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে৷ উলকি শিল্পী ইয়েভগেনিয়া জাখার নিপীড়িত মহিলাদের তাদের ক্ষত ঢাকতে সাহায্য করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Braydov
ক্ষত ঢাকতে উলকি
রুশ সংসদের নিম্নকক্ষ ‘দুমা’-য় একটি বিতর্কিত আইন পাশ হয়েছে, লোকমুখে যার নাম ‘চড় মারার আইন’৷ এই আইন অনুযায়ী কোনো পুরুষ যদি তার স্ত্রীকে মারধোর করে, কিন্তু তার ফলে শুধু কালশিটে পড়ে অথবা ছড়ে যায়, তাহলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য করা হবে না৷ উলকি শিল্পী ইয়েভগেনিয়া জাখার নিপীড়িত মহিলাদের ঠিক এ ধরনের ‘লজ্জা’ ঢাকতে সাহায্য করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Braydov
মক্কেলদের কাহিনি শোনাটাও ইয়েভগেনিয়ার কাজ
গতবছর ইয়েভগেনিয়া তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পেজে একটি ঘোষণা পোস্ট করেন: তিনি নিপীড়িত মহিলাদের বিনা খরচায় উলকি করে দেবেন৷ ইয়েভগেনিয়া ধারণাটি পান ব্রাজিলের এক উলকি শিল্পীর কাছ থেকে৷ শীঘ্রই ইয়েভগেনিয়ার কাছে অসংখ্য অনুরোধ আসতে শুরু করে৷ কিন্তু এই সব নিপীড়িতাদের কাহিনি শোনা ইয়েভগেনিয়ার পক্ষে এতই বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে যে, তিনি এখন সপ্তাহে একজনের বেশি এ ধরনের মক্কেল নেন না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Braydov
দ্বিতীয়বার যন্ত্রণা
পেটে উলকি করার সময় গুলদার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠেন৷ ইয়েভগেনিয়া বলেন, ‘‘আমি এতো মক্কেল আসবে বলে মনে করিনি৷ দিনে দুই থেকে চারজন মহিলাকে উলকি করতে হয়েছে৷ সমস্যাটা যে কত ব্যাপক, তা দেখলে আর এই সব মহিলাদের কাহিনি শুনলে রীতিমতো ভয় করে৷’’ ইয়েভগেনিয়ার বাস মস্কো থেকে ১,২০০ কিলোমিটার দূরে, উফা শহরে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Braydov
প্রতি বছর হাজার হাজার মহিলার নিপীড়নে মৃত্যু
রাশিয়ায় পারিবারিক সহিংসতা একটি পুরনো সমস্যা৷ ৪০ শতাংশ সহিংসতার ঘটনা পরিবারের অভ্যন্তরে ঘটে, বলে পুলিশের ধারণা৷ শুধুমাত্র ২০১৩ সালে প্রায় ৯,১০০ রুশি মহিলা পারিবারিক সহিংসতার কারণে প্রাণ হারান, আহত হন আরো ১১,৩০০ মহিলা – বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার আইনজীবী আনা রিভিনা৷ তিনি ‘নাসিলিয়ু.নেট’ (‘নো টু ভায়োলেন্স’) প্রকল্পটির প্রধান৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Braydov
নিপীড়নের চিহ্ন
ইয়েভগেনিয়া তাঁর মক্কেল লিলিয়া-র চোটের দাগগুলো দেখালেন৷ মহিলারা নাকি তাদের নিপীড়নের চিহ্ন ঢাকার জন্য প্রজাপতি বা ফুলের উলকি পছন্দ করেন৷ তারা তাদের নিপীড়নের কাহিনি শোনান উলকি শিল্পীকে৷ নিপীড়নের চিহ্নকে তাদের নিজের পছন্দের কিছু একটায় পরিণত করতে পেরে তাদের আত্মমর্যাদাবোধ বাড়ে, নিপীড়নের অবমাননা ভুলতে সাহায্য করে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Braydov
পুলিশের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাবার উপায় নেই
ইয়েভগেনিয়া এক মক্কেলকে জড়িয়ে ধরলেন....এ পর্যন্ত তিনি এক হাজারের বেশি মহিলাকে বিনা খরচায় উলকি করেছেন৷ তাদের মধ্যে একজনও পুলিশের কাছ থেকে সাহায্য পাবার কথা বলেনি৷ ‘‘মেয়েরা শেষবারের মতো তাদের ক্ষত সম্পর্কে কথা বলতে চায় – কেননা এর পরে তারা শুধু তাদের সুন্দর উলকিটার কথা বলবে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Braydov
6 ছবি1 | 6
বিবর্তনের বিমূর্ত ছবি
মাক্সিমিলিয়ানের কাছে প্রকৃতি কোনো রোম্যান্টিক ব্যাপার নয়, বরং ঘড়ির কাঁটার মতো বিভিন্ন যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নিয়মে চলে, ছেলেবেলাতেই যা তাঁকে মুগ্ধ করেছে৷
প্রজাপতিগুলি কোনো পুরনো সংগ্রহের অঙ্গ – মাক্সিমিলিয়ান এগুলো কিনে নিয়েছেন অথবা উপহার হিসেবে পেয়েছেন৷ নয়ত তিনি কোনো জীবের কোনো ক্ষতি করতে চান না – তাঁর কাছে সেটা খুবই জরুরি৷
প্রজাপতির পাখা দিয়ে শিল্পকলা একটু খেলো শোনাতে পারে৷ কিন্তু মাক্সিমিলিয়ান প্র্যুফারের কাছে নয় – কেননা ছবির পিছনে রয়েছে তাঁর চিন্তা৷
মাক্সিমিলিয়ান বলেন, ‘‘যে ছবি এককালে একটি জীবন্ত প্রজাপতির পাখায় ছিল, তা আজ একটি প্রতিলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অথচ ছবিটার না আছে কোনো শিল্পী, না কোনো কপিরাইট৷ সাড়ে তেরো কোটি বছরের বিকাশধারার কাহিনি একটি ছবিতে ধরা আছে, যেন বিবর্তনের কোনো বিমূর্ত ছবি৷’’
কে আমাদের চালায়? ইচ্ছাশক্তি, কল্পনাশক্তি, নাকি অবচেতন মন? মাক্সিমিলিয়ান প্র্যুফারের ছবিতে যেন তারই কিছু উত্তর লুকিয়ে রয়েছে – দুর্বোধ্য, পড়া যায়, কিন্তু বোঝা যায় না৷