মঙ্গলবার পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে সাবেক ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের।
বিজ্ঞাপন
দিল্লির লোদী রোডে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। তার আগে সকালে তাঁর মরদেহ রাখা হয়েছে রাজাজি মার্গের বাসভবনে। সেখানে বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
সোমবার ৮৪ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুর এক মাস আগেও বাড়িতে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। আলোচনা করেছেন বিবিধ বিষয়ে। তবে করোনা লকডাউন শুরু হওয়ার পরে আর বাড়ি থেকে বেরোননি। বাড়িতেই বাথরুমে পড়ে যান তিনি। সেনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে দেখা যায়, তাঁর মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে। সফল অস্ত্রপচারও হয়। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর করোনা ধরা পড়ে। প্রায় ২১ দিন হাসপাতালে থাকার পর সোমবার তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রণব মুখোপাধ্যায়: কীর্ণাহার থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন
বীরভূমে কীর্ণাহার গ্রামে জন্ম প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। সেখান থেকে ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হওয়ার কাহিনি চমকপ্রদ।
ছবি: AP
শুরু বাংলা কংগ্রেসে
প্রণববাবুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু কংগ্রসে নয়। অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেস থেকে। ১৯৬৯ সালে বাম সমর্থিত বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে তাঁর রাজ্যসভায় প্রবেশ। কিছুদিনের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়ে যান। বাংলাদেশ যুদ্ধের পর থেকে তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের শুরু।
ছবি: Reuters
মন্ত্রী প্রণব
রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার চার বছরের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হলেন প্রণব। ১৯৭৩ সালে তিনি শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রকের ডেপুটি মিনিস্টার বা উপ মন্ত্রী হন। এরপর ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু পর্যন্ত প্রণববাবু রাজনীতিতে দ্রুত উঠে এসেছেন৷
ছবি: UNI
ইন্দিরা গান্ধীর অর্থমন্ত্রী
জরুরি অবস্থার সময়েও মন্ত্রী ছিলেন প্রণব। পরে '৭৭ সালে জরুরি অবস্থা তোলার পরে অনেক কংগ্রেস নেতা দল ছেড়েছিলেন। কিন্তু দুঃসময়ে ইন্দিরার পাশে ছিলেন প্রণব। আবার ইন্দিরা ক্ষমতায় এলেন ১৯৮০তে। দুই বছর পরে ১৯৮২ সালে প্রণববাবু পেলেন অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব। ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভায় অঘোষিত দুই নম্বর স্থানে চলে এলেন প্রণব।
ছবি: UNI
তুখোড় রাজনৈতিক বুদ্ধি
প্রণববাবু জননেতা ছিলেন না। দীর্ঘদিনের সাংসদ, জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান নেতা হলেও পশ্চিমবঙ্গে আমজনতার মধ্যে প্রণববাবুর যে ভয়ঙ্কর জনপ্রিয়তা ছিল তা নয়। জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সাফল্যের পিছনে ছিল তুখোড় রাজনৈতিক বুদ্ধি, ঠিক পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা, সংবিধান, সংসদীয় রীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান এবং যে কোনো সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার কৌশল ঠিক করার ক্ষমতা।
ছবি: AP
ক্ষমতার বাইরে
দেহরক্ষীদের গুলিতে মারা গেলেন ইন্দিরা গান্ধী। রাজীব গান্ধী তখন পশ্চিমবঙ্গ সফর করছেন। দিল্লি ফেরার সময় বিমানে প্রণবের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এরপর কার প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত? তাঁর জবাব ছিল, অতীতে দুই বারই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর সব চেয়ে প্রবীণ মন্ত্রী হয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে রাজীবেরই হওয়া উচিত। কংগ্রেসে গুঞ্জন উঠল, প্রণববাবু প্রধানমন্ত্রী হতে চান। পরে রাজীবের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হলো না তাঁর।
ছবি: AP
নিজের দল গড়লেন
রাজীব গান্ধীর আমলে কংগ্রেসে অবহেলিত হলেন প্রণববাবু। প্রথমে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ পড়লেন। তারপর তাঁকে ছয় বছরের জন্য দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। নিজের দল গড়লেন প্রণব। রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। পরে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দল খুব খারাপ ফল করল। প্রণব তো জননেতা ছিলেন না। তাঁর জোরের জায়গা ছিল প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধি।
ছবি: AP
আবার কংগ্রেসে
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আবার কংগ্রেসে ফেরা ১৯৮৮ সালে। তখন বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজীব কোণঠাসা। সে সময় আবার প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজীব গান্ধীর সম্পর্ক ভালো হলো। তিনি দলে ফিরলেন। ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনের দায়িত্ব পেলেন এবং দলকে জেতালেন।
ছবি: DW
এ বার বিদেশমন্ত্রী
নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হলেন ১৯৯১ সালে। তিনি প্রণববাবুকে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান করলেন। পরে তিনি মন্ত্রিসভায় নিলেন প্রণববাবুকে। ১৯৯৫ সালে প্রণববাবু বিদেশমন্ত্রী হলেন।
ছবি: UNI
ইউপিএ-র কান্ডারী
ইউপিএ আমলে আবার ক্ষমতার শিখরে প্রণব মুখোপাধ্যায়। মনমোহন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভায় আবার দুই নম্বর ব্যক্তি প্রণব। সরকারে বা দলে সমস্যা হলেই ভরসা প্রণব। একগুচ্ছ মন্ত্রিগোষ্ঠীর প্রধান। বামেদের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী। আন্না হাজারে থেকে রামদেবকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের দায়িত্বে। আর ২০০৪ সালে প্রথমবারের জন্য লোকসভায় জিতে আসতে পারলেন প্রণববাবু।
ছবি: AP
প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি
২০১২ সালে প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হয়ে রাইসিনা হিলসের প্রসাদোপম রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করেলন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন কপি বুক রাষ্ট্রপতি। পাঁচ বছর ধরে রাষ্ট্রপতি থেকেছেন বিতর্কহীন হয়ে। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। মনমোহন বিদায় নিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী এসেছেন। কিন্তু প্রণবের সঙ্গে সকলেরই সম্পর্ক ছিল অসাধারণ। পরে তাঁকে ভারতরত্নে সম্মানিত করেন মোদী।
ছবি: picture alliance/Photoshot/Bi Xiaoyang
আরএসএসের অনুষ্ঠানে
তিনি বরাবর সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শের সমালোচনা করে এসেছেন। কিন্তু সেই প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আরএসএসের অনুষ্ঠানে দেখা যাওয়ায় কংগ্রেসিরা অবাক হয়েছিলেন।
ছবি: picture-alliance/AP Photo
রাজনৈতিক যুগের অবসান
প্রণবের চলে যাওয়ার ফলে ভারতে অবসান হলো একটা রাজনৈতিক যুগের। বীরভূমের কীর্ণাহার থেকে এসে দেশের সর্বোচ্চ পদে বসেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর এই উত্থান ভারতীয় গণতন্ত্রের জয়৷
ছবি: UNI
12 ছবি1 | 12
সোমবারই দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিশিষ্টজনেরা প্রণববাবুর স্মৃতিচারণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী টুইট করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের ছবি। মঙ্গলবারও প্রণববাবুর বাস ভবনে দীর্ঘ সময় ছিলেন মোদী। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, সেনার তিন প্রধান, সামরিক বাহিনীর প্রধান বিপিন রাওয়াত প্রণববাবুর বাড়িতে গিয়ে শেষ সম্মান জানান। বিকেলে লোদী রোডে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। উপস্থিত থাকবে সামরিক বাহিনীর সমস্ত ফৌজের জওয়ানরা।
করোনার কারণে গান ক্যারেজে প্রণববাবুর দেহ নিয়ে যাওয়া হবে না। কারণ, করোনার সময়ের রীতি মানতে হবে। তবে বাড়িতে এবং শ্মশানে তাঁর মরদেহ রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সোমবারই দেশ জুড়ে সাত দিনের শোকদিবসের নোটিস জারি করেছিল। মঙ্গলবার থেকে দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।
প্রণববাবুর মৃত্যুর জন্য শোক পালন হচ্ছে বাংলাদেশেও। সেখানেও রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রণববাবুর সম্পর্ক বহুদিনের। হাসিনা যখন দিল্লিতে ছিলেন তখন প্রণববাবুর গোটা পরিবারের সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৭১ এর যুদ্ধেও ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।