রাশিয়াকে দুই দশক ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভ্লাদিমির পুটিন৷ রাশিয়ানরা নানা সংকটে সরকারের ঘাড়ে দায় দিলেও প্রেসিডেন্ট রাখতেন প্রশ্নের ঊর্ধে৷ ঘরোয়া রাজনীতির নতুন হাওয়ায় বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট৷ তবে কি শেষ হতে যাচ্ছে পুটিন অধ্যায়?
বিজ্ঞাপন
১৯৯৯ সালের ৯ আগস্ট রাশিয়ার রাজনীতির মসনদে আসেন পুটিন৷ তখন তিনি নিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব৷ বরিস ইয়েলৎসিনের এই উত্তরসূরি রাজনীতির মাঠের তখন নবাগত৷ টানা চার মেয়াদে দেশটির শীর্ষস্থান ধরে রেখে রাজনীতির মাঠে নিজেক ধরা-ছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছেন পুটিন৷ জনমত অন্তত তাই বলে৷
রাশিয়ার একটি জনপ্রিয় কথা এরকম যে, রাজা ভাল, খারাপ হলো তার পরিষদ৷ এই ‘মিথ' চ্যালেঞ্জ করে ২০১৮ সালে বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে পুটিন বলেছেন, ‘‘কিন্তু আমি বলতে চাই কোনো কিছু ব্যর্থ হলে বা দেশে কোনো সংকট তৈরি হলে, সে দায় সবার৷''
পুটিনের বক্তব্যকে দূরদর্শী বলার সুযোগ আছে৷ কারণ সাম্প্রতিক জরিপগুলোর বলছে তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে নন৷ ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে পুটিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে সরকারের চেয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা ৩৫ শতাংশ বেশি ছিল। রাষ্ট্রীয় জরিপ প্রতিষ্ঠান ভিটিএসআইওএম বলছে, ব্যবধান কমে তা দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে৷ বলা হচ্ছে, পুটিনের প্রতি জনগণের আস্থাও কমেছে৷ যা ২০০৬ সালের এই প্রথম পুটিনের জনপ্রিয়তা ভাটা লেগেছে৷
‘সুপার পাওয়ার রাশিয়া'
পুটিনের জনপ্রিয়তার সঙ্গে রাশিয়ার গৌরব ফিরে পাওয়ার বিষয়টি সংযুক্ত৷ ৯০ দশকের শেষের দিকে ক্ষমতায় আসেন পুটিন৷ তখন রাশিয়ার অবস্থা কিছুটা নড়বড়ে৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে আক্রান্ত হয় দেশটির অর্থনীতি আর তার প্রভাব পড়ে সমাজনীতিতেও৷ রাশিয়ানরা মনে করেছিল, তাঁরা তাঁদের জাতীয় গৌরব হারাতে বসেছে৷
স্বাধীন জরিপ প্রতিষ্ঠান লেভাডা সেন্টারের পরিচালক লেভ গুডকভ বলেন, ‘‘পুটিনের লক্ষ্যই ছিল রাশিয়াকে বিশ্বের বুকে সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর অন্তত রাশিয়ানরা যাতে তাঁদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে পারে সেদিকেই মনোযোগী ছিলেন পুটিন৷'' ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া সংযোজনের পরও পুটিনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷
দায়িত্ব সংকোচন
ঘরোয়া রাজনীতির পরিবর্তনে শুধু পররাষ্ট্র নিয়ে পড়ে থাকার সুযোগ নেই পুটিনের৷ দেখতে হচ্ছে ঘরোয়া বিষয়গুলোও৷ গুডকভ বলেন, একটা সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল ঘরোয়া দায়িত্ব এড়িয়ে চলার কৌশলটি কাজে এসেছে৷ কিন্তু পেনশন সংস্কার আইনে সই করে, অভ্যন্তরীণ দায়িত্বও নিয়েছেন তিনি৷ গেল বছরের সেপ্টেম্বের ডুমায় বিলটি পাশ হয়৷ অক্টোবরের শুরুতে বিলে সই করেন পুটিন৷ কিন্তু এই পদক্ষেপ সারাদেশে বিক্ষোভের জন্ম দেয়৷
বেড়েই চলেছে হতাশা?
পুটিনের জনপ্রিয়তায় ভাটার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন গুডকভ৷ অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বেতন কমানোকে প্রধান কারণ বলছেন এই গবেষক৷ আর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে গুডকভ দায়ি করেছেন ন্যায় বিচারের অভাব আর দুর্নীতিকে৷ তাঁর মতে, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা হলে এবং সামাজিক নীতিতে পরিবর্তন এনে সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণ করা হলে পুটিন আবার ফিরে আসতে পারেন পুরনো রূপে৷
পুতিনের প্রতিদ্বন্দ্বী নাভালনি!
পুতিন বিরোধী আন্দোলনে রাশিয়ার অন্যতম আলোচিত চরিত্র বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনি৷ ২০১৮ সালে দেশটির প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে পুতিনের বিরোধিতা করতে বাধা দেয়া হয় তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/navalny.com
রাজনীতিবিদের মুখ
ছিলেন আইনজীবী৷ হয়েছেন সক্রিয় রাজনীতিক৷ চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন ভ্লাদিমির পুতিনকে৷ ২০০৮ সালের কথা৷ রাশিয়ার রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অপকর্ম নিয়ে ব্লগ লিখে রাতারাতি আলোচনায় আসেন নাভালনি৷ তাঁর লেখা ব্লগের কারণে অনেকেই পদত্যাগ পর্যন্ত করতে বাধ্য হন৷ যা ছিল রাশিয়ার রাজনীতির বিরল দিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/TASS/V. Sharifulin
বিতর্কিত সংসদীয় নির্বাচন
২০১১ সালে প্রথম কারাগারে গেলেন নাভালনি৷ ছিলেন ১৫ দিন৷ অভিযোগ, মস্কোর স্টেট ডুমায় সরকার বিরোধী মিছিল-সমাবেশ৷ পুতিনের ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’ নির্বাচনে জয় পায়৷ কিন্তু ভোট কারচুপির অভিযোগ আনা হয় পুতিনের বিরুদ্ধে৷ কারাগারে রেখেও দমানো যায়নি নাভালনিকে৷ বের হয়ে এসে আবারো চাঙ্গা করেন পুতিন বিরোধী আন্দোলন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Stenin
কারাগের দ্বিতীয় সাময়িক
২০১২ সালে পুননির্বাচিত হলেন পুতিন৷ রাশিয়ার তদন্ত কমিটিকে নির্দেশ দিলেন নাভালনির অতীত খুঁজে বের করতে৷ দ্বিতীয় দফায় কারাগারে গেলেন নাভালনি৷ আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়ে জেল খাটলেন পাঁচ বছর৷ উচ্চ আদালতে শেষ পর্যন্ত মুক্তি দেয় তাঁকে৷
ছবি: Reuters
ক্রেমলিন বিরোধী মঞ্চ
আইনি কিছু ঝামেলায় পড়েও, মস্কোর মেয়র পদে নির্বাচনে অনুমতি পান তিনি৷ ২০১৩ সালের ওই নির্বাচনে নাভালনিকে হার মানতে হয়৷ কারণ, পুতিনের মিত্র সের্গেই সোবানিয়ান বিপুল ভোটে জয় পায়৷ আর বিরোধী রাজনীতি আবারো চাপা পড়ে যায় পুতিন জোয়ারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রাজনীতিকের সামাজিক যোগাযোগ
ক্রেমিলন বিরোধী আন্দোলনের কারণে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে নিষিদ্ধ হন নাভালনি৷ ফলে, নিজের রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দিতে বেছে নিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ব্লগ৷ গুছিয়ে বলতে পারা, ভাষার ব্যবহার, পুতিনকে নিয়ে হাস্যরসত্মাক কথা আর বিনয়-সবমিলিয়ে তরুণদের কাছে তিনি হয়ে যান নতুন কান্ডারি৷
ছবি: Alexei Navalny/Youtube
রাষ্ট্রপতির হওয়ার আকাঙ্ক্ষা
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ঘোষণা দিলেন প্রেসিডন্ট পদে লড়তে চান তিনি৷ ২০১৮ সালের মার্চকে সামনে রেখে শুরু করলেন প্রচারণা৷ এবার দুর্নীতির অভিযোগে পারলেন না কাঙ্ক্ষিত পদে দৌড়াতে৷ যদিও বলা হয়, রাজনৈতিক হয়রানি শিকার হয়েছেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Kudryavtsev
দুর্নীতির দায়
২০১৬ সাল৷ ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আদালত এক রুলে জানায়, কিরভ মামলায় সুবিচার বঞ্চিত হয়েছে নাভালনি৷ রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্টও নাভালনির পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বাতিল করে৷ নথি পাঠিয়ে দেয়া হয় কিরভ আদালতে৷ ২০১৭ সালে আবার তাঁর কারাদণ্ড বাতিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/Sputnik/A. Kudenko
অর্ধযুগে মস্কোর বড় বিক্ষোভ
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি৷ প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের বিলিয়ন-ইউরোর সাম্রাজ্য নিয়ে রিপোর্ট লিখেন নাভালনি৷ সেই ঘটনাকে ঘিরে রাশিয়ার অন্তত ১২টি শহরে শুরু হয় দুর্নীতি বিরোধী মিছিল-সমাবেশ৷ নাভালনিসহ অন্তত হাজারো রাজনৈতিক কর্মীকে সেদিন গ্রেপ্তার করা হয়৷ ২০১১ সালের পর এতো বড় বিক্ষোভ আর দেখেনি মস্কোবাসী৷ ১৫ দিন কারাবাসের পর মুক্তি পায় নাভালনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Evgeny Feldman for Alexey Navalny's campaign
শারীরিক লাঞ্চনা
দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের দুই মাস পর হাসপাতাল ঠিকানা হয় তাঁর৷ নাভালনির মুখে ছোঁড়া হয় সবুজ রঙের রাসায়নিক৷ ডান চোখের কর্নিয়া তাতে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়৷ চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে দেয়া হয়নি তাঁকে৷ কারণ তখনও দুর্নীতির অভিযোগ ঝুলছিল তাঁর গলায়৷ পরে ক্রেমলিনের মানবাধিকার কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে চোখের অপারেশনের জন্য স্পেন যাওয়ার অনুমতি পান নাভালনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Feldman
গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তার
গেল বছরের গোড়ার দিকে এক মাস জেল খেটেছেন নাভালনি৷ তার কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারো গ্রেপ্তার হন তিনি৷ গেল সেপ্টেম্বরে জামিন পান৷ এ বছরের এপ্রিলে, তাঁর পক্ষে রুল জারি করে ইউরোপের মানবাধিকার কোর্ট৷ বলা হয়, কিরভ মামলায় ২০১৪ সাল থেকে এক প্রকার গৃহবন্দি রেখে নাভালনির অধিকার হরণ করেছে রাশিয়া৷
ছবি: Reuters/M. Shemetov
এবার বিষক্রিয়া
১০ দিন জেল খেটে বের হবার পর, সাতদিনও কাটেনি৷ এ বছরের জুলাইতে আবারো গ্রেপ্তার হন তিনি৷ রাশিয়ার কঠোর প্রতিবাদ আইন ভঙ্গের অভিযোগে আবারো ৩০দিনের জন্য জেলে ঢুকলেন তিনি৷ কারাগারে তাঁর শরীরে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ তুলেছেন পুতিন বিরোধী এই রাজনীতিবিদ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/navalny.com
11 ছবি1 | 11
এখনও ‘নাম্বার ওয়ান পুটিন'
অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা আর বেতন নিয়েই জনগণের মাঝে অসন্তুষ্টি আছে বলে মনে করেন ভিটিএসআইওএম-এর পরিচালক ভ্যালেরি ফয়ডরভ৷ তিনি মনে করেন, পুটিনের প্রতি আস্থা কমে যাওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না৷ কারণ সাধারণ মানুষ সবসময়ই প্রেসিডেন্ট ও সরকারের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেন বলেই বিশ্বাস করেন তিনি৷ ফয়ডরভ বলেন, ‘‘পুটিন এক নম্বর রাজনীতিক৷ পুটিন এই দেশের জন্য দায়বদ্ধ৷ এটা সবাই জানে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘পুটিনের প্রতি মানুষ কৃতজ্ঞ, তাঁরা পুটিনকে সম্মান করে, পুটিনের মধ্যে তাঁরা স্বপ্ন দেখে৷'' তাঁর যুক্তি, ‘‘আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের কথা বলছি৷ কিন্তু এটাও ঠিক পুটিনের ওপর সন্তুষ্ট নয় এমন মানুষও আছে৷ তাঁরা পরিবর্তনও চায়৷ কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুব বড় নয়৷''