বহু পাখির ডাক নকল করতে পারে বলে আফ্রিকার ফিঙে সব সময়ই গবেষকদের আগ্রহের বিষয়৷ কিন্তু লম্বা লেজের কুচকুচে কালো এই পাখি সেই কৌশল কাজে লাগিয়ে যেভাবে অন্যের খাবার চুরির করে, তা দেখে বিজ্ঞানীরাও বিস্মিত৷
বিজ্ঞাপন
কালাহারি মরুভূমিতে ৮৭৪ ঘণ্টা ধরে ৬৪টি চামচপুচ্ছ ফিঙের ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে এ পাখির ‘মিথ্যে বলার কৌশল' সম্পর্কে বিশদ জানতে পেরেছেন তারা৷
গবেষকরা বলছেন, মরুভূমিতে যে কোনো বিপদে-আপদে পশুপাখিদের মধ্যে ‘বিপদ সংকেত' বিনিময় একটি সাধারণ নিয়ম৷ আগে থেকে সংকেত দিতে পারে বলে আফ্রিকার ফিঙের ওপর অন্য পাখি ও ছোট প্রাণীরা আস্থাও রাখে৷ আর এর সুযোগ নিয়েই মিথ্যে সংকেতে ছোট পশু-পাখিদের ভড়কে দেয় ফিঙে৷ তারপর তাদের জোগাড় করা খাবার নিয়ে সটকে পড়াই এঁদের কৌশল৷
হুমকির মুখে যেসব প্রাণী
হুমকির মুখে থাকা কিছু প্রজাতির প্রাণী লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে৷ এদের মধ্যে আফ্রিকার ওকাপিসহ আরো ২০০ পাখি রয়েছে৷ তবে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ওকাপি’র সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে
জিরাফের মতো দেখতে এই ওকাপি’র বাস কঙ্গোতে৷ আফ্রিকার ঐ অঞ্চলে কত প্রাণীর বাস তার হিসাব রাখে ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন)৷ সংস্থাটি সম্প্রতি হুমকির তালিকায় থাকা প্রাণীদের নাম প্রকাশ করেছে৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে, কঙ্গোর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকা এই ওকাপির সংখ্যা নব্বইয়ের দশকে ছিল ৪,৪০০৷ দশ বছর পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২,৫০০ তে৷ কঙ্গোর সহিংসতা এবং খনি ব্যবসাকে এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে৷
ছবি: cc-by-sa-3.0/Raul654
বিলুপ্তির পথে
আইইউসিএন জানিয়েছে, ওকাপি এখন হুমকির মুখে৷ তাদের তৈরি তালিকার একেবারে তলানিতে আছে ওকাপির নাম৷ অর্থাৎ এরাই সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে রয়েছে৷ এমন অনেক প্রাণী আছে, আজ থেকে ২০০ বছর আগেও যাদের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন বালি টাইগার৷ বাঘের প্রায় সব প্রজাতিই আজ হুমকির মুখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুইশ প্রজাতির পাখি হুমকির মুখে
নতুন রেড লিস্টে দুইশ প্রজাতির পাখিও রয়েছে৷ এদের মধ্যে অনেক শকুন আছে, যাদের বাস ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়৷ আইইউসিএন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, চীন ও মালয়েশিয়ার অনেক শকুন এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে৷ ইথিওপিয়া, জিম্বাবুয়ে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা অনেক শকুন এখন হুমকির মুখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এশিয়ার হাতি দ্রুত কমছে
বিশ্বে এখনও এশিয়ান এলিফেন্টের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজার৷ কিন্তু এরাও হুমকির মুখে রয়েছে৷ গত তিন প্রজন্ম ধরে এই প্রজাতির হাতির সংখ্যা কমছে৷ আইইউসিএন বলছে, তিন প্রজন্মে হাতির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান হাতি দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/Horst Galuschka
পাচার ও দাঁত বিক্রির কারণে বিপদ
কেবল এশিয়া নয়, আফ্রিকার হাতিরাও হুমকির মুখে৷ বন উজাড় এবং দাঁতের জন্য শিকারীদের উৎপাতও হাতিদের সংখ্যা কমানোর জন্য দায়ী৷ সেইসাথে অবৈধভাবে শিকার এবং চুরি করে পাচার করাও দিন দিন বাড়ছে৷ হাতি পাচার রোধে এ মাসের ২ থেকে ৪ ডিসেম্বর বতসোয়ানায় ‘আফ্রিকান এলিফেন্ট সম্মেলন’-এর আয়োজন করে আইইউসিএন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিলুপ্তির পথে মাছ
ডলফিনের মত দেখতে এই পরপয়েসদের সচরাচর দেখা যায় ক্যালিফোর্নিয়ায়৷ মাছ ধরার জালে আটকে প্রায়ই মারা যায় এরা৷ কখনো কখনো জেলেরা এদের ধরে নিয়ে যায়৷ ফলে হুমকির মুখে রয়েছে এই প্রজাতিটি৷ বিশ্বে এখন মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ পরপয়েস রয়েছে৷
ছবি: WDC
কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে আশার আলো
কিছু কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে অবশ্য উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেমন লেদারব্যাক কচ্ছপ৷ অথচ এক দশক আগে এই প্রজাতির কচ্ছপটি ছিল রেড লিস্টে, অর্থাৎ হুমকির মুখে৷ দুই মিটার লম্বা এবং আধা টন ওজনের এই কচ্ছপগুলো আকারে সবচেয়ে বড় হয়৷ এদের হুমকির মুখে পড়ার কারণ সাগরের দূষণ৷
ছবি: gemeinfrei
প্রাণী কল্যাণ সংস্থার অবস্থা
এছাড়া ব্ল্যাকব্রোও অ্যালবাট্রসের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে৷ নতুন লাল তালিকায় এই প্রজাতির পাখির আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে৷ আইইউসিএন এর পরিচালক ইয়ান স্মার্ট জানান, অনেক প্রজাতির উন্নতি হলেও এখনও ২১,০০০ প্রাণী হুমকির মুখে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষবার দেখার সুযোগ: পান্ডা, গন্ডার, লিঙ্কস
হুমকির মুখে থাকা প্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম জায়ান্ট পান্ডা৷ বিশ্বে এদের সংখ্যা মাত্র ১০০০ থেকে ২০০০৷ আর আছে সুমাত্রার গন্ডার, যাদের মোট সংখ্যা মাত্র ২২০৷ এছাড়া লাইবেরিয়ার লিঙ্কসও আছে এই তালিকায়৷ এদের সংখ্যা মাত্র ৮০ থেকে ১৫০টি৷ ১৯৬৩ সাল থেকে এই রেড লিস্ট প্রকাশ করে আসছে আইইউসিএন৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক টম ফ্লাওয়ার বলেন, এ প্রজাতির ফিঙেরা এমনিতে সৎভাবেই খাবার সংগ্রহ করে৷ তাদের প্রধান শিকার বাতাসে উড়ে চলা ছোটখাট পতঙ্গ৷ কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ায় যখন পোকামাকড় খুঁজে পাওয়া কঠিন, তখনই অন্যের খাবারে নজর পড়ে তাদের৷ একটি ফিঙে প্রতিদিন যে খাবার খায়, তার এক চতুর্থাংশই সে জোগাড় করে ‘মিথ্যে' সংকেতের প্রতারণার মাধ্যমে৷
পাইড ব্যাবলার, গ্লসি স্টারলিং, সোশ্যাল উইভার, ফ্যাকাশে চান্টিং গসহক, এমনকি মিয়ারক্যাটের মতো অন্তত ৫১ ধরনের পশু-পাখির ডাক নকল করতে পারে আফ্রিকার ফিঙে৷ তবে কাউকে ধোঁকা দেয়ার সময় প্রথমে নিজেদের বিপদ সংকেতটিই তাঁরা ব্যবহার করে৷
কাছাকাছি কোনো শিকারী পশু না থাকলেও ফিঙে এমনভাবে ডেকে ওঠে, যেন বিপদ একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে৷ সেই সংকেতে ভয় পেয়ে নির্ধারিত পাখি বা প্রাণীটি পালালেই তাঁর খাবার নিজের দখলে নেয় ফিঙে৷ ফিঙের ডাকে কাজ না হলে অন্য প্রাণীর ডাক নকল করে আবারো সংকেত দেয় সে৷ তার পরের পদ্ধতি একই রকম৷
টম ফ্লাওয়ার জানান, ফিঙেরা সাধারণত যে আকারের পতঙ্গ শিকার করে, তার চেয়ে বড় আকারের খাবার – যেমন কাঁকড়াবিছা, গুবরে পোকা, এমনকি বড় আকারের টিকটিকিও সে এই কৌশলে পেয়ে যায়৷ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানী আমান্ডা রিডলি বলেন, ‘‘মনুষ্য সমাজে এমন প্রতারণা ভাল চোখে দেখা হবে না, সেটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু এমন বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল যখন ছোট্ট একটি পাখি ব্যবহার করে, তখন আমরা চমৎকৃত না হয়ে পারি না৷''
কেবল কৌশলে নয়, আফ্রিকার ফিঙে সাহসেও অনন্য৷ আকারে চারগুণ বড় ঈগল বা বাজের সঙ্গেও তাঁরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যেন ভয়ডর বলে কিচ্ছুটি নেই৷