‘মা' – ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু কি বিশাল তার পরিধি! সৃষ্টির সেই আদিলগ্ন থেকে মধুর এই শব্দটা শুধু মমতার নয়, ক্ষমতারও যেন সর্বোচ্চ আধার৷ মার অনুগ্রহ ছাড়া কোনো প্রাণীরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়৷ তিনি আমাদের গর্ভধারিনী, জননী৷
বিজ্ঞাপন
জন্মদাত্রী হিসেবে আমার, আপনার, সকলের জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে৷ তাই তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিনের হয়ত কোনো প্রয়োজন নেই৷ তারপরও আধুনিক বিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটিকে ‘মা দিবস' হিসেবে পালন করা হচ্ছে, যার সূত্রপাত ১৯১৪ সালের ৮ই মে থেকে৷ সঙ্গে উপহার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সাদা কার্নেশন ফুল৷ সমীক্ষা বলছে, বছরের আর পাঁচটা দিনের তুলনায় এদিন অনেক বেশি মানুষ নিজের মাকে ফোন করেন, তাঁর জন্য ফুল কেনেন, উপহার দেন৷ আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, মায়েদের কি আলাদা করে কোনো উপহারের প্রয়োজন পড়ে? তাঁরা যে সন্তানের মুখে শুধুমাত্র ‘মা' ডাক শুনতে পেলেই জীবনের পরম উপহারটি পেয়ে যান৷
উপনিষদে পড়েছিলাম, ‘‘মাতৃ দেব ভব''৷ অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত ঈশ্বরী৷ তাছাড়া হিন্দুধর্মে মহাশক্তি, আদিশক্তি, রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় আমরা যাঁদের পেয়েছি, তাঁদের কিন্তু আমরা মাতৃরূপেই চিনেছি৷ এ জন্য কুসন্তান বলা হলেও, কুমাতা কখনও বলা হয় না৷কোনো মা, তা তিনি যে পেশাতেই থাকুন না কেন, যত কুশ্রীই হন না কেন, সন্তানের কাছে তিনি কিন্তু দেবীর মতোই৷ আর শুধু হিন্দু ধর্মে কেন? ইসলামে ‘মায়ের পায়ের নীচে বেহেস্ত' পাওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ খ্রিষ্টধর্মেও রয়েছে ‘মাদার মেরির' বিশেষ তাৎপর্য৷ সেই মায়ের জন্য কিনা বছরে একটা মাত্র দিন!
পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মা
ভালোবাসার মানুষ মায়ের প্রতি বিশেষ সম্মান জানাতেই ‘মা’ দিবসের সূচনা৷ দিনটির প্রচলন প্রথম শুরু হয় প্রাচীন গ্রিসে৷ জার্মানিতে বিশেষ এই দিনটি পালনের ছবি ও তথ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে এই ছবিঘর৷
ছবি: SARI GUSTAFSSON/AFP/Getty Images
বিশ্ব মা দিবস
প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব মা দিবস পালিত হয়৷ নানা সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রথম মা দিবস উদযাপন শুরু হয় গ্রিসে৷ গ্রিকরা তাদের মাতা-দেবি ‘রেয়া’র নামে পূজা করত৷ ১৯১৩ সালে অ্যামেরিকান কংগ্রেস মা দিবসকে সরকারিভাবে পালনের অনুমতি দেয়৷ তারপর থেকেই বিভিন্ন দেশে মা দিবস উদযাপন শুরু হয়৷ তবে মা দিবস উদযাপনের প্রথম ভাবনাটি এসেছে অ্যামেরিকান সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ডের মাথা থেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সকাল থেকেই শুরু
জার্মানিতে ‘মা’ দিবসে মা’কে কোনো কাজ করতে দেয়া হয় না৷ বাবাসহ বাচ্চারা সকালের নাস্তা তৈরি করে মায়ের জন্য উপহার সহ টেবিলে সাজিয়ে রাখে৷ সঙ্গে অবশ্যই থাকে ফুল৷ পরে মাকে নিয়ে যাওয়া হয় কোনো রেস্তোরাঁয়৷ তবে সব পরিবারেই যে এমনটা হয় তা কিন্তু নয়৷
ছবি: Fotolia/Tatyana Gladskih
উপহার
পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর এবং প্রিয় শব্দ ‘মা’৷ তবে কারো কারো প্রশ্ন মা’কে ভালোবাসা দেখানোর জন্য ঘটা করে ‘মা দিবস’ পালন করার কি তেমন কোনো প্রয়োজন আছে? কেউ মনে করেন প্রয়োজন নেই, আবার অনেকের মতে উপহার দিয়ে একটি বিশেষ দিনে মা’কে ভালোবাসা দেখানোর পরিকল্পনাটা খারাপ না৷
ছোটবেলা থেকেই শেখা
‘মা’ দিবস আসার আগে থেকেই জার্মানিতে একেবারে ছোট বেলা অর্থাৎ কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের মায়েদের জন্য নিজ হাতে কিছু না কিছু উপহার তৈরি করতে হয় বা ছবি আঁকতে হয়৷ একটু বড় বাচ্চারা কেউ কেউ আগে থেকেই নিজেদের হাত খরচ থেকে মায়ের জন্য উপহার কিনতে কিছু পয়সা জমিয়ে রাখে৷
ছবি: DW
মায়েদের ভাবনা
জার্মানিতে মা দিবস উদযাপন শুরু হয় ১৯২২ সাল থেকে৷ জার্মান মা’দের, বিশেষ করে বয়স্ক মায়েদের প্রায়ই বলতে শোনা যায় শুধু বিশেষ দিনে নয়, তাঁদের সন্তানরা যেন সময় সুযোগ পেলেই মায়েদের সাথে যোগাযোগ রাখে, মায়ের কথা মনে করে৷
ছবি: Fotolia/Fotowerk
বাণিজ্যিক দিক
মা দিবস উপলক্ষ্যে প্রতি বছরই কিছু না কিছু নতুন জিনিস বাজারে আসে৷ ফুলের ব্যবসা দারুণ জমজমাট হয়ে ওঠে৷ কত ভাবেই না সাজানো ফুল পাওয়া যায় এই দিনে৷ অন্যান্য উপহারের সাথে প্রিয় মায়ের জন্য এক গুচ্ছ ফুল সব ছেলে-মেয়ের হাতেই যেন থাকে৷
ছবি: DW/H. Sirat
দিনটা অবশ্যই রবিবার
প্রতিবছরই তারিখের একটু এদিক সেদিক হলেও বারটি থাকে রবিবার অর্থাৎ ছুটির দিন৷ ফলে অনেক সন্তান কাছে এসে তাদের প্রিয় মা’কে ভালোবাসা জানাতে পারে৷ অনেক বৃদ্ধা মা শুধুমাত্র এই দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষাও করে থাকেন, বিশেষ করে যাঁরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিদেশি পরিবার
জার্মানিতে বিদেশিদের মধ্যে তুর্কি বংশোদ্ভূত পরিবারের সংখ্যা সবচয়ে বেশি৷ তাছাড়া ওরা উপমহাদেশের পরিবারগুলোর মতো একসাথে মিলেমিশে থাকতেই পছন্দ করে, যে-কোনো উপলক্ষ্যে তো অবশ্যই৷ তাই ‘মা’ দিবসও এর ব্যতিক্রম নয়৷
ছবি: DW/K. Jäger
নিরাপদ আশ্রয়
মানুষ যখন ভয় পায়, অসুস্থ হয়, কোনো সমস্যা বা বিপদে পড়ে তখন তারা মায়ের কাছেই ভয়ার্ত শিশুর মতোই আশ্রয় খোঁজে, আকড়ে ধরে৷ মাকেই তখন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে হয়৷ আর তা যে-কোনো দেশের সন্তান এবং মায়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷
ছবি: imago/imagebroker
মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী সারা বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৯০ সাল থেকে শতকরা ৪৫ ভাগ কমেছে৷ তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, যেসব মা প্রসবকালীন সময়ে মারা যান তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই ছিল ডায়েবেটিস বা মেদবহুল শরীর৷
ছবি: DW/S. Schlindwein
ফিনল্যান্ডের অবস্থা সবচেয়ে ভালো
শিশু সাহায্য সংস্থা ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন’-এর এক সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে উত্তর ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডের মায়েদের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ অর্থাৎ সেখানে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, লেখাপড়া, মায়েদের আয় এবং সামাজিক অবস্থান অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে ওপরে৷ সেখানে শিশুর জন্মের পর মা ও শিশুকে বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া হয়ে থাকে৷
ছবি: SARI GUSTAFSSON/AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
তবে এ রীতিকে বোধহয় একেবারে তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়৷ অন্তত একটা দিন তো মায়ের কথা, তাঁর সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ভাবেন বিশ্ববাসী৷ সে কারণেই এটাকে আমার অনেকটা হিন্দুদের পুজো-আচ্চার মতো মনে হয়৷ এই যেমন, বৈদিক, সনাতন বা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে প্রতিদিন নানা দেব-দেবীর পুজো হলেও, বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ দেবতার পুজোও হয় আলাদাভাবে, ঘটা করে৷ এই ‘বিশ্ব মা দিবস' ঠিক তেমনই নয় কি?
আমার ‘মা' নেই৷ তাই শত ইচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের জন্য একটা দিন উদযাপন করার উপায় আমার নেই৷ আর সে জন্যই হয়ত প্রতিদিনই তাঁর কথা মনে হয়৷ প্রতিদিনই আমি বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় মায়ের ফটোটাকে বলে বের হই, আবার ফেরার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ‘‘কেমন আছো মা? কেমন কাটলো দিনটা তোমার?'' আমার কাছে প্রতিটি দিনই যে ‘মা দিবস'৷
আসলে কেন জানি না লোকদেখানো, অহেতুক আড়ম্বর, ঘটা করে কিছু করা তেমন ভালো লাগে না আমার, বিশেষ করে সেটা যদি নিজের জন্মদাত্রী মায়ের জন্য হয়৷ আজকাল কত ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধুকে দেখি মায়েদের অযত্ন করতে, তাঁদের অবহেলা করতে৷ তখন খুব খারাপ লাগে৷ যে মা-বাবা আমাদের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে, কথা বলতে শিখিয়েছে, মুখে তুলে দিয়েছে অন্ন, সেই বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, তাঁদের হাতে গড়া সন্তানটি ছোটবেলার কথা ভুলে বাবা-মা কে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে৷
আপনি হয়ত বলবেন বিদেশের কথা৷ কিন্তু বিদেশে সমাজব্যবস্থা ভিন্ন, রীতি-নীতিও আলাদা৷ সামাজিক নিরাপত্তাও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে অনেক বেশি৷ এমনকি জার্মানিতেও বৃদ্ধ বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন, অথবা তাঁদের নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করবেন – এটাই স্বাভাবিক৷ কর্ম-জীবনের উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এ জন্য সরকারি ভাতাও পেয়ে থাকেন তাঁরা৷ কিন্তু, আমাদের দেশে? আমরা তো দেশকেও ‘মা' বলে ডাকি৷ দেশের মাটিকে মা জ্ঞান করে তাঁর পায়ে মাথা ঠেকাই আমরা৷ বড় গলায় গর্ব করি দেশমাতৃকার জন্য৷
কিন্তু নিজের মায়ের বেলায়? বেঁচে থাকতে কতদিন, কতবার তাঁকে আদর করেছি আমরা? কতবার বলেছি ‘মা, তোমায় ভালোবাসি'? জীবনচক্রের ঘূর্ণন শুরু হয় সেই জন্মলগ্ন থেকে৷ এরপর ছোটবেলা কাটিয়ে উঠে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য, আর সবশেষে অনিবার্য মৃত্যু৷ এই ধ্রুব সত্য শুধু আপনার-আমার নয়, সবার জন্য৷ তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিন৷ যতদিন ‘মা' বেঁচে আছেন, ততদিন, প্রতিটি দিন পালন করুন ‘মা দিবস' হিসেবে৷