বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৪ জন নিহত হয়৷ আর এই সংখ্যা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যার মধ্যে সর্বোচ্চ৷ সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)-এর জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে৷
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালের তথ্য নিয়ে জরিপটি করেছে তারা৷
‘বাংলাদেশ হেলথ ইনজুরি সার্ভে-২০১৬ (বিএইচআইএস)' শিরোনামে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়৷ প্রকল্পের পরিচালক ফারুক আহমেদ ভুইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা দুর্ঘটনায় এবং আঘাতে মৃত্যু নিয়ে এই জরিপ চালিয়েছি৷ তাতে দেখা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ১৬৬ জন নিহত হন৷ আর তাতে প্রতিদিন গড়ে নিহতের সংখ্যা ৬৪ জন৷''
২০১৬ সালের তথ্য নিয়ে করা জরিপে দেখা যায়, প্রতি বছর আত্মহত্যা কারেন ২৩ হাজার ৮৬৮ জন, পানিতে ডুবে মারা যায় ১৯ হাজার ২৪৭ জন, উচু স্থান থেকে পড়ে মারা যায় ১৫ হজার ৪৫ জন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৯ হাজার ২১০ জন এবং সরাসরি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৬ হাজার ৪৭৫ জন৷
এর আগে ২০০৩ সালে একটা জরিপ করা হয়েছিল৷ তাতে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু (১৮ বছরের নীচে) শিশু মারা যায় ৯ জন৷ কিন্তু এবারের জরিপে সেই সংখ্যা ১৪ জন৷
প্রতিদিন ১৪ টি শিশু সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলেও প্রাপ্ত বয়স্ক নিহত হন ৫০ জন৷ নিহতের হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাপ্ত বয়স্ক নিহতের সংখ্যা সর্বোচ্চ৷
ফারুক আহমেদ
সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা অপঘাতে প্রতিদিন বাংলাদেশে ৩০০ মানুষ নিহত হন৷ পঙ্গু হন ৬৬০ জন৷
এর কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এর জন্য যে শুধু চালকদের বেপরোয়া ড্রাইভিংই দায়ী, তা নয়৷ এর পিছনে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়ক, যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতা অনেকাংশে দায়ী৷''
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, সড়ক দুর্ঘনায় প্রতি বছর বাংলাদেশের জিডিপি'র ২ শতাংশ ক্ষতি হয়৷ বাংলাদেশের জিডিপি ১৭ লাখ কোটি টাকা৷ তার ২ শতাংশের পরিমান ৩৪ হাজার কোটি টাকা৷ তবে এই ক্ষতি বাস্তবে আরো বেশি৷
Moazzem Hossain - MP3-Stereo
তিনি আরো বলেন, ‘‘সড়ক দুর্ঘটনায় দীর্ঘ মেয়াদে যে আর্থিক ক্ষতি হয় তা আমরা এই হিসেবের মধ্যে ধরি না৷ একে বিনিয়োগে ভাটা পড়ে৷ আতঙ্কের কারণে পর্যটনসহ নানা শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে৷ বছরে ৩৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মধ্যে এর হিসাব নেই৷ আমরা এই ক্ষতির কথা বলছি আহত বা নিহত ব্যক্তির সম্ভাব্য আয়, চিকিৎসা খরচ ও সম্পদের ক্ষতি হিসাব করে৷''
অন্যদিকে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশায় নিযুক্তরা পেশাগত কারণেই সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হন বেশি৷ কিন্তু তা নিয়ে আলাদা কোনো গবেষণা নেই৷ তাঁদের জন্য আলাদাভাবে কোনো চিকিৎসা বা ক্ষতিপুরণের ব্যবস্থাও নেই৷
দুর্ঘটনা থেকে শিশুদের যেভাবে বাঁচাবেন...
বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেই সড়ক দুর্ঘটনার হার খুব বেশি৷ দুর্ঘটনায় অনেক শিশুও মারা যায়৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) পথদুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর হার নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ শিশুদের বাঁচানোর কিছু উপায়ও জানিয়েছে সংস্থাটি৷
নজর রাখুন
রাস্তার কাছে কোনো শিশু দেখলে তাঁর দিকে বড়দের নজর রাখা উচিত৷ শিশুরা অবুঝ বলেই অনেক সময় ব্যস্ত রাস্তাও পার হতে যায়৷ এ কারণে অনেক শিশু মারাও যায়৷ ডাব্লিউএইচও বলছে, বড়রা সতর্ক হলে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব৷
ছবি: Colourbox/D. Pereiras
ধীরে চলুন
যানবাহন বেশি দ্রুত চালালে দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়ে৷ তাই নিয়ন্ত্রিত গতিতে চালানো সবার জন্যই মঙ্গলজনক৷ শিশুদের জন্য তা আরো বেশি দরকার৷ দ্রুত চালালে কোনো শিশু যদি হঠাৎ গাড়ির সামনে চলে আসে, চালক চট করে গাড়ি থামাবেন কী করে!
ছবি: picture-alliance/dpa
মদ্যপান করে রাস্তায় নয়...
মদ্যপান করে গাড়ি চালালে চালক গাড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না৷ তাই বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মদ্যপান করে গাড়ি চালানো আইনত দণ্ডনীয়৷ তারপরও অনেকেই মাতাল অবস্থাতেও গাড়ি চালান৷ শিশুদের জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সবার প্রতি মদ্যপান না করে গাড়ি চালানোর অনুরোধও জানিয়েছে ডাব্লিউএইচও৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media/Pictures From History
হেলমেটে সুরক্ষা
শুধু মোটর সাইকেলে নয়, শিশুদেরকে বাইসাইকেলেও হেলমেট ব্যবহার করতে বলেছে ডাব্লিউএইচও৷ শিশুদের মাথা বড়দের চেয়ে অনেক নরম৷ তাই সব অবস্থাতেই তাদের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Felix Kästle
শিশুদের শেখানো
পথে নামলে কী কী দিকে খেয়াল রাখতে হয়, তা শিশু যত তাড়াতাড়ি শিখবে ততই ভালো৷ বিশেষ করে শিশু যেন রাস্তার কোনদিক থেকে যানবাহন আসছে তা দেখতে শেখে এবং রাস্তা ফাঁকা না হলে পার হওয়ার চেষ্টা না করে – এইটুকু সব বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনেরই শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে শেখানো উচিত৷
ছবি: picture-alliance/Markus C. Hurek
সড়কের সার্বিক উন্নয়ন
রাস্তাঘাট ভালো না হলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে৷ তাই রাস্তাঘাট ভালো করাটা দুর্ঘটনার রোধের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপায়৷ তাছাড়া প্রতিটি রাস্তায় সতর্কতা সংকেত, রাস্তা পারাপারের চিহ্ন, জেব্রা ক্রসিং – এ সব থাকা জরুরি৷ শিশুদের জন্য চিহ্নগুলো বেশি দরকার, কেননা, ছবি দেখে তারা যেমন সব কিছু দ্রুত শিখতে পারে, সেভাবে নানা রংয়ের সংকেত দেখেও নিজেকে নিরাপদ রাখতে শেখে শিশুরা৷
ছবি: picture-alliance/AP/V.R. Caivano
উপযুক্ত চালক
যানবাহন চালানো খুব দায়িত্বশীল কাজ৷ একজন চালকের ওপর অনেকের জীবন নির্ভরশীল৷ তাই অবশ্যই লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই যানবাহন চালানোর সুযোগ দিতে বলেছে ডাব্লিউএইচও৷ এর সঙ্গে মানবিক শিক্ষার ওপরও জোর দিতে বলা হয়েছে৷ নিজের জীবনের পাশাপাশি অন্যের জীবনের গুরুত্ব না বুঝলে লাইসেন্সধারী চালকও তো কারো জন্য নিরাপদ নয়!
ছবি: Nobilior/Fotolia
দ্রুত চিকিৎসা
সড়ক দুর্ঘটনার পর খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না বলেও অনেক শিশু মারা যায়৷ তাই রাস্তার কাছেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা এবং শিশুদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল বাড়ানোর দিকে প্রতিটি দেশকে নজর দিতে বলেছে ডাব্লিউএইচও৷