যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংকট, জন্মগত ত্রুটি – অনেক কারণে মানুষের অঙ্গহীনতা দেখা যেতে পারে৷ অথচ কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির পথে প্রযুক্তি, মূল্য, যোগাযোগ – এ রকম অনেক অন্তরায় দেখা যায়৷ দক্ষিণ আফ্রিকার এক উদ্ভাবক এর অভিনব সমাধান বার করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
বয়স মাত্র ১২ হলেও কেইলা গেলাসের জীবনটা দক্ষিণ আফ্রিকার আর পাঁচটা কিশোরীর থেকে আলাদা৷ কেইলার জন্ম থেকেই বাঁ হাত নেই৷ কেইলা প্রতিবন্ধী৷ অবশ্য সে দিব্যিই সব কাজ সেরে ফেলতে পারে৷ তবে মাঝে মধ্যে সে-ও দ্বিতীয় হাতের অভাব বোধ করে৷
কৈলার কথায়, ‘‘আমি কাঠের কাজের ক্লাসে নাম লিখিয়েছিলাম৷ কিন্তু ওরা অনেক পেরেক ব্যবহার করে৷ আমি এত দ্রুত হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকতে পারি না৷ আমি শুধু তার এবং আঁকার কাজ করলাম৷ শিক্ষককেই পেরেকের কাজ করতে হলো৷''
রেস্তোরাঁয় খাবার পরিবেশন করবে রোবট?
রোবট, যন্ত্রের তৈরি মানুষগুলো শুধু যে চোখ পিটপিট তাকাতে আর শব্দ করতে পারে, তা নয়৷ চীনের বেশ কিছু রোস্তোরাঁয় আজকাল অতিথি আপ্যায়নেও কোমর বেঁধেছে তারা৷ চলুন যন্ত্রমানবের কাজ দেখতে ঘুরে আসা যাক সেরকমই একটি রেস্তোরাঁ থেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Zhang
আপনার অর্ডার, প্লিজ...
শুধু প্রযুক্তিগত চমক দেখানোই নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে একেবারে সামনের সাড়িতে রয়েছে চীন৷ তবে সেই সব আধুনিক প্রযুক্তি আদৌ ব্যবহারযোগ্য কিনা – সেটা অবশ্য দেখার বিষয়৷ ছবিতে দেখুন অতিথিদের খাওয়ার অর্ডার নোওয়াসহ হাজারো কাজ নিয়ে মেতেছে রোবট৷
ছবি: picture-alliance/epa/P. Hilton
খাবার তৈরি!
এই ছোট্ট হিউম্যানয়েড রোবটগুলো খাবার পরিবেশনের ক্ষেত্রে খুবই পারদর্শী৷ এদের সুবিধা হলো এই যে, এরা ক্লান্ত হয় না আর কাজ করতেও কোনো ঝামেলা করে না৷ বরং ওরা শুধুই নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে জানে৷ অবশ্য রোবটের পরিবেশিত খাদ্য খেতে অতিথিদের কোনো অভিযোগ থাকলে, সেটা ভিন্ন ব্যাপার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ChinaFotoPress/MAXPPP
শেফকুক রোবট
রোবট শুধু অতিথিদের অর্ডারই নেয় না, তারা উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে খাবার গরমও করে৷ ছবিতে দেখুন আগে থেকে তৈরি করা খাবার গরম করছে রোবট৷ তবে তরকারি কাটাবাছা বা এ ধরনের কাজগুলো মানুষ সহকর্মীদেরই আগে থেকে করে দিতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ChinaFotoPress/MAXPPP
নানা ধরনের রোবট
তবে সব রেস্তোরাঁর রোবট কিন্তু এই গ্যালারির ছবিগুলোর মতো দেখতে যন্ত্রমানবের মতো নয়৷ এখানে যে কাজটা করা হচ্ছে, সে অংশটুকুই দেখানো হচ্ছে৷ অর্থাৎ শুধু মাথাটাই দেখানো হচ্ছে, হাত বা পা নয়৷ রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের রোবটগুলো, অর্থাৎ যে রোবটগুলো রেস্তোরাঁর অতিথিদের সামনে যায় না, সেগুলো এরকমই হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিনোদনেও রোবট
সাংহাই-এর কাছে এই রোবট-রেস্তোরাঁতে খাবারের চেয়ে কিন্তু বিনোদন অনুষ্ঠানই বেশি আনন্দদায়ক৷ ইন্টারনেটে করা মন্তব্য থেকে অন্তত এ তথ্যই জানা যায়৷ অর্থাৎ এই রেস্তোরাঁয় অতিথিরা খাবারের চেয়ে বিনোদনটাই বেশি উপভোগ করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Robichon
5 ছবি1 | 5
কেইলার বাবা মানফ্রেড গেলেস অনেকদিন ধরে কৃত্রিম হাতের খোঁজ করছিলেন৷ তিনি জানান, ‘‘প্রথম কোটেশন ছিল প্রায় ২০,০০০ ইউরোর বেশি৷ আমাদের কাছে ব্যাপারটা ছিল অর্থহীন, কারণ কেইলা এখন বড় হয়ে উঠছে৷ তাছাড়া যিনি সেটা তৈরি করছিলেন, তিনি আমাদের মেয়ের কথাই শোনেননি৷ আমার মেয়ে একটি হাত ছাড়াই জন্মেছে৷ তাই সে অনেক কিছুই নিজে করতে পারে৷ সে শুধু নির্দিষ্ট কিছু কাজ করতে চেয়েছিল৷''
এরপর একদিন একটি প্রতিবেদন পড়ে মানফ্রেড গেলেস কাছেরই একটি কৃত্রিম অঙ্গ প্রস্তুতকারকের কথা জানতে পারেন৷ তাঁর নাম রিশার্ড ফান আস৷ ২০১২ সাল থেকে প্রাক্তন এই ছুতোর মিস্ত্রী সস্তায় কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করছেন৷ আসলে একটি দুর্ঘটনা তাঁর জীবন বদলে দেয়৷
উদ্ভাবক রিশার্ড ফান আস জানান, ‘‘২০১১ সালে আমি ডান হাতের চারটি আঙুল কেটে ফেলেছিলাম৷ হাসপাতালে গিয়ে ভাবছিলাম, এবার কী করে কাজ চালিয়ে যাবো৷ জীবনটাই বা কেমন হবে৷ এমন বিপর্যয়ের পর আমি মানুষের হাত নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করি৷ তারপর দেখলাম ব্যাপারটা খুব কঠিন হবে না৷ আমি বিকল্প তৈরি করলাম৷''
আশ্চর্যের বিষয়, মাত্র সাত দিনেই নিজের জন্য কৃত্রিম আঙুল তৈরি করেন রিশার্ড৷ এখানেই শেষ নয়, এরপর তিনি ‘রোবোহ্যান্ড' তৈরি করেন, যা কেইলার জীবনেও আনন্দ নিয়ে আসে৷ প্রথম সাক্ষাতেই রিশার্ড ফান আস তাকে কথা দিয়েছিলেন, ‘‘এটা অর্থোপ্লাস্টিক, এবার এটা তোমার হাতের আকারে তৈরি হবে৷''
সব সিদ্ধান্ত নেবে গাড়ি!
এমন গাড়ির কথা তো শুনেছেন যা আপনাআপনি চলে, কোনো চালক লাগেনা? সেসব গাড়িতে সব সিদ্ধান্ত কে নেয়? মানুষ, নাকি গাড়ি?
ছবি: media.daimler.com
চালক ছাড়া ৬০০ মাইল
এ বছরের শুরুর দিকে এই আউডি-৭ গাড়িটি যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি থেকে নিজে নিজেই পৌঁছে যায় ৬০০ মাইল দূরের লাস ভেগাসে৷ সাবধানের মার নেই- ভেবে স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে একজন বসেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁকে কিছুই করতে হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Fets/Audi AG
চালকের আসনই নেই!
স্বয়ংক্রিয় গাড়ি কেমন হতে পারে তার একটা নমুনা মার্সিডিজ বেঞ্জের এই এফ০১৫ মডেল৷ গাড়িতে চালকের আসন নেই৷ যাত্রীদের আসনগুলোই মুখোমুখি৷ পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি এ গাড়ি রাস্তায় নামলে ঘণ্টায় ১২৫ মাইল বেগে ছুটতে পারবে৷
ছবি: media.daimler.com
অস্থির লোকদের জন্য নয়
যাঁরা সবসময় শুধু দ্রুতই ছুটতে চান তাঁদের জন্য কিন্তু এই গাড়ি নয়৷ স্বয়ংক্রিয় গাড়ি বিপদ এড়ানোর জন্য প্রয়োজনে যে-কোনো মুহূর্তে গতি মন্থর করবে৷ সামনের গাড়ি বা অন্য কোনো বাহন থেকে নিরাপদ দূরত্বও বজায় রাখবে সবসময়৷
ছবি: imago/Jochen Tack
একে অন্যকে অনুসরণ করবে
মিউনিখে অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতায় নেমেছিল জার্মান সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুটি গাড়ি৷ প্রথমটিকে দ্বিতীয়টি সবসময় পেছন থেকে অনুসরণ করবে- এমন প্রতিযোগিতা৷ পেছনের গাড়িটি কিন্তু একবারও নিয়ম অমান্য করেনি!
ছবি: DW
দুর্ঘটনা এড়ানো
অনেক সময় চালক সামনের পথ না দেখেও যখন দ্রুত গাড়ি চালাতে যান তখনই দুর্ঘটনা ঘটে৷ কুয়াশায় ঢাকা পথ, কিংবা প্রবল বর্ষণের মধ্যে প্রায়ই এমন হয়৷ কিন্তু রোবোটিক গাড়ির বেলায় কখনো এমন হবেনা৷ এ গাড়ি নিজেকে যেমন সামনের গাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখবে, তেমনি পেছনের গাড়িকেও সতর্ক করবে৷ ভবিষ্যতে এমন গাড়ি তৈরি করা হবে যে গাড়ি সামনে যে বাধা আছে সে খবর পেছনের গাড়িকেও জানিয়ে দেবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সব তথ্যের জন্য আলাদা আলাদা সেন্সর
রোবোটিক গাড়ি তার চারপাশের সবকিছু আলাদা আলাদা চোখ দিয়ে দেখে৷ চোখের কাজটা করে সেন্সর৷ গুগল কার-এ থাকে এই ধরণের লেজার সেন্সর যার মাধ্যমে চারপাশের সবকিছুর ত্রিমাত্রিক ছবি ফুটে ওঠে৷
ছবি: DW/Fabian Schmidt
লেজার স্ক্যানারের চোখে....
জার্মান সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গাড়িটি কেমন দুর্গম পথ দিয়ে চলছে দেখুন! চলতে কিন্তু সমস্যা হচ্ছেনা৷ লেজার স্ক্যানার চার পাশটাকে স্ক্যান করছে, কম্পিউটার ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করে দিচ্ছে আর তা দেখে দেখে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি৷
ছবি: Universität der Bundeswehr/TAS
মেড ইন জার্মানি
ডাইমলারের গবেষকরা নিরাপদ গাড়ি তৈরির জন্য অপটিক্যাল ক্যামেরাও ব্যবহার করছেন৷ উইন্ডশিল্ডের পেছনের সেন্সরটা রাস্তায় কী ঘটছে তা দেখে৷ গাড়ি চালনার এই নিরাপদ ব্যবস্থা ২০১১ সালে জার্মানির সেরা উদ্ভাবনের পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল৷
ছবি: Deutscher Zukunftspreis/Ansgar Pudenz
পথচারীদের ভাবনা কম
কম্পিউটার গাড়িকে জানায় চারপাশের কোন বস্তু কোন দিকে যেতে পারে৷ গাড়ি সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়৷ ছবির এই গাড়ির সামনের পথচারী ডান দিক থেকে রাস্তা পার হচ্ছেন৷ তাঁকে কমলা রংয়ে আর ডান দিকের গাড়িগুলোকে সবুজ রংয়ে দেখানো হচ্ছে, যার অর্থ, এখন কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই৷
ছবি: Deutscher Zukunftspreis/Ansgar Pudenz
9 ছবি1 | 9
তার ও ইলাস্টিক এই রোবট-হাত বা ‘রোবোহ্যান্ড'-এর অংশগুলিকে ধরে রাখে৷ তাই হাতের বিশেষ অংশ হেলিয়ে হাত নাড়াচাড়া করা যায়৷ বলা বাহুল্য, এই আবিষ্কার রিশার্ডের জন্য থেরাপির মতো কাজ করেছিল৷ তিনি জানান, ‘‘ব্যথা আসলে মজার ব্যাপার৷ ব্যথা যত বাড়ছিল, তত আইডিয়া আসছিল৷''
এক মার্কিন সহযোগীর সঙ্গে মিলে রিশার্ড একটি থ্রিডি প্রিন্টার তৈরি করেন, যার নাম ‘রোবোবিস্ট'৷ এটা কৃত্রিম অঙ্গের অংশ তৈরি করে৷ কেইলা নিজের জন্য সবুজ রংয়ের হাত চেয়েছিল৷ তাই প্রিন্টার থেকে সবুজ রঙের একটা গরম প্লাস্টিক বের হয়৷
এমন একটা হাতের উৎপাদন ব্যয় ৪৬০ ইউরো৷ রিশার্ড অবশ্য প্রায়ই টাকা নেন না৷ প্রিন্টার বিক্রিই তাঁর আয়ের মূল উৎস৷ এর এক একটির দাম ৩,৮০০ ইউরো৷ রিশার্ড ফান আস জানান, ‘‘কাত করে রাখলেও যন্ত্রটি কাজ করে৷ এমনকি উলটে দিলেও প্রিন্ট করতে থাকে৷ ক্যালিব্রেশনের কোনো ক্ষতি হয় না৷'' অর্থাৎ সংকটপূর্ণ স্থানের জন্যও এটি উপযুক্ত৷
২০১৩ সালে রিশার্ড সিরিয়ায় গিয়েছিলেন৷ রিশার্ডের কথায়, ‘‘সেখানকার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এক পরিবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল৷ তারা আসলে ‘রোবোহ্যান্ড' সম্পর্কে জানতে পেরেছিল৷ তারা তখন নিজেদের দেশের মানুষ ও তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা ভাবে৷''
এর মধ্যে তাঁর তৈরি কয়েকটি প্রিন্টার সংকটপূর্ণ এলাকায় কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করছে৷ এই যেমন, মাত্র ১০ ঘণ্টায় তৈরি হয়ে গেছে কেইলার হাত৷ শেষবার ট্রায়ালের জন্য রিশার্ড নিজে এসেছেন৷ কেইলা তো দারুণ খুশি৷ রিশার্ডের কাজ ও উদ্ভাবন কেইলার জীবন যে চিরকালের জন্য বদলে দিতে চলেছে!