বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারীরা কমপক্ষে ১,৫০০ শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করেছেন৷ বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের করা আন্দোলন ঠেকাতে কয়েকটি কারখানা সপ্তাহখানেক বন্ধ রাখার পর এই সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ৷
বিজ্ঞাপন
চলতি মাসের শুরুর দিকে ঢাকার আশুলিয়ায় ফ্যাক্টরি ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিক৷ জিএপি, জারা এবং এইচএন্ডএম-এর মতো আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের পোশাক তৈরি করা হয় এ সব কারখানায়৷ পশ্চিমে ছুটির মৌসুমে পোশাক শ্রমিকদের কাজ না করার সিদ্ধান্তের কারণে বিপাকে পড়ে পোশাক প্রস্তুতকারীরা৷
পুলিশ সেসময় বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করে শ্রমিক ইউনিয়নের সাত নেতা এবং ত্রিশ শ্রমিককে আটক করে৷ মঙ্গলবার পুলিশ জানিয়েছে, আশুলিয়ায় আন্দোলনের কবলে পড়া পোশাক কারখানাগুলোর মালিকরা অন্তত দেড় হাজার শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করেছেন৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?
ছবি: DW/M. Mohseni
8 ছবি1 | 8
‘‘সবগুলো কারখানায় আবারো কাজ শুরু হয়েছে৷ আর নব্বই শতাংশের মতো শ্রমিক কাজে ফিরে গেছেন'', বলেন স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা নূর নবী৷ তিনি আরো বলেন, ‘‘মালিকরা দেড় হাজার শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করার পাশাপাশি আন্দোলনরতদের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলাও করেছেন৷''
বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন অবশ্য দাবি করেছে সাড়ে তিন হাজারের মতো শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করেছে কর্তৃপক্ষ৷ পাশাপাশি আন্দোলনের আয়োজকদের বেশ কয়েকজন চাপের মুখে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফেডারেশন৷
প্রসঙ্গত, পোশাক শ্রমিকরা তাদের বেতন বাড়িয়ে তিনগুণ করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে চলিত মাসের শুরুতে৷ বর্তমানে তাদের ন্যূনতম বেতন ৫,৩০০ টাকা৷ কিন্তু মালিকরা সেই দাবি মেনে নেয়নি৷ শ্রমিক নেতারা দাবি করেছেন, প্রতিবাদকারীদের মুখ বন্ধ করতে পুলিশ সেনাশাসনের সময়কালের এক বিতর্কিত আইন প্রয়োগ করেছে৷ পুলিশ জানিয়েছে, শুধুমাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রপ্তানির আশি শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক৷ দেশটির ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক খাত গত কয়েক বছরে একাধিকবার সমালোচিত হয়েছে৷ ২০১৩ সালে সাভারে ভবন ধসে প্রাণ হারান কমপক্ষে ১,১৩০ ব্যক্তি যাদের প্রায় সবাই পোশাক শ্রমিক ছিলেন৷ এরপর শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এবং নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় আসলেও পরিস্থিতি এখনো আশানুরূপভাবে বদলায়নি৷