নির্বাচনের খবর সংগ্রহ ও ফল প্রচারের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিযোগিতা দেখা যায় গণমাধ্যমগুলোতে৷ সেই প্রতিযোগিতার কারণে ভুলও হয়৷ সংখ্যায় ওপরে না থেকে মানে ওপরে থাকার প্রতিযোগিতা বেশি জরুরি৷
বিজ্ঞাপন
২০০৮ সালের কথা৷ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন৷ আমি তখন বাংলাভিশনের হয়ে নির্বাচন কাভার করতে খুলনায়৷ ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় ছিলাম ছাত্র৷ তাই প্রথমবার জাতীয় নির্বাচন কাভার করতে গিয়ে যারপরনাই ছিলাম উচ্ছ্বসিত৷
এ এক বিরাট যজ্ঞ৷ তখন কোনো টিভি চ্যানেলের স্থায়ী কোনো স্টুডিও ছিল না খুলনায়৷ তাই প্রথমে স্টুডিও'র জন্য রুম খোঁজা, তারপর সেটিকে সাউন্ডপ্রুফ করা, সেট বানানোসহ বিরাট দায়িত্ব নিয়ে ভোটের দু'সপ্তাহের বেশি সময় আগে গেলাম সেখানে৷ প্রথম দু-তিন দিন তো গেল এসব করতেই৷ এরপর শুরু হলো স্টুডিও লাইভ, নিউজ প্রেজেন্টেশন এসব৷
প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে রিপোর্ট করা এবং পরে সন্ধ্যা ৭টা ও ১০ টার নিউজে লাইভ দিয়ে পরে রাতের টকশো-তে আলোচনায় যোগ দিয়ে বের হতে হতে প্রতিদিন রাত সাড়ে ১২টা৷ এরপর রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে যেতে যেতে দেড়টা-দু'টা৷ অন্য চ্যানেলগুলোতে চোখ বুলিয়ে পরের দিনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ৩-৪ ঘন্টা ঘুমিয়ে নেয়া৷ এরপর সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ আবার বেরিয়ে পড়া৷ বলাই বাহুল্য, শুধু আমি নই, সে সময় আমার সঙ্গে খুলনায় ছিল একটা বড় টিম৷ সেই টিমে প্রডিউসার, ক্যামেরাপার্সন, ভিডিও এডিটরসহ অনেকেই ছিলেন৷ সবাই এমন পরিশ্রম করেছেন৷
২৮ তারিখ নির্বাচন হলো৷ ৩০ তারিখ পর্যন্ত এভাবেই কেটেছে৷ নির্বাচনের রাতে মহাকাণ্ড৷ খুলনা ২ আসনে বিএনপি থেকে মঞ্জু ও আওয়ামী লীগ থেকে মিজান দাঁড়িয়েছেন৷ খুব অল্প ব্যবধানে বিএনপি'র মঞ্জু জিতলেও ফলাফল মিলেছে ২৯ তারিখ ভোরে৷ ভোর ৫টা বা ৬ টার দিকে ঢাকায় সকালে নিউজ এডিটর ছিলেন বায়েজিদ মিল্কি ভাই৷ তিনি নিজেই স্টুডিওতে ঢুকে নিউজ পড়ে লাইভে যোগ দিলেন আমার সঙ্গে৷
তারুণ্যের উচ্ছ্বলতা আর আগ্রহ গায়ে লাগতে দেয়নি এতটা পরিশ্রমকে৷ আমার ধারণা, যাঁরা নিয়মিত বা অনিয়মিত রাজনৈতিক খবর সংগ্রহের কাজটি করেন, তাঁদের জন্য নির্বাচন একটা উৎসব৷ বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন৷ প্রতি পাঁচ বছরে জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে বড় ঘটনা এটি৷
তাই একে নিয়ে ভোটার, প্রার্থী, রাজনৈতিক কর্মীদের মতো সাংবাদিকদের মাঝেও তীব্র উত্তেজনা কাজ করে৷ সেই সঙ্গে কাজ করে প্রতিযোগিতার মানসিকতা৷ এখন অনেক পত্রিকা, অনলাইন ও টিভি চ্যানেল৷ আগে ব্রেকিং নিউজ দেবার প্রতিযোগিতা টিভি আর দু-একটি অনলাইন মাধ্যমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ সে সময়েই দেখেছি, খবর সবার দেবার প্রতিযোগিতা কখনো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ এখন তো বলাই বাহুল্য৷ সব পত্রিকার অনলাইন ভার্সনও আছে৷ আর টিভি ও অনলাইন পত্রিকার সংখ্যা বেড়ে চলেছে অবিরাম৷ বিশেষ করে নির্বাচনের ফলাফল দেবার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতার কাতারে থাকে না৷
বিকেলের পর থেকেই একেকটি নির্বাচনি এলাকার কেন্দ্রগুলোর ফল আসতে শুরু করে স্থানীয় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে৷ কাছাকাছি কেন্দ্রগুলোর ফলাফল আগেই চলে আসে খামবন্দি হয়ে, যা খোলা হয় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে৷ সেখানে এই ফলাফল পড়তে শুরু করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা৷ তিনি যতক্ষণ না পড়বেন, ততক্ষণ এই ফলাফলকে ‘অফিসিয়াল' বলা যাবে না৷
কোনো আসনের সবগুলো কেন্দ্রের ফলাফল আসার পর তিনি বেসরকারিভাবে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করে থাকেন৷ প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ৷ কিন্তু বিষয় হলো, এর আগেই হয়তো পুলিশ বা অন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে অথবা স্থানীয় প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অনেক সাংবাদিক ফলাফল সংগ্রহ করে থাকেন৷
সেই খবরটিই দিয়ে দেন৷ তাতে দেখা যায়, অনেক আসনে অনেক প্রার্থীকে তাঁরা বেসরকারিভাবে নির্বাচিতই ঘোষণা করে দেন, অথচ রিটার্নিং কর্মকর্তা হয়তো ততক্ষণে ১০ ভাগ রেজাল্ট পড়েছেন সেই আসনের৷
এমন উদাহরণ অনেক পাওয়া যাবে৷ একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় চোখের সামনেই অনেক বড় ভুল করতে দেখেছি৷ কিন্তু প্রতিযোগিতায় সবাই যে নামে তা-ও নয়৷ অনেকেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় না গিয়ে ধীরস্থিরভাবে কিন্তু সঠিক ফলাফল দেয়ার চেষ্টা করেন৷
ভোট একটি সংবেদনশীল বিষয়৷ এখানে অনিচ্ছাকৃত দু-একটি ভুল হতে পারে৷ তবে প্রতিযোগিতায় ভেসে গিয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে ভুল করাটা কাম্য নয়৷ প্রতিযোগিতা বিষয়টি সমর্থনযোগ্য, তাতে যদি পেশাদারিত্বের উন্নতি হয়৷ তাই ভুল এড়িয়ে কীভাবে বিষয়টি করা যায় তা দেখা উচিত৷ কাউকে বিজয়ী ঘোষণা করবার আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা আইনগতভাবেই সিদ্ধ৷ যদি কারো কাছে কোনো প্রার্থীর নিশ্চিত বিজয়ের তথ্যও থাকে, তাহলেও তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করার দায়িত্ব গণমাধ্যমের নয়৷ অন্যভাবে প্রচার করা যেতে পারে৷
এবারের নির্বাচনেও হয়তো অনেকেই এমন প্রতিযোগিতায় নামবেন৷ আবার কেউ কেউ দায়িত্বশীলতার চমৎকার উদাহরণ তৈরি করবেন৷ প্রত্যাশা থাকল, দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়াদের দল এবার ভারী হবে৷
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাংবাদিকদের ভূমিকা
আগামী ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে নির্বাচন কাভার করে আসছেন এ রকম কয়েকজন সাংবাদিকের মুখেই শুনুন নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের ভূমিকা কেমন হয় আর কেমন হওয়া উচিত৷
ছবি: Reuters
হারুন আল রশীদ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, দৈনিক প্রথম আলো
সব মানুষেরই দল ও মত আছে, একজন সাংবাদিকেরও থাকবে৷ কারণ, রাজনৈতিক মত ও দর্শন থাকাটা দোষের নয়৷ তবে সাংবাদিক যখন তাঁর প্রতিবেদন তৈরি করবে, সেই প্রতিবেদন যেন তাঁর দলীয় মত ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত না হয়, বিশেষ করে নির্বাচনে৷ কারণ, এই বিশেষ গুণটিই একজন সাংবাদিককে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা হতে সাহায্য করে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
সোমা ইসলাম, বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই
নির্বাচনের পরিস্থিতি যেমনই থাকুক না কেন তার সাথে খাপ খাইয়ে মূল খবরটা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়াটাই সাংবাদিকদের মূল কাজ৷ সামান্য ভুল কিংবা কোনো পক্ষকে কোনো সুবিধা দিতে গিয়ে রাষ্ট্র কিংবা জনগণ যেন ক্ষতির শিকার না হয়, সেটিই মুখ্য বিষয়৷ এছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচনে কালো টাকার যে ছড়াছড়ি থাকে, তার হাতছানি পাশ কাটিয়ে সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ থাকতে হয়৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
মইনুল হক চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
নির্বাচনের মাঠে সব দল ও প্রার্থী সমান সুযোগ পাচ্ছে কিনা তা গণমাধ্যমকর্মীরাই প্রতিবেদনে তুলে ধরেন৷ রাজধানীকেন্ত্রিক সাংবাদিক ও প্রান্তিক অঞ্চলের সাংবাদিকদের ভোটের দিন সঠিক ও তাৎক্ষণিক সংবাদ পরিবেশনে অসম প্রতিযোগিতা দেখা যায়৷ সে ক্ষেত্রে তথ্য যাচাই এবং মাঠের পরিস্থিতির সঠিক চিত্র তুলে ধরতে বেশ বেগ পেতে হয়৷ ফলাফল প্রচারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রভিত্তিক আনুষ্ঠানিক ফলাফল ছাড়া তথ্য প্রচার করা উচিত নয়৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
আরাফাত সিদ্দিক, জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি, এনটিভি
বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের ভূমিকা থাকে তাঁর প্রতিষ্ঠানের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী৷ এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সংবাদ প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীন দল ও তাদের প্রার্থীদের আচরণবিধি লংঘনের বিষয়টি সরাসরি সম্প্রচার বা প্রকাশ করছে না৷ যতটুকু প্রকাশ পায়, তা অন্যের অভিযোগ হিসেবে জানানো হয়৷ কোনো অনিয়ম দেখা গেলে তা যথাযথ তথ্য প্রমাণসহ তুলে ধরতে হবে৷ সেখানে সব পক্ষের বক্তব্য থাকা উচিত৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
শারমিন ইব্রাহীম, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বাংলা ভিশন
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার মাধ্যমে প্রার্থী আর ভোটারের এই উৎসবের সাথে সম্পৃক্ততাই তুলে ধরতে চান সাংবাদিক৷ সংবাদ উপস্থাপনের মূল শর্ত ক্রসচেক বা তথ্য যাচাই-বাছাই করে নেয়া৷ কোনো প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে যেভাবে প্রভাবিত করে, তেমনি সাংবাদিকের পেশাদারিত্বকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করে৷ ব্যক্তিগত পছন্দ, মতাদর্শের উর্ধ্বে থেকেই সংবাদ পরিবেশন করবেন– এটাই কাম্য৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
নিয়াজ মোর্শেদ, মাছরাঙ্গা টেলিভিশন
যাঁরা নীতিনির্ধারণীর ভূমিকায় থাকেন, তাঁদের নির্দেশে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে মাঠের সাংবাদিকরা কাজ করেন৷ এ কারণে সংবাদ প্রকাশে মাঠের সাংবাদিকের ভূমিকা হয় পক্ষপাতমূলক৷ তবে বেশির ভাগ সাংবাদিক মাঠে কাজ করার সময়, সব ধরনের সংবাদই সংগ্রহ করেন৷ দুনিয়ার কোনো সংবাদমাধ্যমই ভোটের সময় নিরপেক্ষ না৷ তাঁরা বিভক্ত হয়ে পড়েন৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
আসমা মিতা, সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
ভোটের সময় সাংবাদিকদের প্রধান চ্যালেঞ্জ নির্ভুল তথ্য জানানো৷ কারণ, তখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে চারপাশে অনেক গুজব ছড়ায়৷ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এ প্রবণতা আরো বেড়েছে৷ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ বিষয়টি বড় মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে৷ কাজেই নির্ভুল তথ্য দেয়াই সাংবাদিকদের মূল কাজ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
ইমরান হোসেন, বাংলা ট্রিবিউন
ভোটের সময় গণমাধ্যমের ভূমিকা কেমন হয়– এ প্রশ্নের জবাব আপেক্ষিক৷ অনেকে গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে প্রকৃত দায়িত্বটা পালন করতে চান না, আবার আমাদের কেউ কেউ এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে বেশি দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি৷ আমি মনে করি, কমিশনের নিজের স্বার্থেই গণমাধ্যমকে অবাধ প্রবেশের সুযোগ দেয়া উচিত৷ আর গণমাধ্যমের অবাধ প্রবেশের সুযোগ নিয়ে এমন আচরণ করা উচিত নয়, যাতে ভোট বিঘ্নিত হয়৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
রাসেল আহমেদ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, যমুনা টেলিভিশন
কোনো দলের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি না দিয়ে মানুষের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত৷ সেজন্য সাংবাদিকদের চোখ-কান খোলা থাকা দরকার৷ জানা উচিত, কোনটা নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন, কোনটা আরপিও তে নিষেধ, তার সবটাই৷ তবে বাস্তবতা হলো, সব সময় সাংবাদিক তার চোখ খোলা রাখতে পারেন না৷ নির্বাচন কাভার করতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকবার৷ সবচেয়ে বড় কথা, নিজের দায়িত্বের প্রতি সজাগ থাকা৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
তানিয়া রহমান, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, ৭১ টেলিভিশন
আমি মনে করি, সাংবাদিকরা জনগণের মুখপাত্র৷ তাই জনগণের কথাই সাংবাদিকরা আগেও বলেছেন, আসছে নির্বাচনেও বলবেন৷