ঝুলে থাকা ফরাসি জঙ্গি বিমান বিক্রির চুক্তিটি চূড়ান্ত করতে চান তিনি৷ বাণিজ্যিক স্বার্থ বড় বালাই৷ ক্ষমতায় আসার পর প্রতিরক্ষা বাণিজ্যে বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দেওয়ার কথা বলেন মোদী সরকার৷ শুধু তাই নয়, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত যেসব চুক্তি সাবেক মনমোহন সিং সরকারের আমল থেকে দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল, সেগুলির চূড়ান্ত অনুমোদন দেবার পদক্ষেপ নেবার কথা বলেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি ও তাঁর প্রতিরক্ষা দপ্তর৷ সামগ্রিকভাবে মোদী সরকারের নীতি ভারতের প্রতিরক্ষা শক্তিকে ধাপে ধাপে আরো মজবুত করা৷ এর ফলে ভারতে প্রতিরক্ষা শিল্পে যে নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে সেটাকে কাজে লাগাতে ভারতকে প্রতিরক্ষা বাণিজ্যের পাখির চোখ করে ছুটে আসছে পশ্চিমি দেশগুলি৷ সেই লক্ষ্যে কিছুদিন আগেই ভারত সফরে এসেছিলেন রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী৷ আর এবার এসেছেন ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরঁ ফাবিউস৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
২০১২ সালে সাবেক মনমোহন সিং সরকারের আমলে ফ্রান্সের ডাসল্ট কোম্পানির কাছ থেকে দেড় হাজার কোটি ডলারের ১২৬টি বহুমুখী রাফায়েল জেট জঙ্গি বিমান কেনার কথা ছিল৷ প্রাথমিক যোগ্যতার মাপকাঠিতে এই বিমানই বেছে নেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু চুক্তির বিভিন্ন দিক ও শর্ত নিয়ে চলে দরকষাকষি৷ যেমন দাম, প্রযুক্তি হস্তান্তর, উন্নত মান এবং পরে ভারতে তা তৈরি করা ইত্যাদি৷
বিশ্লেষকদের মতে, ফ্রান্স থেকে কেনা মিরাজ-২০০০ কেনার পর পরবর্তীকালে তার উন্নয়নের জন্য প্রচুর বাড়তি খরচ করতে হয় ভারতকে৷ কারণ, উন্নতকরণের জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তরের কোনো সংস্থান ছিল না৷ কিন্তু এবার এইসব শর্ত মেনে নিয়ে রাফায়েল কোম্পানির পক্ষ থেকে নতুন করে আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে ফ্রান্স৷ ৩০শে জুন সোমবার ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বৈঠকে মিলিত হন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে৷ সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও৷ তাঁকে ফ্রান্স সফরের জন্য ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদ-এর আমন্ত্রণপত্র দেন৷
আলোচনার পর ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরঁ ফাবিউস রাফায়েল জঙ্গি বিমান চুক্তিকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবার বিষয়ে আস্থা ব্যক্ত করে বলেন এই চুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এক বৃহত্তর ‘পার্টনারশিপ' গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যেটা শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না৷ যেমন ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ইত্যাদি যাতে ভারতেই তৈরি হয় সেদিকেও নজর দেয়া হবে৷ পাশাপাশি তিনি মহারাষ্ট্রের জইতাপুর বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি আটকে থাকার প্রসঙ্গে বলেন, পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন এই চুক্তি কার্যকর হবার পথে বাধা হবে না৷ উল্লেখ্য, পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন অনসারে পরমাণু কেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় নিতে হবে পরমাণু উপকরণ সরবরাহকারী কোম্পানিকে৷
বর্তমান মোদী সরকারের পরিবর্তিত প্রতিরক্ষা নীতি হলো, প্রতিরক্ষা আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা যতটা সম্ভব কমিয়ে এনে দেশেই তা তৈরি করা৷ সেজন্য দরকার আধুনিক প্রযুক্তি এবং আর্থিক সামর্থ্য৷ প্রাথমিকভাবে বিদেশি প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগ নিয়েই সেটা সম্ভব৷ তার জন্য প্রযুক্তি সাপেক্ষে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ বিদেশি লগ্নির ছাড়পত্র দিতে হবে৷ এই মর্মে একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে৷ আর কয়েকদিনের মধ্যেই ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে কথা বলতে ভারতে আসছেন মার্কিন সেনেটর জন ম্যাককেইন৷ এরপর আসার কথা ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর৷