প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিপন্ন শিষ্টাচার
১০ ডিসেম্বর ২০২১বাংলাদেশে অশিষ্ট কথা বলে মন্ত্রীত্ব হারিয়েছেন ডা. মুরাদ হাসান৷ একই ধরনের অভিযোগে বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালও এখন সমালোচিত৷ রাজনীতিতে শিষ্টাচারের কি খুব প্রকট? কেন এই অবস্থা?
২০১০ সালে এখনকার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার৷ মার্চের একদিন সংসদে এতই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে তিনি বক্তাদের মাইক বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন৷ সেটা কোনো যৌক্তিক আলোচনার উত্তাপ ছিল না৷ ছিল পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার৷ ওই ঘটনার পরের দিন সংসদে আবদুল হামিদ বলেন, ‘‘আমি একটা কথা বলে দিতে চাই, অসংসদীয় ও আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করলে মাইক বন্ধ হয়ে যাবে৷ আর ফাইটিং বা রেসলিং করতে চাইলে পল্টনে চলে যান৷ সংসদের বাইরেও মাঠ আছে৷ গায়ে তেল মেখে আন্ডারওয়্যার পরেও সেখানে চলে যেতে পারেন৷’’ সেই দিন তিনি আরো বলেছিলেন, ‘‘আপনাদের এ রকম কথা, আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন মানুষ মেনে নিতে পারে না৷ সংসদের মান-মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে সচেতন থাকতে হবে৷ এ ধরনের ঘটনা দেখবো, তা কোনোভাবেই আশা করিনি৷ এ ধরনের ভাষা কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়, কে কোথা থেকে এসেছেন৷”
রাজনীতিতে এই শিষ্টাচার ভঙ্গের ঘটনা মুখের কথায়ই শুধু নয়, অঙ্গভঙ্গিতেও প্রকট৷ বক্তৃতা, টকশো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবখানেই কিছু রাজনীতিবিদের সরব উপস্থিতি৷ প্রতিপক্ষকে অপমান, অপদস্থ করাই যেন তাদের টার্গেট৷ আর এটা করতে গিয়ে অপ্রকাশযোগ্য ভাষার ব্যবহারে তারা অনেক এগিয়ে৷ টকশোতে তো মারামারি, হাতাহাতির রেকর্ডও সৃষ্টি হয়েছে৷
আর এই অশিষ্ট আচরণের জন্য বেশ কয়েকজন নেতা-নেত্রীর কুখ্যাতি আছে৷ টেলিভিশন, ইউটিউব বা ফেসবুকের টকশোতে তাদের বেশ কদর৷ কারণ, তারা টকশোতে এলেই হিট৷ তারা লেগে গেলেই জমে যায়৷ অশিষ্ট আচরণে কুখ্যাতি পাওয়ারাই এখন টকশোর হাই প্রোফাইল গেস্ট৷ তাই উসকানির দায় টকশো ওয়ালাদেরও আছে৷ কোনো কোনো উপস্থাপকের প্রশ্নই থাকে তাদের উসকে দেয়ার জন্য৷ রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম সবাই মিলেই বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন৷ আর এইসব করে নাকি দলেও অবস্থান ভালো করা যায়৷
তবে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অতীতের উজ্জ্বল ইতিহাসও আছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক৷ তিনি বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা তিনটি বই পড়লেই সেইসব শিষ্টাচারের উদাহরণ পাওয়া যাবে৷ তিনি তার চরম প্রতিপক্ষকেও সম্মান করে কথা বলতেন৷ তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতারাও তার কাছে আশ্রয় পেতেন৷ সহায়তা পেতেন৷ আমরা আজকাল তার আদর্শের অনুসারী হওয়ার কথা বলে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করি৷ কিন্তু বাস্তবে সেই আদর্শের চর্চা করি না৷’’
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক মুহম্মদ শফিকুর রহমান তার এক লেখায় লিখেছেন, ‘‘মুসলিম লীগ নেতা হিসেবে সবুর খান গং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, তথা পাকিস্তানের দালালী করেছেন৷ স্বাধীনতার পর স্বাভাবিকভাবে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী৷ একদিন ডেপুটি জেলার এসে সবুর খানকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন৷ সুন্দর বিছানার খাট, টেবিল-চেয়ার, বাথরুম সব পরিপাটি৷ জেলার বললেন, ‘স্যার আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, আমি শুধু নির্দেশ পালন করছি৷’ সবুর খান জবাবে বললেন, ‘তোমাকে কিছু বলতে হবে না, ও ভালভাবেই জানে কোন কক্ষটি কেমন, আমরাই তো ওকে বছরের পর বছর এ কক্ষে নয়তো ও কক্ষে রেখেছিলাম৷’’
সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘রাজনৈতিক নেতাদের সৌজন্যবোধ ও ভাষা রীতি' প্রবন্ধে রাজনীতিবিদদের সৌজন্যবোধের উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন, ‘‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাওয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভারত সফরে গিয়েছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো কাগজ লিখলো, তিনি ভালো ইংরেজি জানেন না, ভারতের নেতাদের সঙ্গে কী আলোচনা করবেন? দিল্লি থেকে ফেরার পথে খালেদা জিয়া কলকাতায় ঘণ্টা খানেক যাত্রাবিরতি করেন৷ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিমানবন্দরে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন৷ তারা ২০ মিনিট একান্তে কথা বলেন৷ বৈঠকের পর সাংবাদিকেরা জ্যোতি বসুকে ঘিরে ধরেন৷ তারা জানতে চান, ‘কী কথা কইলেন? বাংলায়ই তো কইলেন? উনি তো ইংরেজি জানেন না৷' জ্যোতি বসু ছিলেন মুরব্বিস্থানীয় নেতা৷ তিনি ধমক দেন, ‘কী সব বাজে কথা বলো৷ তার সঙ্গে তো আমার ইংরেজিতেই কথাবার্তা হলো৷ ভালোই ইংরেজি বলেন৷’’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ মনে করেন, ‘‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে তা থেকেই এই অবস্থার শুরু৷ জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে এর সূচনা করেন৷ এরপর বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করেছেন৷ এরপর ২০০১ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালানো হলো৷ একের পর এক এই যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার চেষ্টা, তা-ই রাজনীতিতে একটি বড় দেয়াল সৃষ্টি করেছে৷ ফলে সহানুভূতি বা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অভাব দেখা দিয়েছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অপমান করে কথা বলেন৷ তারেক রহমান সমাবেশে শেখ হাসিনাকে বলেন, হাসিনা৷ কোকোর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন৷ কিন্তু তাকে বাসায় ঢুকতে দেয়া হয়নি৷ গেট থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়৷’’
তার কথা, ‘‘প্রধানমন্ত্রী তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন৷ কিন্তু বিএনপির মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যে কটুক্তি করেছেন, তার বিরুদ্ধে কিন্তু বিএনপি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু মনে করেন, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সভ্যতা, ভব্যতা থাকে৷ এর বিপরীত অবস্থা দেখা যায় স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায়৷ এখন আমরা যা দেখতে পাচ্ছি৷ এই ব্যবস্থা অহমিকা তৈরি করে৷ যার ফল আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি৷”
তার মতে, ‘‘পাকিস্তান আমলেও ন্যূনতম গণতন্ত্র ছিল৷ ১৯৭০ সালে যে নির্বাচন হয়েছে তা বাংলাদেশে গত ১০ বছরে কল্পনা করাও কঠিন৷ ফলে পাকিস্তান আমলেও রাজনীতিতে শিষ্টাচার, সৌজন্য ছিল৷ এখন তা নেই৷’’
তরুণ রাজনীতিবিদ ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘‘একটা ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার, ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ পথ, গণতন্ত্রিক চর্চা থাকে৷ ফলে অন্যকে স্বীকার করার প্রবণতা থাকে৷ আমি যখন অন্যকে স্বীকার করি তখন তাকে সম্মান করি৷ কিন্তু যখন নাই করে ফেলতে চাই, তখন সম্মান থাকে না৷ সব সময় তো আর শারীরিকভাবে নাই করে ফেলতে পারি না৷ তখন আমি কথা দিয়ে নাই করে ফেলি৷ তখন আমরা দেখি কতটা কুৎসিতভাবে একে অপরকে কতটা ছোট করা যায় তার প্রতিযোগিতা৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘বিদ্যমান ক্ষমতার ফাঁক-ফোকরে মুরাদরা লুকিয়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়৷ আর ক্ষমতাসীনদের আচরণ বিরোধীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়৷ মূল ক্ষমতা যেভাবে সমাজে প্রভাব বিস্তার করে তার পাল্টা জায়গাগুলো সাধারণত সেই গতিপথে চলতে থাকে৷’’