বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সচেতনা তৈরি না হলেও, গত কয়েক বছরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ উয়ারি-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে বের করা হয়েছে৷ কাজ চলছে অন্যত্রও...৷
বিজ্ঞাপন
১. এরপরও অবশ্য বলা যায় না যে, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে৷ বিশেষ করে দৃশ্যমান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দায়িত্বশীলরা যে কতটা উদাসীন তার দু'টি নমুনা দেওয়া যাক৷
ক. বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ফ্রান্সের গিমে মিউজিয়ামকে বাংলাদেশ থেকে অনেকগুলো পুরাকৃর্তি নিদর্শন পাঠানো হয়েছিল৷ পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অস্বচ্ছ৷ কতগুলো পাঠানো হয়েছিল, সবগুলো ফেরত আনা হয়েছিল কিনা, আনা-নেওয়ার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কিনা, আজও এ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি৷ উত্তর জানা যায়নি পাঠদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার যৌক্তিকতারও৷ দেশের মানুষ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও, কাজটি করা হয়েছিল মূলত আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে৷
কেমন আছে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা৷ তবে বেশিরভাগ স্থাপনাই যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে৷ আর যেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেগুলো নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ৷
ছবি: DW/M. Mamun
রূপলাল হাউস
ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে তৈরি হওয়া সুরম্য এই অট্টালিকাটি এখন খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর৷ পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের দখলে যাবার পর রূপলাল হাউস ধ্বংসের গোড়ায় পৌঁছেছে৷ ফরাশগঞ্জের স্বরূপ চন্দ্রের দুই পুত্র রূপলাল দাস এবং রঘুনাথ দাস ১৮৪০ সালে এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুরোনো একটি ভবন কেনেন৷ পরে কলকাতার স্থপতি নিয়োগ করে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে রূপলাল হাউসের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
আহসান মঞ্জিল
পুরান ঢাকার আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা আহসান মঞ্জিলকে এখন বুড়িগঙ্গা থেকে দেখাই যায় না৷ এর সামনে বসে ফলের বাজার৷ সম্মুখভাগে তাই টিনের বেড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ১৮৩০ সালে ঢাকার নবাব খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের কাছে থেকে পুরনো একটি ভবন কিনে নেন৷ ১৮৭২ সালে নবাব আব্দুল গণি এটিকে নতুন করে নির্মাণ করে তাঁর ছেলে খাজা আহসান উল্লাহর নামে এর নামকরণ করেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় কাটরা
পুরান ঢাকার চকবাজারে মুঘল আমলের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনাও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে৷ সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়৷ বর্তমানে একটি মাদ্রাসা হয়েছে৷ বেশ কিছু ব্যবসায়ী এ ভবনটি দখল করে আছে৷ স্থাপত্য সৌন্দর্যের বিবেচনায় একসময়ে বড় কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি যেন ভগ্নাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ছোট কাটরা
ঢাকার চকবাজারে বড় কাটরার কাছেই আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছোট কাটারা৷ শায়েস্তা খানের আমলে আনুমানিক ১৬৬৩ থেকে ১৬৬৪ সালের দিকে এই ইমারতটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৬৭১ সালে৷ দেখতে অনেকটা বড় কাটরার মতো হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটরার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই হয়তো এর নাম হয়েছিল ছোট কাটরা৷ সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে মুঘল আমলের এ স্থাপনাটিও ধ্বংসপ্রায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
হাজী শাহবাজ মসজিদ
ঢাকার রমনা এলাকায় হাইকোর্টের পিছনে হাজী শাহবাজ মসজিদ সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি৷ কিন্তু এর পেছনের অংশে আলাদা লোহার ফ্রেম বসানো হয়েছে ছাউনি দেওয়ার জন্য৷ যার ফলে স্থাপনাটির সৌন্দর্য হানি হয়েছে৷ মুঘল শাসনামলে শাহজাদা আযমের সময়কালে ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন কাশ্মীর থেকে বাংলায় আসা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হাজী শাহবাজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
গোয়ালদী শাহী মসজিদ
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে গোয়ালদী শাহী মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণার পিলারটি ভবন থেকে খেসে পড়ার উপক্রম হলেও দীর্ঘ দিন চোখ পড়েনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের৷ সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে মোল্লা হিজাবর খান ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি৷
ছবি: DW/M. Mamun
পানাম নগর
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী ঐতিহাসিক পানাম নগর৷ ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন এই সোনারগাঁওয়ে৷ প্রায় ৫ মিটার চওড়া এবং ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দু’পাশে সুরম্য ৫২টি বাড়ি প্রাচীন এই নগরের অন্যতম আকর্ষণ৷ কিন্তু সঠিক সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ঐতিহাসিক এ শহরটি ধ্বংস হতে চলছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ষাট গম্বুজের মসজিদ
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের অভ্যন্তরের পাথরের তৈরি পিলারগুলো ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সালের এক সংস্কার কাজের সময় সুরক্ষার কথা বলে পলেস্তারার প্রলেপে ঢেকে দেয়া হয়েছিল৷ তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বোধোদয় হওয়ায় সাম্প্রতিক সংস্কারের সময়ে পিলারগুলোর পাথরের উপর থেকে পলেস্তারা তুলে ফেলা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
অযোধ্যার মঠ
বাগেরহাটের যাত্রাপুরে সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ‘অযোধ্যার মঠ’ কিংবা ‘কোদলা মঠ’৷ মঠের গায়ে গজিয়ে ওঠা বড় বড় পরগাছাগুলোই সংরক্ষিত এ পুরাকীর্তিটির প্রতি সরকারের অবহেলার বড় প্রমাণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
চুনাখোলা মসজিদ
বাগেরহাটের বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার অংশ চুনাখোলা মসজিদের দেয়ালের ইট খসে পড়ার উপক্রম, দরজা-জানালার গ্রিলও মরিচা ধরে খুলে পড়েছে৷ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের ছোঁয়া লাগেনি প্রাচীন এ স্থাপনাটিতে৷
ছবি: DW/M. Mamun
গোকুল মেধ
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কাছে ঐতিহাসিক ‘গোকুল মেধ’৷ বেহুলার বাসরঘর নামেও এটি পরিচিত৷ বাতি ঝুলানোর জন্য ঐতিহাসিক এ প্রত্নস্থলটির চারপাশ ঘেঁষে বাঁশ বসানো হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় বাড়ি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর গ্রামে তিতাস নদীর তীরে জমিদার কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরীর সুরম্য প্রাসাদ বড়বাড়িতেও সংস্কারের হাত পড়েনি কখনো৷ ফলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এ বাড়িটি দখল করে আছে ৪০টিরও বেশি পরিবার৷
ছবি: DW/M. Mamun
চার আনি জমিদার বাড়ি
কোনো রকম সংরক্ষণ না করায় প্রায় ধ্বংসই হয়ে গেছে নাটোরের পুঠিয়ার চার আনি জমিদার বাড়ি৷ পুঠিয়া রাজবাড়ীর শ্যাম সরোবরের দক্ষিণ পাশের এ চার আনি জমিদার বাড়ি ছাড়াও চার আনি কাছারি বাড়িও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় সর্দার বাড়ি
ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর ধ্বংসের মহোৎসবের মাঝেও দু-একটি স্থাপনা খুব ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে৷ যেমন ধুরণ সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক বড় সর্দার বাড়ি৷ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এ বাড়িটি সংস্কার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ কোরীয় বহুজাতিক কোম্পানি ইয়ংওয়ান কর্পোরেশনের প্রায় দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তায় করা হয়েছে এ সংস্কার কাজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড
বাংলাদেশের যে কোনো সংরক্ষিত পুরাকীর্তি যারা দেখেছেন, এই সাইনবোর্ডটি তাঁদের কাছে বেশ পরিচিত৷ মূল্যবান এই পুরাকীর্তিটি নষ্ট বা ধ্বংস করলে কী শাস্তি হতে পারে তা লিপিবদ্ধ আছে এখানে৷ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ সাইনবোর্ডটি বসিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে৷ প্রতিটি স্থাপনাতেই সংরক্ষণে অবহেলার ছাপ চোখে পড়ে সহজেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
15 ছবি1 | 15
খ. বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর সামনে যে মানুষটি সাহিত্য দিয়ে পরিচালিত করে গেছেন, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের শৈল্পিক কুঠিবাড়ি৷ পদ্মার পাড়ের এই কুটিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ আসতেন, থাকতেন৷ তাঁর সাহিত্যের বহু কিছু তিনি এখানে বসে লিখেছেন৷ কুঠিবাড়িটি ছিল লাল ইটের তৈরি৷ কয়েক বছর আগে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে বাড়িটি সাদা রং করা হয়েছে৷ আমাদের প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণের মানসিকতা,এই ঘটনাটি দিয়ে খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়৷
২. উয়ারি-বটেশ্বরসহ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নানা কিছু সন্ধান করে বের করা হচ্ছে, যা প্রশংসার৷ তবে যা দৃশ্যমান আছে, সেগুলোর অবস্থা বড়ই করুণ৷ দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দির৷ ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই মন্দিরটির সংরক্ষণের অবস্থা মোটেই সন্তোজনক নয়৷ পোড়ামাটির নান্দনিক শিল্পকর্মগুলোর অনেক কিছুই চুরি হয়ে গেছে, খুলে পড়েছে৷
রাজশাহীর পুঠিয়ার রাজবাড়িতেও এমন কিছু ছোট-বড় মন্দির আছে৷ সেগুলোর সংরক্ষণ অবস্থাও বড়ই করুণ৷ পুঠিয়ার রাজবাড়ির অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে৷ আবাসিক বাড়ি তৈরি হয়েছে, রাজবাড়ি এলাকার ভেতরে৷
জয়পুরহাটের পাহাড়পুর, বগুড়ার মহাস্থানগড়, বেহুলা-লক্ষিন্দরের সেই কিংবদন্তি....কোনো কিছুর সংরক্ষণের প্রতি যে গুরুত্ব থাকা প্রত্যাশিত ছিল, তা নেই৷
পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়ের অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করে চাষাবাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ স্থানীয় প্রভাবশালীরা এ সব করেছে, প্রশাসনের সহায়তায়৷
৫০০ বছরের পুরনো শৈল্পিক সৌন্দর্যের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে কাগজে-কলমে গুরুত্ব পেলেও, বাস্তবে গুরুত্ব খুবই কম৷
৩. পাকিস্তানিদের কাছে এ সব নিদর্শনের কোনো গুরুত্ব ছিল না৷ ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল, ১১ বছর সময় নিয়ে নির্মিত হয়েছিল নাটোরের দিঘাপাতিয়ার রাজবাড়ি, যা উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত৷ তুলনামূলকভাবে উত্তরা গণভবনের ব্যবস্থাপনা এখনও ভালো৷ সেই আমলের আসবাবপত্র, ঝাড়বাতি থেকে শুরু করে কেরসিনের ফ্যান – সবই সংরক্ষিত হয়েছে৷
১৯৬৫ সালে মোনায়েম খান উত্তরা গণভবনের নকশায় একটি বড় পরিবর্তন আনেন৷ তিনি মন্দিরের মতো দেখায় এমন অংশ ভেঙে মসজিদের গম্বুজের মতো অংশ সংযুক্ত করেন, যা মূল নকশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷
বাংলাদেশ আমলে উত্তরা গণভবন নাম দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়৷ ফলে ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো৷ তবে স্বাধীন বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণের দিকটি সব সময় অবহেলিতই ছিল৷ এখনও যে তার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে, তা বলা যাবে না৷ শুধু বলা যাবে যে, এক ধরনের সচেতনা তৈরি হয়েছে৷
আপনি কি গোলাম মোর্তোজার সঙ্গে একমত? লিখুন আমাদের৷