ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুর শহরের প্রতিটি বস্তি ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা যেখানে বাস করেন সেখানে টয়লেট নির্মাণের মিশন নিয়ে নেমেছেন ৫৫ বছরের নারী কলাবতী দেবী৷
বিজ্ঞাপন
আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে কানপুরের এক বস্তিতে পরিবার নিয়ে বাস করতেন তিনি৷ প্রায় ৭০০ পরিবারের বাস ছিল ঐ বস্তিতে৷ কিন্তু সেখানে কোনো টয়লেট ছিল না৷ বস্তিবাসীরা উন্মুক্ত পরিবেশেই মলত্যাগ করতো৷ বস্তির এই অতি নোংরা পরিবেশের কারণেই কলাবতী প্রথম কয়েক আসনবিশিষ্ট টয়লেট নির্মাণের কথা ভাবেন৷ স্থানীয় ‘শ্রমিক ভারতী' নামের একটি সংস্থার কাছে তিনি তাঁর ইচ্ছার কথা জানান৷ সংস্থাটি তাঁকে সহায়তা করতে রাজিও হয়৷ কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্যখানে৷ প্রথমত কেউ টয়লেটের জন্য জায়গা ছাড়তে রাজি হচ্ছিল না৷ এছাড়া অর্থ সহায়তা কিংবা নির্মাণকাজে শ্রম দিয়ে সহায়তা করতেও কেউ সম্মত হয়নি৷ কেউ কেউ টয়লেট কেন দরকার, এমন প্রশ্নও তোলে৷ অতি উৎসাহী অনেকে এনজিও-র ‘আসল' উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে৷
নিরাপদ পয়ঃপ্রণালি রোগকে দূরে রাখে
বিশ্বে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ টয়লেট ব্যবহার করে না৷ উন্নত পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, এমনকি অর্থনীতির উন্নয়নেও সহায়তা করে৷
ছবি: Patrick Baumann
মানবাধিকারের জন্য সোচ্চার
বার্লিনের কেন্দ্রীয় স্টেশনে এই ব্যক্তিদের মতো বিশ্বের অনেক দেশেই এখন উন্নত স্যানিটেশনের জন্য সোচ্চার হচ্ছে মানুষ৷ বিশ্বে প্রতি তিনজন মানুষের মধ্যে একজনের পরিষ্কার, নিরাপদ টয়লেট নেই৷ খারাপ পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী৷ বিশ্বে ম্যালেরিয়ার চেয়ে খারাপ স্যানিটেশনের কারণে বেশি মানুষ মারা যায়৷
ছবি: John Macdougall/AFP/Getty Images
সুস্থ বিনিয়োগ
খারাপ স্যানিটেশনের কারণে পানিবাহিত রোগ, যেমন টাইফয়েড এবং পাতলা পায়খানা খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে৷ আফ্রিকার অন্যতম বড় বস্তি কিবেরায় স্যানিটেশন একটি বড় সমস্যা৷ তারা প্লাস্টিক ব্যাগেই টয়লেট করে সেটা যেখানে সেখানে ফেলে রাখে৷ তবে এখন এধরনের টয়লেট গড়ে ওঠার কারণে সেখানে রোগের প্রকোপ কমেছে৷
ছবি: DW
যারা শৌচাগার পরিষ্কার করে
ভারতের বেশিরভাগ গ্রামে পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থার এই চিত্রই লক্ষ্য করা যায়৷ ছবিটি ভারতের উত্তরাঞ্চলের মুদালি গ্রামের৷ এখানে মানুষই টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটি করে থাকে৷ ২০ বছর আগে এ ধরনের শৌচাগার নিষিদ্ধ করা হলেও এখনও এ প্রক্রিয়া চলছে৷
ছবি: Lakshmi Narayan
সংকটময় পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ
সংকটময় পরিস্থিতি বা জরুরি কোনো অবস্থায় নিরাপদ স্যানিটেশন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়৷ বিশেষ করে শরণার্থী শিবিরগুলোতে এ সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে
এই ছবিটি ইরাকের কুর্দিস্তানের৷ সিরিয়া সীমান্তের এই এলাকাটিতে শরণার্থীদের চাপ দিন দিন বাড়ছে৷ কিন্তু মানুষের তুলনায় স্থান সংকুলান না হওয়ায় গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে অনেক মানুষকে৷ ফলে নিরাপদ স্যানিটেশন না থাকায় খুব দ্রুত পোলিও ও অন্য পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে৷
ছবি: DW/M. Isso
পরিবেশবান্ধব শৌচাগার
বলিভিয়ার রাজধানী লাপাজ-এর বাইরে এল-আলতো-তে এই শৌচাগারগুলোর অবস্থান৷ নিরাপদ স্যানিটেশনের জন্য তারা এই ব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছে৷ বিশেষভাবে তৈরি এই টয়লেটগুলো পরিবেশবান্ধব, কেননা এখান থেকে পয়ঃবর্জ্য সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ এতে স্থানীয় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন৷
ছবি: Sustainable Sanitation/Andreas Kanzler
ভুল ধরনের শৌচাগার
কেবল উন্নয়নশীল দেশেই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২ কোটি মানুষের ভালো স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই৷ ইউরোপের প্রত্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় মাটিতে গর্ত করে তৈরি শৌচাগার বেশি ব্যবহৃত হয়৷ এর ফলে মাটির নীচ দিয়ে খাবার পানিতে মিশে যায় পয়ঃবর্জ্য৷
ছবি: picture-alliance/CTK
পাহাড়ের চূড়ায় পয়ঃনিষ্কাশন
বিশ্বের এমন কিছু স্থান আছে যেখানে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এমনকি বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই৷ সেখানে কিভাবে স্যানিটেশন ব্যবস্থা কাজ করে তা নিয়ে সক্রিয় টয়লেট বিশেষজ্ঞ লিউক বার্কলে৷ তিনি বিশ্বের প্রত্যন্ত কিছু এলাকা পরিদর্শন করে এ বিষয়ে ‘আ লু উইথ আ ভিউ’ নামে একটি বই লিখেছেন৷ আলাস্কা-র মাউন্ট ম্যাককিনলে এমন একটি জায়গা৷ উত্তর অ্যামেরিকার সুউচ্চ পর্বতচূড়ার দৃশ্য এটি৷
ছবি: Patrick Baumann
8 ছবি1 | 8
এই অবস্থায় কানপুর পৌরসভার কমিশনারের কাছে যান কলাবতী৷ কমিশনার তাঁর প্রস্তাব শুনে বলেন, টয়লেট নির্মাণে পৌরসভার পক্ষ থেকে দুই লক্ষ ভারতীয় মুদ্রা দেয়া হবে৷ বাকি এক লক্ষ রূপি তাঁকেই (কলাবতীকে) জোগাড় করতে হবে৷ কলাবতী জানেন, রিকশাওয়ালা, গৃহকর্মী এবং যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কাছ থেকে টয়লেট নির্মাণের জন্য টাকা সংগ্রহ করা কতটা কঠিন কাজ৷ কিন্তু তারপরও তিনি দমে না গিয়ে কাজ শুরু করেন এবং ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করতে সমর্থ হন৷
এভাবেই শুরু৷ তিনি নিজেও সেসময় রাজমিস্ত্রীর কাজ শিখে নেন৷ পরবর্তীতে নির্মাণকাজের উপর প্রশিক্ষণও নেন৷ এখন কলাবতী নিজেই টয়লেট নির্মাণের কাজ করেন৷ আশেপাশের বস্তিগুলোর অধিবাসীদের টয়লেট নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে সেখানে টয়লেট স্থাপনের কাজ করেন৷ কলাবতীর স্বপ্ন এভাবে কানপুর শহরের সব বস্তি আর নিম্ন আয়ের মানুষেরা যেখানে থাকে সেখানে টয়লেটের ব্যবস্থা করা৷
উল্লেখ্য, ইউনিসেফ-এর হিসেবে, পর্যাপ্ত টয়লেটের অভাবে ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক উন্মুক্ত জায়গায় মলত্যাগ করে৷ বিষয়টি যেমন অস্বাস্থ্যকর, তেমনি নারীদের জন্য সমস্যারও বটে৷