নতুন মোদী সরকারের প্রথম বাজেট অধিবেশনে প্রথম দিন থেকেই উভয়কক্ষ উত্তাল হয়ে ওঠে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইস্যু নিয়ে৷ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যেমন কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, আরজেডি, আম আদমী পার্টি এবং বামদল, একযোগে আগ্রাসী ভূমিকা নেয়৷ স্লোগান দেয়, স্পিকারের মঞ্চের সামনে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানাতে থাকে৷ কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী বীরাপ্পা মইলির অভিযোগ মোদী সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল জনমত নিয়ে সরকার গঠন করে সেই প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে৷ বারংবার বাধা দিতে থাকায় অধিবেশন সারাদিনের মতো মুলতুবি ঘোষণা করেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজন৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
উল্লেখ্য, সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিজেপি-জোট সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা থাকলেও উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় নেই৷ বিল পাশ করাতে তাই সরকারকে বেগ পেতে হবে৷ রাজ্যসভার অনুমোদনে পথ আটকাতে পারে কংগ্রেস ও অন্য বিরোধীদল৷ সেই বাধা অতিক্রম করা হবে মোদী সরকারের পক্ষে এক চ্যালেঞ্জ৷ তবে জয়ললিতার এআইএডিএমকে দলকে পাশে টানতে পারে সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে৷ মহিলাদের সম্পর্কে তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের কুৎসিত মন্তব্যের বিরুদ্ধে সংসদ চত্বরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে বাম মহিলা সংগঠনের কর্মী ও সমর্থকেরা৷
৮ই জুলাই রেল বাজেটের পর ৯ই জুলাই প্রকাশিত হবে দেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা এবং ১০ই জুলাই সাধারণ বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি৷ সাধারণ বাজেটে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকার কী কী ব্যবস্থা নিতে পারে, তাই নিয়ে চলছে কর্পোরেট মহলে জল্পনা৷ অর্থনীতিকদের মতে, সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হবে লাগাম ছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির রাশ টানা৷ সেটা করার উপায় কী? রাজকোষ ঘাটতি কমানো, বেহাল অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করা, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ তথা আর্থিক সংস্কার, ভরতুকির ছাঁটাই করা কিংবা ঢেলে সাজানো ইত্যাদি৷
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও-র হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু-কিশোরকে খনি, কারখানা ও কৃষিখাতের বিভিন্ন চরম প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও-র সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে৷ সেখানে ১৮ বছরের কমবয়সি শিশু-কিশোরদের শ্রমিক কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়৷
ছবি: imago/Michael Westermannভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে তোয়ালে তৈরির কারখানায় কাজ করে এই শিশুটি৷ আইএলও-র হিসাবে এশিয়ায় প্রায় সাত কোটি ৮০ লাখ শিশু কাজ করছে৷ অর্থাৎ ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশু-কিশোরের প্রায় ১০ শতাংশ কাজেকর্মে নিয়োজিত৷
ছবি: imago/imagebrokerলেখাপড়ার পরিবর্তে এই শিশুটি ইট তৈরি করছে৷ চরিম দরিদ্রতার কারণে ভারতের অনেক পরিবার তাদের শিশুদের কাজে পাঠিয়ে থাকে৷ দিন প্রতি মাত্র ৮০ সেন্ট, অর্থাৎ প্রায় ৬৫ বাংলাদেশি টাকা পায় তারা৷ এ জন্য তাদের কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়৷
ছবি: imago/Eastnewsভারতের সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় এক কোটি ২৬ লাখ শিশু-কিশোর শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে৷ তারা পণ্য বিক্রি থেকে শুরু করে রান্না করা, রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করা – সব কাজই করে৷ এমনকি ইট কাটা, মাঠে তুলা তোলা ইত্যাদি কাজও করে থাকে শিশুরা৷
ছবি: imago/imagebroker২০১৩ সালে প্রকাশিত আইএলও-র একটি প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শিশু শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে৷ তাদের অধিকাংশকেই কোনোরকম চুক্তিপত্র ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই কাজ করতে হয়৷
ছবি: AFP/Getty Imagesজাতিসংঘের শিশু কল্যাণ সংস্থা ইউনিসেফ-এর হিসাবে, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লক্ষ শিশু-কিশোর তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করে৷
ছবি: imago/Michael Westermannকম্বোডিয়ায় স্কুল পড়ুয়া শিশু-কিশোরের সংখ্যা অনেক কম৷ বেশিরভাগই তাদের মা-বাবার সঙ্গে কাজ করে৷ এছাড়া হাজার হাজার শিশু রাস্তায় বাস করে কম্বোডিয়ায়৷ এই যেমন এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa২০০০ সালের পর বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমলেও এশিয়ার অনেক দেশ যেমন বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, নেপাল, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে পরিস্থিতির এখনও ততটা উন্নতি হয়নি৷
ছবি: AFP/Getty Images
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভরতুকি ছাঁটাই করা খুব সহজ হবে না, বিশেষ করে খাদ্যা ও সারে৷ ভরতুকি ছাঁটাই করলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়বে৷ কাজেই ভরতুকি হ্রাস ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বিপ্রতীপ জায়গায় রয়েছে৷ ইতিধ্যেই জ্বালানির দাম এক প্রস্ত বাড়ানো হয়েছে৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি এবং ইরাকে অস্থিরতার দরণ আন্তর্জাতিক পেট্রোপণ্য আমদানিতে সমস্যা৷ বৃষ্টির ঘাটতি পূরণে চাষীদের সেচের জন্য বেশি করে পাম্প চালাতে হবে৷ জ্বালানি খরচ বাড়বে চাষীদের৷ তাই অর্থমন্ত্রী যেটা করতে পারেন, তা হলো, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের পথ সহজ ও সুগম করা৷
অন্যদিকে, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর সি. রঙ্গরাজন কমিটির রিপোর্টে দারিদ্র্যের যে পরিবর্তিত সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তা অনুসারে ভারতে প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন গরিব৷ এই সংজ্ঞা অনুসারে শহরাঞ্চলে যে সব পরিবার দৈনিক গড়ে ৪৭ টাকা এবং গ্রামাঞ্চলে ৩২ টাকা ব্যয় করে থাকে, তাঁরা গরিবদের পর্যায়ে পড়ে৷ সেই হিসেবে ভারতে ১২০ কোটি মানুষের মধ্যে গরিবের সংখ্যা ৩৬ কোটি ৩০ লাখ, এর মধ্যে ১০ কোটি শহরাঞ্চলে৷ সংসদের বর্তমান বাজেট অধিবেশনে এই রিপোর্ট নিয়ে ব্যপক বিতর্ক হবে৷