ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার পর প্রথম বিদেশ যাত্রায় ভুটানে পা রাখলেন নরেন্দ্র মোদী৷ দুদিনের সফরে ভারত-ভুটান নিবিড় সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করেন তিনি৷ বুঝিয়ে দেন পররাষ্ট্র নীতিতে হিমালয়-দেশ ভুটানের স্থান প্রথম সারিতে৷
বিজ্ঞাপন
গত ১৩ বছরে এই প্রথম ভারতের কোন প্রধানমন্ত্রী হিমালয়ের কোল ঘেঁষা ভুটানে গেলেন সরকারি সফরে৷ মোদী সরকারের পররাষ্ট্র নীতির প্রথম কথা প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার বন্ধনকে আরো মজবুত ভিত্তিতে দাঁড় করানো৷ সেটা বোঝা গিয়েছিল গত মাসে নতুন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক দেশগুলির শীর্ষ নেতৃত্বের উপস্থিতি৷
সাবেক মনমোহন সিং সরকারের আমলে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল৷ দূরত্ব বাড়ছিল বিশেষ করে পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের সঙ্গে৷ সেই দূরত্বকে কাজে লাগিয়ে চীন ক্রমশই তার ‘‘সম্প্রসারণবাদের'' পাখা বিস্তার করে চলেছে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির ওপর৷ পরোক্ষে ভারতকে কূটনৈতিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করা৷ ভুটানের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে ভুটানকে সে বিষয়ে সতর্ক করে দিতে ভারত-ভুটান দীর্ঘ বহুমাত্রিক সহযোগিতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন মোদী চলতি সফরের আলোচনায়৷
উল্লেখ্য, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে আর্থিক ও বিনিয়োগ সহযোগিতা লাগাতার বাড়িয়ে চলেছে চীন৷ চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ছয় মাসে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে চীনের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ভারতের চেয়ে অনেক বেশি৷ আর্থিক মন্দাহেতু ভারত সেদিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে৷ নির্মাণ করে চলেছে সামরিক ও বাণিজ্যিক অবকাঠামো৷ যেমন পাকিস্তানের গদর ও শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা সমুদ্র বন্দর৷ মিয়ানমারেও গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি হচ্ছে চীনের সহযোগিতায়৷ ভারত মহাসাগরীয় মালদ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য বেছে নিয়েছে চীন৷ বাংলাদেশের চট্টগ্রামে কন্টেনার সার্ভিস গড়ে তুলতে আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে চীন৷ ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও জাতিসত্তার দিক থেকে ভারত-নেপাল সম্পর্কে ঐতিহাসিক সম্পৃক্ততা থাকলেও ইদানীং নেপাল ক্রমশই যেন চীন ঘেঁষা হয়ে উঠছে৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
তাই মোদীর ভুটান সফরের প্রাথমিক লক্ষ্য দুটি৷ অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতা এবং সীমান্তের নিরাপত্তা তথা কৌশলগত সহযোগিতা৷ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহযোগিতা নিয়ে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগে এবং ভুটানের রাজা জিগমে নামগিয়াল ওয়াংচুকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়৷ জলবিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি ও সিমেন্টসহ ১৬টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে ভারত৷ চলতি সফরে মোদী একগুচ্ছ আর্থিক সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেছেন৷ ভারত থেকে গুঁড়ো দুধ, গম, ভোজ্য তেল, ডাল এ অ-বাসমতী চাল রপ্তানিতে পরিমাণগত নিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবেনা৷ দু'দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য নিয়েও মত বিনিময় হয়৷ একাদশ যোজনায় ৪,৫০০ কোটি টাকার প্যাকেজ দেয়া হবে ভুটানকে৷ গুরুত্ব দেয়া হবে কৃষি পরিকাঠামো এবং পর্যটন শিল্পকে৷ ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার খিলোংচু জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন তিনি৷ এতে ভুটানের আয় যেমন বাড়বে, তেমনি ভারত পাবে কম দামে বিদ্যুৎ৷ সীমান্ত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে কেএলও এবং আলফাহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ভারত-বিরোধী নাশকতামূলক কার্যকলাপ দমনে ভুটানের সহযোগিতা চেয়েছে ভারত৷ ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কথায়, ‘‘ভারত-ভুটান সম্পর্ক অনন্য ও বিশেষ৷''