আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠী ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, ২৫শে আগস্ট রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর এক মাসের মধ্যে ৬ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে৷ নিহতের মধ্যে ৫ বছরের কমবয়সি শিশুর সংখ্যা ৭৩০৷
বিজ্ঞাপন
ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (এমএসএফ) জানিয়েছে, বাংলাদেশের শরণার্থী কেন্দ্রগুলোতে জরিপ চালিয়ে তারা জেনেছেন, ২৫শে আগস্ট থেকে ২৪শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৬,৭০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে৷ এমএসএফ বলছে, তাদের জরিপ অনুযায়ী প্রতিদিন প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে আট জনের মৃত্যু হয়েছে এই হিসেবে ধরলে নিহতের সংখ্যা ৯ হাজার ৪২৪ থেকে ১৩ হাজার ৭৫৯ জনও হতে পারে৷ তবে এর মধ্যে অন্তত ৬ হাজার ৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করছেন তারা৷ অথচ সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সরকারের তরফ থেকে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল নিহতের সংখ্যা ৪০০৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
রাখাইনের এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের পুড়িয়ে, পিটিয়ে, ধর্ষণ-নিপীড়ন করে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এমএসএফ৷ নিহতদের মধ্যে এমন ৭৩০ জন শিশুও রয়েছে, যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম৷ এই শিশুদের মধ্যে অন্তত ৬০ ভাগকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ ২৫শে আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৪৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷
জেনিভা ভিত্তিক এই দাতা গোষ্ঠী বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার শরণার্থী শিবিরগুলোতে গিয়ে ১১ হাজার ৪২৬ জন রোহিঙ্গার উপর ৬টি জরিপ চালিয়েছে৷ এমএসএফ এর মেডিকেল ডিরেক্টর ডক্টর সিডনি অং জানিয়েছেন, নিহতের সংখ্যা আসলে কত সেটা সুর্নিদিষ্ট করে বলা খুবই কঠিন৷ জরিপে সেই পরিবারের কথা ধরাই হয়নি, যাদের কোনো সদস্যই হয়ত বেঁচে নেই৷ অথবা এমন কোন পরিবার যারা স্বজনদের হারিয়ে মিয়ানমারেই রয়ে গেছে৷
‘আমাকে ট্যাবলেট খেয়ে ধর্ষণ করেছে’
01:41
সিডনি বলেন, ‘‘আমরা তাদের সাথে কথা বলেছি৷ তারা আমাদের জানিয়েছে, তাদের পরিবারের কে কে মারা গেছে৷ বা তারা অনেককে দেখেছে গুরুতর আহত অবস্থায়, যাদের মৃত বলেই ধরে নিয়েছে তারা৷'' নিহতদের মধ্য ৬৯ ভাগকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ ৯ ভাগকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে এবং ৫ ভাগকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷
জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনকে ‘জাতিগত নিধন' হিসেবে উল্লেখ করেছে৷ অন্যদিকে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ' বলে উল্লেখ করেছে৷
এপিবি/ডিজি (এপি, এএফপি, ডিপিএ)
প্রতিবেদনটি নিয়ে আপনাদের কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷