কলকাতায় আগামী শারদীয়া দূর্গা পুজোয় পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন চার নারী৷ ৬৬ পল্লী দুর্গোৎসব কমিটি এই অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে৷ আয়োজক আর পুরোহিতরা বলছেন শাস্ত্র মেনেই বৈষম্য দূর করার এই উদ্যোগ নিয়েছেন তারা৷
বিজ্ঞাপন
বারোয়ারির ইতিহাসে এমন আগে কখনো হয়নি৷ এর আগে দুর্গাপুজোতে নারীরা আংশিক দায়িত্বে ছিলেন৷ এমনকি নারী পরিচালিত পুজোও হয়েছে৷ কিন্তু অকালবোধন থেকে বিসর্জন অবধি সব কিছুর দায়িত্বে নারীরা কখনও ছিলেন না৷
‘শুভমস্তু’ ও মেয়েরা
নন্দিনী ভৌমিক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক৷ তাদের সংগঠনের নাম ‘শুভমস্তু'৷ তিনি রুমা, পৌলমী, সেমন্তীর সঙ্গে একত্রে ১২ বছর ধরে বিবাহের পৌরহিত্য করছেন৷ করছেন অন্নপ্রাশনের কাজও৷ সামাজিক অনুষ্ঠান, আচার ইত্যাদি বিষয় নিয়েই পড়াশোনো করেছেন৷ সংস্কৃত ভাষায় পিএইচডি করেছেন৷ প্রাচীন সাহিত্যকে নির্ভর করেই তিনি পুরোহিতের কাজ সম্পন্ন করছেন৷ সঙ্গে জুড়েছেন মন্ত্র ও সঙ্গীতকে৷
কলকাতার বুকে তাঁদের কাজের অভাবনীয় জনপ্রিয়তা দেখে আন্দাজ করা যায়, সমাজও গড্ডালিকা প্রবাহের শেকল ছিঁড়ে বেরোতে চায়৷ নন্দিনী বলেন, ‘‘আমাদের কাজের শেষ নেই৷ এত কাজ, যে অনেককেই না বলে দিতে হয়৷ মানুষ গ্রহণ করছে৷ এটা তারই নিদর্শন৷’’ নন্দিনীর জীবন নিয়ে বড়পর্দায় মুক্তি পেয়েছে ঋতাভরী চক্রবর্তী অভিনীত বাংলা ছবি ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি'৷ তাতেও সমাজের প্রথা বদলের কথাই বলা হয়েছে৷
নন্দিনী মনে করেন পুরোহিত হওয়ার অধিকার পুরুষের যেমন আছে তেমন নারীরও আছে৷ এমনকি শাস্ত্রেও এ সংক্রান্ত কোন বাধা নেই৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এটা গণতন্ত্রের দেশ৷ কারো কারো অপছন্দ হতেই পারে৷ কিন্তু আমরা আত্মবিশ্বাসী৷ আমরা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কিছু করি না৷ দু তিন বছর ধরেই আমাদের দুর্গাপুজোতেও ডাক এসেছে৷ তখন শুধু সামাজিক অনুষ্ঠান করার কথা ভেবে রাজী হইনি৷’’
নন্দিনী ভৌমিক
চমক নাকি প্রথা বিরোধিতা
২০১৮ সালে কেরালার শবরীমালায় ঋতুমতী নারীর প্রবেশ নিয়ে চলে আইনি লড়াই, তৈরি হয় তুমুল বিতর্ক৷ তার বিপরীতে কলকাতায় নারীদের হাতে এবার দুর্গাপুজোর দায়িত্ব তুলে দিয়েছে ৬৬ পল্লী দুর্গোৎসব কমিটি৷ আগামী ২২ আগস্ট এই দুর্গোৎসবের খুঁটিপুজোয় চার পুরোহিতই উপস্থিত থাকবেন৷ ‘মায়ের হাতে মায়ের আবাহন’ এই স্লোগানে ৭১তম বছরে কি নেহায়েতই চমক নাকি প্রথা ভাঙার দিকে হাঁটতে চাইছেন তারা? পুজো কমিটির প্রদ্যুম্ন মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা প্রথা ভাঙতে চাইছি না বা চমক দিতেও চাইছি না৷ আমরা মেয়েদের পুরোহিত হিসেবে যুক্ত করতে চাইছি৷ আমরা মহিলা বা পুরুষ হিসেবে কোনো বৈষম্য করছি না৷ অন্য কোনো ক্লাবও যদি একই পথে হাঁটে, তাহলেই আমরা সফল৷’’
সময়ের ডাক
একুশ শতকে দাঁড়িয়ে সময়ের গল্প বদলাতে চেয়েছেন নন্দিনীরা৷ শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বারোয়ারি পুজোতে মেয়েদের পৌরহিত্য একটি জয়৷ শাস্ত্রে পুরুষের প্রতি যে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে, সেটা যদি কিছুটাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে সেই জয় আরও নৈতিক হয়ে উঠবে৷’’
নানা ধর্মে ধর্মীয় আচারে প্রথাভাঙা নারীরা
অনুসারীর সংখ্যায় এগিয়ে থাকা সবগুলো ধর্মেই প্রথা অনুযায়ী নারীরা উপাসনালয় বা ধর্মীয় আচারে নেতৃত্ব দিতে পারেন না৷ তবে সমান অধিকারের দাবিতে সেই প্রথা ভাঙার অনেক উদাহরণও আছে৷
ছবি: Lucas Barioulet/AFP/Getty Images
স্বীকৃতি না মিললেও পাদ্রি
চার্চে নারীরা পাদ্রিদের সহযোগী হিসেবে কিছু দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি পেলেও পাদ্রি হওয়ার অনুমতি নেই৷ তবে অনেক দেশের নারীরা ভ্যাটিকানের এই নিয়ম মানতে রাজি নন৷ তারাও দীক্ষা নিয়ে চার্চ প্রধান হতে চান৷ সেই সুযোগ করে দিচ্ছে রোমান ক্যাথলিক উইমেন প্রিস্টস অর্গ্যানাইজেশন৷ ভোগ ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের অধীনে ২০৫ জন নারী পাদ্রি আছেন৷ তারা স্বাধীনভাবে পরিচালিত বিভিন্ন চার্চে দায়িত্ব পালন করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Rumpenhorst
মসজিদেও ব্যতিক্রমী চিত্র
কিছু দেশে পুরুষদের ইমামতিতে নারীরা আলাদাভাবে জামাতে অংশ নিতে পারেন৷ মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে তাদের ইমামতির অনুমতি নেই৷ তবে ক্যানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের কিছু দেশে নারী ইমামের নেতৃত্বে নারী মুসল্লিদের নামায পড়ার নজির আছে৷ ২০১৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৬০ জন নারী-পুরুষ ফ্রান্সের একটি মসজিদে দুই নারীর ইমামতিতে জামাতে অংশ নেয়ার খবর আসে রেডিও ফ্রান্সে৷ (ছবি: ফ্রান্সের ইমাম কাহিনা বাহলুল)
ছবি: Lucas Barioulet/AFP/Getty Images
বার্লিনের নারী ইমাম সাইরান আতিস
আরো ব্যতিক্রমী উদাহরণ তৈরি করেছেন সাইরান আতিস৷ তুর্কি বংশোদ্ভূত এই জার্মান প্রশিক্ষণ নিয়ে বার্লিনের ইবনে রুশদগ্যোটে মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন৷ ২০১৭ সালে আতিস নিজেই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন৷ সেখানে যেকোনো ধর্মের মানুষেরই প্রবেশাধিকার রয়েছে এবং নারী-পুরুষ একসঙ্গেই প্রার্থনায় অংশ নিতে পারেন৷ আতিস ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের মসজিদে কাউকে নিকাব বা বোরকা পরে আসতে হবে না৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Gambarini
ইতিহাস বদলানো দুই নারী
ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু ধর্মে ঋতুমতী নারীদের মন্দিরে প্রবেশ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাধা দেয়া হয়৷ ২০১৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এর বিরুদ্ধে রায় দেয়৷ এরপর ঋতুমতী অবস্থায় কেরালার শবরীমালার ‘আয়াপ্পা’ মন্দিরে প্রবেশ করে ইতিহাস গড়েন দুই নারী৷ ঘটনাটি ভারতে ব্যাপক আলোড়ন তোলে৷ রক্ষণশীল হিন্দুরা ঋতুমতী নারীদের মন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার পুনর্বহাল চাইলে সুপ্রিম কোর্ট নতুন আইন তৈরির কথা জানায়৷
ছবি: Getty Images/A. Sankar
রীতি ভেঙে পৌরোহিত্যে
প্রথা অনুযায়ী হিন্দুদের পূজা বা বিয়েতে নারীরা পুরোহিত হতে পারেন না৷ তবে এই নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করছেন অনেকে৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতির শিক্ষক নন্দিনী ভৌমিক পুরোহিত হিসেবে একাধিক বিয়ে পড়িয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন৷ মহারাষ্ট্রেও একটি পুরোহিত পাঠশালা নারীদের পৌরোহিত্যের দীক্ষা দিয়ে আসছে৷ দু'জন হিন্দু বিধবাকে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের একটা মন্দিরে পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল ২০১৬ সালে৷
ছবি: PURONATUN/Arshavi Banerjee
মিয়ানমারে এক নারী ভিক্ষুর লড়াই
মিয়ানমারসহ দক্ষিণ-র্পূব এশিয়ার দেশগুলোতে নারী ভিক্ষুরা পুরুষের সমান মর্যাদা পান না৷ অনেক বৌদ্ধ স্থাপনায় তাদের প্রবেশ নিষেধ৷ এমনকি বসা যায় না পুরষ ভিক্ষুদের সামনেও৷ মিয়ানমারে এই পরিস্থিতি বদলাতে চান কেতুমালা৷ সমঅধিকার আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি ফাউন্ডেশন৷ এই সংস্থাটির ৪,৮০০ টি বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে৷ নারী ভিক্ষুদের ক্ষমতায়নের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও চালু করেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. A. Main
6 ছবি1 | 6
শাস্ত্রে মেয়েদের মন্ত্রোচ্চারণ বা উপবীত ধারণের অনুমোদন নেই৷ ঋতুমতীদের নিয়েও অনেক ট্যাবু৷ নন্দিনী বলেন, ‘‘ওটা তখনকার সময়ের ইতিহাস৷ আমরা যখন ঋতুমতী হই, তখন অশুচি দূরের কথা, সেটা উৎসবের দিন হওয়া উচিত৷ মাতৃত্ব এত সুন্দর তো ঋতুর জন্যই৷ সুতরাং শুচিতা অন্তরে, দেহে নয়৷’’ নারীরা এখন সর্বত্র উচ্চপদে আসীন৷ ধর্ম, সংস্কারের ক্ষেত্রে বাধা ভাঙার চেষ্টা চলছে৷ ‘শুভমস্তু' যে বিয়েতে পৌরোহিত্য করে, সেখানে কন্যাদান বা কনকাঞ্জলির মতো আচার বাদ রাখা হয়৷ এবার তাদের সংস্কারের পতাকা উড়বে পুজো মণ্ডপে৷