প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা: যাদের বেশি দরকার তারাই অবহেলিত
ফয়সাল শোভন
৫ এপ্রিল ২০২০
প্রধানমন্ত্রীর ধারণকৃত সংবাদ সম্মেলন অনলাইনে অধীর আগ্রহে শুনলাম৷ ক্রান্তিলগ্ন পার করা বাংলাদেশের অনেকেই নিশ্চয়ই প্রত্যাশা নিয়ে বসেছিলেন এই দুর্যোগে আশ্বস্ত হবার জন্য৷
বিজ্ঞাপন
রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য আগেই পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ দুই ভাগ সুদে যা ঋণ হিসেবে পাবেন উদ্যোক্তারা৷ তবে গত দুই দিনের ঘটনা আর সংবাদে মনে হচ্ছে তৈরি পোশাক খাতের মালিকরা এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি৷ তারা আশা করেছিলেন বিনা শর্তে অফেরতযোগ্য টাকা৷ এই অসন্তোষ প্রকাশেই হাজার হাজার শ্রমিককে তারা পায়ে হাঁটিয়ে কর্মস্থলে ফিরতে বাধ্য করিয়েছেন এমন খবরও আসছে৷
রোববার প্রধানমন্ত্রী আরো বিস্তৃত আকারে প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিলেন৷ সেখানে সরাসরি অবশ্য তৈরি পোশাক খাতের জন্য কিছু বলা নেই৷ তবে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য যে চার ধরনের আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে তার অন্তত তিনটি থেকেই তৈরি পোশাক তথা বস্ত্র খাতের মালিকরাও চাইলে কম বেশি সুবিধা পাবেন৷ বৃহৎ শিল্প হিসেবে সাড়ে চার শতাংশ সুদে ৩০ হাজার কোটি টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার ইউডিএফ কিংবা সাত শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার নতুন ঋণ তহবিলের আওতার বাইরে থাকছেন না তারাও৷
বিশ্ব অর্থনীতিতে আসন্ন মহামন্দার ধাক্কা ঠেকাতে সব দেশের সরকারই এখন কৌশল খুঁজছে৷ প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উন্নত থেকে উন্নয়নশীল সবাই অর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে৷ ক্যানাডা, র্জামানি, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশগুলোতে যা জিডিপির সাড়ে তিন থেকে দশ ভাগের মত৷ তারা এই অর্থের বড় অংশটাই বিভিন্ন কোম্পানি, শিল্প প্রতিষ্ঠানে ঢালছে৷ কারণ সেখানে শতভাগ কর্মসংস্থানই আনুষ্ঠানিক খাত নির্ভর৷ তারপরও বেকার, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যেও এইসব ঘোষিত প্যাকেজে নির্দিষ্ট অঙ্কের বরাদ্দ রয়েছে৷ এরিমধ্যে যোগ্যরা সেখান থেকে বিশেষ ভাতা পেতেও শুরু করেছেন৷
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি, টাকার অঙ্কে নেহায়েত কম নয়৷ জিডিপির হিসাবে প্রায় তিন ভাগের মত৷ কিন্তু এই অর্থ দেশের কত শতাংশের জন্য? যদি ধরেও নেই শিল্প খাতে যারা কাজ করেন এই অর্থে তাদের সবার জীবিকা, মজুরির নিশ্চয়তা মিলবে তাও সংখ্যাটি বড়জোর দুই কোটি হয়৷ বাস্তবতাটা তারপরও ভিন্ন৷
পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কর্মসংস্থানে নিযুক্ত ছয় কোটির বেশি মানুষ৷ এর ৮৫ ভাগ বা ৫ কোটির বেশি রয়েছেন অনানুষ্ঠানিক খাতে৷ তাদের মধ্যে রয়েছেন কৃষি, র্নিমাণ, পরিবহন সহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিক, দিনমজুর, ছোট দোকানদারসহ প্রতিদিনের গ্রাসাচ্ছদনের জন্য লড়াই করা মানুষেরা৷ যাদের বেশিরভাগেরই একদিন রোজগার না থাকা মানে এক একটি পরিবারের উপোস থাকা৷ এই পাঁচ কোটি মানুষের বাইরে আছেন দরিদ্র্য-হতদরিদ্র্য, বেকারসহ আরো কয়েক কোটি৷ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৭২ হাজার কোটি টাকায় এই মানুষগুলোর মুখ খুঁজে পাওয়া যায় না৷
জিডিপির বছর বছর উল্লম্ফন আর মুষ্টিমেয়ের আর্থিক উন্নয়নের গল্পের আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন দরিদ্ররা৷ কিন্তু প্রকৃত চিত্রটা এখন ক্রমশ নগ্ন হয়ে উঠেছে৷
প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য অবশ্য সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানোর কথা বলেছেন৷ বিভিন্ন ভাতার সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি, নগদ অর্থ প্রদান, দশ টাকা মূল্যের চাল বিতরণ এমন পাঁচটি উদ্যোগের কথা তিনি জানিয়েছেন৷ এজন্য কত টাকার বরাদ্দ রয়েছে, স্পষ্টত কত মানুষকে তার সরকার এর আওতায় আনতে চায় সেটি পরিস্কার করতে পারেননি তিনি৷
অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ৫ কোটি শ্রমিক, চার কোটি দরিদ্র্য, শ্রমশক্তির ২৭ লাখ বেকারের ক্ষুধা নিবারণের কথা দয়া করে সবার আগে ভাবুন৷
অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে কোন দেশ কী করছে
করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে৷ প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হওয়াসহ আছে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কা৷ তবে উন্নত দেশগুলো এই পরিস্থিতি সামলাতে বিভিন্ন আর্থিক ব্যবস্থাও নিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Jordan
জার্মানি
সব ধরনের কোম্পানি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ১১০ কোটি ডলারের ঋণ দিচ্ছে জার্মান সরকার৷ দুর্যোগকালীন এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মোট ৮০ হাজার কোটি ডলারের তহবিল রয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বচ্ছলতা বজায় রাখতে দেয়া হচ্ছে কর-ছাড়৷ দেরিতে ঋণ পরিশোধে গুণতে হবে না জরিমানা৷ প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে দেয়া হবে সাড়ে ১৪ কোটি ইউরো৷
অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দিতে ২১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে স্পেন৷ ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানি, কর্মী আর আর্থিক অস্বচ্ছলদের সুরক্ষায় এই অর্থ ব্যয় করা হবে৷ এর মধ্যে শুধু সামাজিক নিরাপত্তায় খরচ করা হবে প্রায় ৬৪ কোটি ডলার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AAB. Akbulut
পর্তুগাল
১৮ মার্চ থেকে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে পর্তুগাল৷ এখন পর্যন্ত এক হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার৷ এরমধ্যে ৩২২ কোটি ডলার পর্যটন, বস্ত্র, কাঠসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ সহায়তা হিসেবে দেয়া হবে৷ ৫৩৬ কোটি ডলার আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে কর সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে৷
ছবি: Reuters/M. F. Lopes
ফ্রান্স
প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ডলার সহায়তা তহবিলের প্রকল্প হাতে নিয়েছে ফ্রান্স সরকার৷ এর বড় একটি অংশ দেয়া হবে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে৷ রেস্টুরেন্ট, দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কোয়ারান্টিনের কারণে যেসব কর্মী কাজে যোগ দিতে পারছেন না, তাদের জন্য কয়কশ’ কোটি ডলার ব্যয়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Marin
যুক্তরাজ্য
করোনা ভাইরাসের কারণে ১৪৫০ কোটি ডলারের জরুরি আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে যুক্তরাজ্য৷ জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা এবং সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোকসান মেটাতে এই টাকা দেয়া হবে৷ পাশাপাশি খুচরা ব্যবসা এবং পর্যটন শিল্পের জন্য ৪০ হাজার কোটি ডলারের ঋণ তহবিলও রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/empics/PA Video
যুক্তরাষ্ট্র
সম্প্রতি ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের একটি সহায়তা প্যাকেজের অনুমোদন দিয়েছে সেনেট৷ স্বাস্থ্য বিমা ছাড়াই করোনার পরীক্ষা করানো, স্কুলগামী শিশুদের জন্য খাবার সরবরাহ, কর্মীদের ১০ দিনের অসুস্থতাজনিত এবং কিছু ক্ষেত্রে ১২ সপ্তাহের বেতনসহ ছুটির পেছনে এই টাকা ব্যয় হবে৷ পাশাপাশি এক ট্রিলিয়ন ডলারের আরেকটি প্রণোদনা প্যকেজের জন্য আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন৷
ছবি: Reuters/L. Millis
ক্যানাডা
ক্যানাডার জন্য পাঁচ হাজার ৬৪০ কোটি ডলারের সহায়তা দেয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো৷ এই অর্থ দেশটির জিডিপির তিন শতাংশ ৷ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর-ছাড়, কর্মীদের বেতন, সমাজে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ব্যয় হবে এই অর্থ৷
ছবি: picture-alliance/empics/M. Sudoma
অস্ট্রেলিয়া
১১০০ কোটি ডলারের আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার৷ ৬৫ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষকে এককালীন ৪৫১ ডলার করে দেয়া হবে এই তহবিল থেকে৷ পাশাপাশি এক লাখ ২০ হাজার শিক্ষানবিশ চাকুরিজীবী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতেও খরচ করা হবে এখান থেকে৷ অন্যদিকে অর্থনীতিকে সচল রাখতে ঋণের সুদহার কমিয়ে দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Carrett
তুরস্ক
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ১৫৪০ কোটি ডলারের ব্যয় পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে তুরস্ক৷ ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা’ শিরোনামের এই প্যাকেজটির আওতায় মোট ২১ টি খাতে খরচ করা হবে৷ এর মধ্যে অবসরকালীন ভাতা বৃদ্ধি, ব্যবসা সহযোগিতা, মূল্য সংযোজন কর হ্রাসসহ খুচরা, ইস্পাত, গাড়ি ও পর্যটন শিল্পে আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে৷