পাকিস্তানের ২৫ জুলাইয়ের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা আছে ইমরান খানের৷ কিন্তু আফগানিস্তানে মার্কিন ভূমিকার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান, ট্রাম্পকে ফেলতে পারে জটিলতায়৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রে ইমরান খানের বড় পরিচিত একজন সমাজকর্মী হিসেবে৷ নিজের দেশে তিনি একটি বিশ্বমানের হাসপাতাল পরিচালনা করেন৷ একজন ক্যারিশম্যাটিক চেহারার অসাধারণ সাবেক খেলোয়াড় হিসেবেও পশ্চিমা নারীদের মধ্যে তিনি বেশ জনপ্রিয়৷ কিন্তু এখনো ইমরান একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে ওয়াশিংটনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি৷
মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে ডয়চে ভেলে জানতে চেয়েছিল, ইমরান প্রধানমন্ত্রী হলে তারা তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চান কিনা৷ সরাসরি উত্তর না দিলেও, কূটনৈতিক জবাবেই মিলেছে আভাস৷
‘‘মার্কিন সরকার পাকিস্তানে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের পক্ষে৷ সে দেশের নাগরিকেরা যাঁকে নির্বাচিত করবেন, আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নতির লক্ষ্যে একই ধরনের এজেন্ডা নিয়ে তাঁর সাথেই কাজ করতে আমরা প্রস্তুত,’’ বলছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র৷
এই বক্তব্যই তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই দলের প্রধান ইমরান খান সম্পর্কে মার্কিন সরকারের মনোভাব স্পষ্ট করে৷
ভুট্টো বা নওয়াজ শরিফের সাথে কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে কাজ করতে হয়, তা জানা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের৷ কিন্তু ইমরান খানের ক্ষেত্রে তা নয়৷ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগানিস্তান ও ভারতে জঙ্গি কার্যক্রম ঠেকাতে ইমরানকে ওয়াশিংটনের সঙ্গেই কাজ করতে হবে৷
খেলার অঙ্গন থেকে রাজনীতিতে
এমন ঘটনা কিন্তু নতুন নয়৷ খেলোয়াড় থেকে রাজনীতিবিদ হিসেবেও সফল– এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে৷ দেখুন...
ছবি: picture alliance/dpa/B. von Jutrczenka
জর্জ উইয়াহ: গণদাবির মুখে আবার রাজনীতিতে
লাইবেরিয়ার ফুটবলার হয়েও সেই ১৯৯৫ সালে ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলেন উইয়াহ৷ ফুটবলকে বিদায় জানানোর কিছুদিনের মধ্যেই নাম লেখান রাজনীতিতে৷ ২০০৫ এবং ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছিলেন৷ কিন্তু দু’বারই হেরে যান৷ গণদাবির মুখে আবারও প্রার্থী হন ক্লাব ফুটবলের এই সাবেক বিশ্বতারকা৷ হয়ে যান প্রেসিডেন্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Jallanzo
ভিতালি ক্লিচকভ: বক্সার থেকে মেয়র
ভ্লাদিমির ক্লিচকভের মতো তাঁর ভাই ভিতালিও ছিলেন ইউক্রেনের হেভিওয়েট বক্সার৷ তবে প্রায় এক দশক ধরে তিনি রাজনীতিবিদ৷ কিয়েভের মেয়র হয়েছেন তিনি ২০১৪ সালে৷
ছবি: picture alliance/dpa/B. von Jutrczenka
মানি পাকিইয়াও: ফিলিপাইন্সের ভবিষ্যৎ নেতা?
তিনিও সাবেক তারকা বক্সার৷ বক্সিং গ্লাভস তুলে রাখার পর থেকে তিনিও রাজনীতিতে সক্রিয়৷ ফিলিপাইন্সের প্রেসিডেন্ট দুতার্তের ঘোর সমর্থক তিনি৷ রাজনীতিবিদ হিসেবে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল৷ ইতিমধ্যে স্বয়ং দুতার্তে একাধিকবার বলেছেন, তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে পাকিইয়াওকে দেখতে চান তিনি৷
ছবি: Getty Images/M.Dejeto
ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতানো সেই রোমারিও
১৯৯৪ সালে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন তিনি৷ পেলে আর রোনাল্ডো ছাড়া ব্রাজিলের বাকি সব ফুটবলারের চেয়ে দেশের হয়ে তাঁর গোল এখনো সবচেয়ে বেশি৷ ফুটবলের মতো তিনিও রাজনীতিতে সফল৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ-এর সোশ্যালিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী তিনি৷ রিও ডি জানেরোর সেনেটর তিনি৷
ছবি: Getty Images/E.Sa
আর্নল্ড শোয়ার্ৎসেনেগার: দ্য টার্মিনেটর
হ্যাঁ, শোয়ার্ৎসেনেগার হলিউডের সুপারহিট মুভি ‘দ্য টার্মিনেটর’-এর নায়ক হিসেবেই বেশি পরিচিত৷ পরবর্তী জীবনে যে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার মেয়র হয়েছিলেন তা-ও অনেকের জানা৷ কিন্তু শোয়ার্ৎসেনেগার যে বডিবিল্ডার হিসেবে মাত্র ২৩ বছর বয়সে ‘মিস্টার অলিম্পিয়া’ হয়েছিলেন, সেটা কি জানেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
বিল ব্র্যাডলি: এনবিএ-র চেয়েও যেন রাজনীতিতে সফল
এনবিএ-র ‘হল অফ ফেম’-এ নাম আছে তাঁর৷ ছিলেন নিউ ইয়র্ক নিক দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য৷ রাজনীতিতে যোগ দেয়ার পরও সাফল্য পিছু নেয়৷ ডেমোক্র্যাট দলের হয়ে নির্বাচন জিতে প্রায় দু দশক ছিলেন নিউ জার্সির মেয়রের দায়িত্বে৷ ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলের মনোনয়নও চেয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/P.Newcomb
সেবাস্টিয়ান কো: অলিম্পিক সোনাজয়ী থেকে....
১৯৮০-র অলিম্পিকে ব্রিটেনের হয়ে ১৫০০ মিটার দৌড়ের সোনা জিতেছিলেন সেবাস্টিয়ান কো৷ রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে সেই ১৯৯২ সালেই হয়েছিলেন সংসদ সদস্য৷ ব্রিটেনের উচ্চ কক্ষের ‘লর্ড’ হয়েছেন ২০০০ সালে৷ তাঁর সাম্প্রতিক সাফল্য অবশ্য ক্রীড়ঙ্গনেই৷ ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিক আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সেবাস্টিয়ান কো এখন আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সভাপতি৷
ছবি: Getty Images/S. Powell
জেরাল্ড ফোর্ড: কলেজ ফুটবলার থেকে প্রেসিডেন্ট
রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগ করায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন জেরাল্ড ফোর্ড৷ খেলাধুলার সঙ্গে তাঁরও একটা যোগাযোগ ছিল৷ ১৯৩২ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের কলেজ ফুটবল দলে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Public Domain/Gerald R. Ford Library
ইমরান খান: ক্রিকেটার থেকে প্রধানমন্ত্রী
ক্রিকেটের ভালো অনুসারীরা ইমরান খানকে অবশ্যই চেনেন৷ পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক, বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার – এ সবের বাইরেও যে পরিচয়টি বড় হয়ে উঠেছে তা হলো, ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি৷ ক্রিকেট ছাড়ার পরই গড়ে তোলেন ‘তেহরিক-ই ইনসাফ’৷ এ দলের নেতা হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা শুরু করেছেন সে-ও অনেক দিনের কথা৷
ছবি: DW/S. Khan Tareen
9 ছবি1 | 9
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় মার্কিন কূটনীতিক ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা প্রায়ই ইমরান খানের একটি কথা মনে করিয়ে দেন৷ ইমরান একবার বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা করতে আসা প্রতিটি মার্কিন ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করবেন৷
তাঁর এমন কথায় পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মধ্যেও ভয় ঢুকেছিল৷ জেনারেলরা ভাবছিলেন, ইমরান নির্বাচিত হলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে টানাপড়েন আরো জটিল পরিস্থিতিতে গড়াবে৷
সময় গড়াতে ইমরানও নিজের বক্তব্যে রাশ টেনেছেন৷ পরবর্তীতে পস্তাতে হবে না, এমন কথা বলার চেষ্টা করলেও মাঝেমধ্যেই মুখ ফসকে বেফাঁস কথাও বলে ফেলেছেন৷
উড্রো উইলসন সেন্টার ফর স্কলারসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলমান বলছেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চিন্তাটা খুব একটা সুখের নয়৷ কারণ, তিনি এবং তাঁর দল বরাবরই অ্যান্টি-অ্যামেরিকার ভূমিকা নিয়ে এসেছেন, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ঠিক উলটো৷’’
কুগেলমান মনে করেন, ‘‘একই সাথে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর বিশাল একটি ভূমিকা থাকে৷ ফলে, যদি সম্ভাব্য পিটিআইর সরকারও সুর নরম করতে বাধ্য হয়, তাতেও আমি আশ্চর্য হবো না৷’’
এই মাসের শুরুর দিকে আফিগানিস্তানে সাময়িক যুদ্ধবিরতির জন্য পাকিস্তানের সমর্থন প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের৷ কিন্তু সে সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ না করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরাসরি দেশটির সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়াকে ফোন দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও৷
জেনারেল বাজওয়া শুধু মার্কিন অনুরোধই রাখেননি, কাবুলে গিয়ে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনাও করে এসেছেন৷
যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হোসেইন হাক্কানি বলছেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র অন্য পাকিস্তানি নেতাদের যেভাবে সামলেছে, ইমরান খানও তার ব্যতিক্রম হবেন না৷’’
‘‘জুলফিকার আলী ভুট্টোও নির্বাচনের আগে মার্কিনবিরোধী ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ কিন্তু তিনিও নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নেয়ার আগে রিচার্ড নিক্সনের সাথে দেখা করে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে গিয়েছেন৷’’
তবে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে বলে মনে করেন হাক্কানি৷
ফলে নির্বাচিত হলেও রাজনীতির পিচে ইমরান খানের ইনিংস কত দীর্ঘ হয়, তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে দেশের ভেতরে-বাইরের অন্য ‘খেলোয়াড়দের’ সমর্থনের ওপর৷