পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মা নাসিমা আখতারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম সাক্ষরিত এক বিবৃতির দোহাই দিয়ে মঙ্গলবার খবরটি জানিয়েছে আমাদের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷
প্রেসসচিবের সই-সাবুদ যখন আছে, তখন ধরে নেওয়া যায়, প্রধানমন্ত্রী সিনহা হত্যার বিচার করবেন৷ কিন্তু এই সন্দেশ পড়ে খুশি হবো কি বেজার তাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না৷ সরকারপ্রধানকে যে নিজে ফোন করে মরহুমের আত্মীয় স্বজনকে বলতে হয় যে, তিনি দেখবেন যেন বিচার হয়, তাতে এই দেশে আলাদা বিচার বিভাগ বা আইনের শাসন, এমনকি ২০২০ সাল লাগে না৷ কেমন জানি মধ্যযুগের রাজতন্ত্র রাজতন্ত্র লাগে!
রাষ্ট্রের দমন কৌশল
বাংলাদেশে যখন যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল কিংবা বিরুদ্ধমত দমন করেছে৷ কখনও আইন, কখনও প্রশাসন, কখনও সহযোগী সংগঠনের পেশি শক্তি ব্যবহার করে ভিন্ন মতের মানুষের উপর চালানো হয়েছে নির্যাতন৷
ছবি: Sony Ramany/AFP
জনতার মিছিলে পুলিশের গুলি
সরকার বিরোধী প্রতিবাদ কিংবা মিছিলে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনা বারবার ঘটেছে বাংলাদেশে৷ এরশাদের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করে৷ এমন ঘটনা অব্যাহত ছিল গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও৷ ২০০৬ সালে কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে গণবিক্ষোভে ২০ জন নিহত হয়েছে৷
ছবি: DW/H. U. Rashid Swapan
মিছিল-সমাবেশে বাধা
নব্বইয়ের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো প্রতিপক্ষকে রাস্তায় প্রতিবাদে বাধা দেয়৷ চলে পুলিশি হামলা, নির্যাতনের ঘটনা৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়েছে৷ শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় নাগরিক সমাজের প্রতিবাদেও বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটছে৷
ছবি: bdnews24.com
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন ৩৬১ জন৷ গত বছর নিহত হয়েছেন ৪২১ জন, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি৷ এসব ক্রসফায়ারের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাসানোর অভিযোগ আছে৷
ছবি: bdnews24.com
গুম কিংবা নিখোঁজ
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইএইচআর) হিসাবে ২০০৯-১৮ পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৫০৭ জন৷ এর মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ১৫৯ জনের হদিস মেলেনি৷ গত ১০ বছরে নিজেদের ৩০০ এর বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Getty Images/AFP/O. Kose
মামলার হয়রানি
সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ৪,৪২৯টি মামলা করা হয়েছে৷ যাতে চার লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫ জনকে আসামি করা হয় বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি৷ সেখানে এমনকি মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের উপর ককটেল ছুড়ে মারার মামলা হয়েছে৷ ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে আশি বছরের প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধেও৷
ছবি: bdnews24.com
পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে বরাবরই ব্যবহার করে আসছে বিপক্ষ বা ভিন্নমত দমনে৷ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে এমন পেশিশক্তির ব্যবহার আরও প্রকট হয়েছে৷ ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নির্যাতনে বুয়েটে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে৷ ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ও কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর বারবার হামলার ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: bdnews24.com
নিষ্পেষণমূলক আইন
ভিন্নমত দমনে আশ্রয় নেয়া হয় আইনেরও৷ ২০১৫ সালে করা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, ব্লগার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়েছে৷ সেটি বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হলে সেখানেও একই ধরনের বিভিন্ন ধারা রাখা হয়৷ এই আইনে আটক হয়ে জেলখানায় বিনা বিচারে মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
গণমাধ্যমের উপর চাপ
বাংলাদেশে এখন বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যম থাকলেও তাদের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ বিভিন্ন সময়ে টিভি চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেয় সরকার৷ মালিকানা, বিজ্ঞাপন বন্ধে চাপ দেয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে গণমাধ্যমগুলো নিজেরাই এখন সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ
২০১৯ সালের ২৯ জুন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, ঐ বছরের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে বাংলাদেশ৷ তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের এখন সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হচ্ছে রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে যে কোনো ওয়েবসাইটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এটি বড় অর্জন৷’’
ছবি: picture-alliance/chromorange/C. Ohde
ফোনে আড়িপাতা
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিভিন্ন মানুষের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটছে৷ ইউটিউব বা গণমাধ্যমে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, লঙ্ঘন করা হচ্ছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা৷
ছবি: imago/avanti
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যা বলছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৯ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ সভা-সমাবেশ ও বাকস্বাধীতার ওপর নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বিরোধী দলসহ নাগরিকদের প্রতিবাদ ও সংবাদ মাধ্যমের ওপর হামলা, মামলা এবং বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: AP/DW
11 ছবি1 | 11
তারপরেও যদি ধরে নেই, মাননীয় বলেছেন বিচার করবেন, তাতে আমার খুশি হতে এত কষ্ট লাগছে কিসে? কেন খুশি হচ্ছি না? বলছি৷ ধরেন আমি দেশে ফিরে গেলাম৷ কোনো এক পুলিশ কর্মকর্তার অথবা র্যাবের একজনের অথবা কোনো এক নেতার অথবা অন্য যে কারোর চোখে তেরছা করে সূর্যের আলো পড়েছে বলে তার বা তাদের মেজাজ খারাপ হলো৷ অথবা মেজাজ খারাপেরই কী প্রয়োজন৷ হয়তো মেজাজ ভালো৷ ছোট করে চুল কেটে আমি সানগ্লাস পরেছি বলে তার মনে হলো আমাকে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার৷ আমাকে থামানো হলো, নামানো হলো৷ এক কথায় দুই কথায় বুকে গুলি করে দেওয়া হলো৷ চুল ছোট হতে পারে, কিন্তু আমি তো আর্মিতে চাকরি কখনো করি নাই৷
প্রধানমন্ত্রী কি আমার পরিবারকে ফোন দেবেন? আর প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস না দিলে আমি তো মরেই গেছি, আমার পরিবার কি বিচার পাবে? উত্তর হলো না, পাবে না৷ কারণ, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস যে বিশেষ ঘটনা বা আলাদা তাৎপর্য বহন করে তা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ সাংবাদিক ইহসানুল করিমের বিবৃতিতে স্পষ্ট৷ আর এই কয়দিনে এটাও স্পষ্ট যে, যাকে তাকে যখন তখন যেখানে সেখানে মেরে ফেলার লাইসেন্স কারো না কারো রয়েছে৷ কখনোসখনো সেই লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়, নতুন লোকে আবার লাইসেন্স পায়, এই যা!
প্রয়াত মেজর সিনহা আমার বছর দশকের ছোট৷ সুদর্শন, হাসি খুশি৷ মুক্তিযোদ্ধা, উপ সচিবের সন্তান৷ সামরিক গোরস্তানে দাফন করার সময় তার মা আবেগঘন এক বার্তা শুনিয়েছেন সবাইকে৷ আমরা, মানে এই যারা দেশ, সোশ্যাল মিডিয়ার ভদ্রলোক বা সুশীল, তাদের মনে হয়েছে একে আমার আপন ভাতিজা, ভাই বা খালাতো ভাইয়ের মতো লাগে৷ তাই আমাদের নিশ্চিত করে মনে হয়েছে, ইনি ইয়াবা ব্যবসা করতে পারেন না৷ পুলিশ মিথ্যা বলছে৷ তাই আমরা রুখে দিয়েছি৷ ফুঁসে উঠেছি৷ কারণ, সিনহা আমাদেরই মতো৷ কিন্তু আমি সহস্রবারের মতো আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, একটা লোক অপরাধী না হলে যেমন তাকে পুলিশ গুলি করতে পারে না, তেমনি একটা লোক অপরাধী হলেও পুলিশের কোনো অধিকার নাই তাকে গুলি করার৷ এবং আপনার আমার কারো অধিকার নাই তার বিচার করার৷ বিচারের দাবি তোলা যেতে পারে, কিন্তু ছেলেধরা সন্দেহে আমরা যে এক নারীকে, এক মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলাম, তা যে ঠিক হয়নি তা বুঝতে পেরেছেন তো?
সবশেষে প্রধানমন্ত্রীকে বলি, আপনার সামনে দুটি অপশন৷ আপনি নির্দেশনা দেন যাতে একজন মানুষও বিনা বিচারে না মরে, অথবা যারা এমনে মারা যায়, তাদের সকলের আত্মীয় স্বজনরে ফোন করে বিচার করবেন, এই আশ্বাস দেন৷
আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেষ অনুরোধ (আপাতত), আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ইয়াবা-দেশি অস্ত্র-ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসী গল্পটি বদলাতে বলেন৷ আপনি না বললে এই গল্পটিও বদলাবে না, আকাশ আর বাতাসের সর্বত্র বিরাজমান লক্ষণসমূহ তাই জানায়৷
নিতান্ত বদলাতে না পারলে গল্পটির নাম দেওয়া যেতে পারে৷ যেমন ধরেন, গল্পের নাম ৩৪ নম্বর সত্যভাষণ, সংক্ষেপে ৩৪ নম্বর৷ পুলিশ বিবৃতিতে বলবে, খালেদ মুহিউদ্দীন মারা গেছে ৩৪ নম্বরে.. লাশ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে..জব্দ করা মালামাল যথাসময়ে আদালতে জমা দেওয়া হবে৷