হিন্দুকুশ পর্বতে ভূমিকম্প। কেঁপে উঠল আফগানিস্তান, পাকিস্তান, উত্তর ভারত। পাকিস্তানে নয় ও আফগানিস্তানে দুইজনের মৃত্যু।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার রাতে হিন্দুকুশ পর্বতে ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ছয় দশমিক পাঁচ। ভূমিকম্পের মাত্রা এতটাই ছিল যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তরাংশে তা অনুভূত হয়। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী আফগানিস্তানে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। জার্মান সংবাদসংস্থা ডিপিএ জানিয়েছে, পাকিস্তানে অন্তত নয় জনের মৃত্যু হয়েছে। জিও টিভি জানাচ্ছে, মৃতদের মধ্যে দুইজন নারী। আহত হয়েছেন ১৬০ জন।
মধ্য এশিয়ার পারায় সর্বত্র কম্পন অনুভূত হয়েছে। দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং কাশ্মীরেও ভূমিকম্প ভালোই টের পাওয়া গেছে।
পাকিস্তানের সোয়াট প্রদেশে দেওয়াল ভেঙে একটি দুই বছরের শিশুর মৃত্যু হয়েছে। খাইবার-পাখতুনখোয়ায় একটি থানার দেওয়াল ভেঙে পড়েছে।
তুরস্কে ভূমিকম্প : আলী ও তার পরিবারের গোরস্থানের জীবন
আলী ডোগরু তুরস্কের এক গোরখোদক৷ ভূমিকম্পের পর কবর খুড়ে মৃতদের শেষ শয্যায় শুইয়ে দেয়ার কাজে ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে৷ আলী ও তার পরিবারের এখন জীবন কাটে মৃতদেহ আর কবর ঘিরে৷ দেখুন ছবিঘরে....
ছবি: Susana Vera/REUTERS
ভূমিকম্প ও আলীর বদলে যাওয়া জীবন
গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে ৫৪ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়৷ অসংখ্য ভবন ধসে পড়ায় কয়েক লাখ মানুষ ঘরছাড়া৷ গোরখোদক আলী ডোগরুর বাড়ি এখন থেকেও নেই৷ নিজের বাড়ি ধসে পড়ছে দেখে দেখে সেই যে সপরিবারে ছুটে বেরিয়েছিলেন, এখনো সেখানে ফেরা হয়নি৷
ছবি: Susana Vera/REUTERS
বাসে বসবাস
ইসকেন্দারুনে নিজেদের বাড়ি থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেরিয়ে শহরের কবরস্থানের কাছেই একটু মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজছিলেন ৪৬ বছর বয়সি আলী৷ হঠাৎ একটা খালি বাসের দিকে নজর যায় তার৷ অনেক ভেবেচিন্তে সেখানেই সপরিবারে থাকার সিদ্ধান্ত নেন৷
ছবি: Susana Vera/REUTERS
সেই বিভীষিকা
ইসকেন্দারুনের কবরস্থানের কাছের বাসে ওঠার পর থেকে টানা তিনদিন আলীর পরিবারের কারো মুখে খাবার ওঠেনি৷ এমনকি সন্তানদের মুখেও একটুখানি খাবার তুলে দিতে পারেননি আলী আর তার স্ত্রী হাতিস৷ বড় তিন ছেলে খিদের কষ্ট মেনে নিয়েছিল৷ কিন্তু কোলেরটা তো এতকিছু বোঝে না, এক সময় সে শুরু করলো খামচাখামচি আর কান্নাকাটি৷ মায়ের কাছে তার দাবি- এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে, গিয়ে কিছু খেতে দিতে হবে!
ছবি: Susana Vera/REUTERS
লাশ দাফনের বিশেষ ব্যবস্থা
ভূমিকম্পের রাতে ১২ জনের দাফন সম্পন্ন করলেন আলী৷ তারপর থেকে কবরস্থানে মৃতদেহের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে৷ ভূমিকম্পের পরের প্রথম ১০ দিনে ইসকেন্দারুনের গোরস্থানেই কবর দেয়া হয় মোট ১২১০ জনকে৷ দু-তিনজন গোরখোদক আর দুজন ইমাম এত লোকের জানাজা পড়াতে পারছিলেন না বলে গোরখোদক বাড়াতে হলো, ইমামের সংখ্যাও বাড়লো৷ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে এলেন দশজন ইমাম৷
ছবি: Susana Vera/REUTERS
ভাইয়ের পাশে ভাই
আলী ও তার পরিবার বাসের মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে প্রথম কয়েকটি রাত কাটিয়েছেন৷ তারপর বিছানার ব্যবস্থাও হয়েছে৷ আলীর ছোট ভাই এমরুল্লাহ, তার স্ত্রী আসলি এবং তাদের সন্তান এখন কাছেরই এক তাঁবুতে থাকছে৷ ছবিতে তাঁবুর বাইরে নিজের এবং হাতিসের সন্তানদের সঙ্গে খেলছেন এমরুল্লাহর স্ত্রী আসলি৷
ছবি: Susana Vera/REUTERS
কবরই তাদের খেলার মাঠ
আলী আর তার ভাইয়ের সন্তানদের দিনের অধিকাংশ সময় কাটে গোরস্থানে৷ শুরুর দিকের আতঙ্কের ধাক্কা সামলে সেখানে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে তারা৷ খালি কফিনে শুয়ে-বসে, কবরের পাশ দিয়ে ছোটাছুটি করেই এখন সময় কেটে তাদের৷ ওপরের ছবিতে কবরস্থানে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আলী ডোগরুর ১২ বছর বয়সি সন্তান সালিহ এবং তার নয় বছর বয়সি চাচাতে চাচাতো ভাই ইয়াভুজ৷
ছবি: Susana Vera/REUTERS
ভালোবাসার অটুট বন্ধন
গোরখোদকের কাজ কবর খোড়া৷ ছয় বছর ধরে এ কাজ করলেও গত কিছুদিনে এমন সব অভিজ্ঞতা হয়েছে যেগুলো আলীর চিরকাল মনে থাকবে৷ মা বা বাবা সন্তানকে জড়িয়ে ধরে মারা গেছেন, কেউ কেউ প্রিয়জনের হাত ধরেই ফেলেছেন শেষ নিঃশ্বাস৷ কবর দেয়ার আগে তাদের হাত ছাড়ানোর সে কী চেষ্টা! আলী হাত ছাড়াতে যাওয়া ব্যক্তিদের বাধা দিয়ে বলেছেন, ‘‘মৃত্যুও যে শিশু আর তার মা বা বাবার সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেনি, আপনি কেন তা ছিন্ন করতে চাইছেন?’’
ছবি: Susana Vera/REUTERS
শিশুদের ভবিষ্যৎ
আলী আর তার স্ত্রী হাতিস চার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত৷ ভূমিকম্প ও তার পরের অভিজ্ঞতা ওদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে না তো? ইসকেন্দারুনে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এলেই আলী সন্তানদের মন ভালো করার চেষ্টা করবেন৷ প্রথমেই ছুটি নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবেন৷ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে সাবেক এই কসাই বলেছেন, ‘‘সব ঠিকঠাক হলে ওদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা আমি ভেবে রেখেছি৷’’
ছবি: Susana Vera/REUTERS
হাতিসের সামান্য চাওয়া
ভূমিকম্পে আলীর বাড়ির বেশি ক্ষতি হয়নি৷ দেয়ালে কিছু ফাটল দেখা গেছে, আর জানলার কিছু কাঁচ ভেঙেছে৷ তবে প্রাণভয়ে কেউ এখনো সেই এলাকায় ফিরছে না৷ কিন্তু আলীর স্ত্রী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেদের ঘরে ফিরতে চান৷ হাতিস বলেছেন, ‘‘আমাদের তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই৷ এখান থেকে কোথায় যাবো আমরা? আমি কিচ্ছু চাই না, শুধু আমার বাড়িটা ফিরে পেতে চাই৷’’ ছবিতে নিজেদের বাড়ির রান্নাঘরের ফাটল দেখছেন হাতিস এবং আলী৷
ছবি: Susana Vera/REUTERS
9 ছবি1 | 9
আফগানিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, এক শিশু-সহ আফগানিস্তানে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। গোটা দেশে হাই অ্যালার্ট জারি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
রেডক্রসের এক প্রতিনিধি জানিয়েছেন, প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে যাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে ফোন বা ইন্টারনেটও নেই। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুই এখনো জানা যায়নি।
অ্যামেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভে জানিয়েছে, মাটির তলায় ১৮৭ কিলোমিটার গভীরে ভূমিকম্প হয়েছে। হিন্দুকুশ এলাকায় আবার কম্পন হতে পারে বলেও সতর্কবার্তা জারি করা আছে।
জাপানের ভূমিকম্প প্রস্তুতি
জাপান মেটেওরোলজিক্যাল এজেন্সির হিসেবে দেশটিতে প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার ভূমিকম্প হয়৷ তাই সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে জাপান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Taga
বছরে দেড় হাজার ভূমিকম্প
যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের হিসেবে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর অন্যতম জাপান৷ জাপান মেটেওরোলজিক্যাল এজেন্সির হিসেবে দেশটিতে প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার ভূমিকম্প হয়৷ এর মধ্যে ছয় থেকে সাতটির মাত্রা পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি হয়ে থাকে৷ ১৮৮৫ সালের পর থেকে জাপানে এখন পর্যন্ত ২০টি ভূমিকম্প হয়েছে যেগুলোর মাত্রা সাত-এর বেশি ছিল৷
ছবি: Hironori Asakawa/Kyodo/AP/picture alliance
ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ভবন
বলা হয় টোকিওর প্রায় ৮৭ শতাংশ ভবন ভূমিকম্প-প্রতিরোধী করে তৈরি করা হয়েছে৷ আইন করে বিভিন্ন মাত্রার কম্পন-প্রতিরোধী ভবন তৈরির ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ কিছু ভবন টেফলন নামের সিন্থেটিক পলিমারের উপর তৈরি করা হয়েছে, যেন কম্পনের সঙ্গে মিলে সেটি জায়গা পরিবর্তন করতে পারে৷ এছাড়া রাবার ও তরলে পূর্ণ ভিত্তির উপরও অনেক কাঠামো নির্মিত হয়েছে যেন ধাক্কা সামলাতে পারে৷
ছবি: IMAGO/YAY Images
ফোনে এলার্ট সিস্টেম
প্রতিটি স্মার্টফোনে ভূমিকম্প ও সুনামি এলার্ট সিস্টেম ইনস্টল করা আছে৷ এর মাধ্যমে ভূমিকম্প ও সুনামি আঘাত হানার পাঁচ থেকে ৬০ সেকেন্ড আগে মানুষকে সতর্ক করা হয়৷
ছবি: Kazuhiro Nogi/AFP/Getty Images
বুলেট ট্রেনে সেন্সর
প্রতিটি বুলেট ট্রেনে ভূমিকম্প সেন্সর লাগানো আছে৷ এটি কম্পন অনুভব করে সমস্যা মনে করলে ট্রেন থামিয়ে দিতে পারে৷২০১১ সালে জাপানে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার আগে কম্পন টের পেয়ে চলমান ২৭টি বুলেট ট্রেন থেমে গিয়েছিল৷ সে কারণে প্রাণহানি এড়ানো গেছে৷
আগুন লাগলে কী করতে হবে তা বিশ্বের অনেক দেশের স্কুলেই শেখানো হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর হাতে-কলমে তা অনুশীলন করা হয়৷ আর জাপানে স্কুল শিক্ষার্থীদের ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে তা শেখানো হয়৷ এছাড়া স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য ফিল্ড ট্রিপেরও ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে তাদের জন্য সিমুলেটরের সাহায্যে ভূমিকম্পের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়৷ ফলে ভূমিকম্প হলে আসলে কেমন লাগতে পারে সে সম্পর্কে জানতে পারে শিক্ষার্থীরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Taga
আর্থকোয়্যাক সার্ভাইভাল কিট
ওষুধ ও কসমেটিকসের দোকানগুলোতে এসব কিট পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে থাকে ফার্স্ট এইড কিট, পানি, খাবার, গ্লাভস, মাস্ক, টর্চ, ইনসুলেশন শিট, রেডিও ইত্যাদি৷ অনেক বাড়িতেই এসব কিট রাখা হয়৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/Reuters
6 ছবি1 | 6
দিল্লির অবস্থা
দিল্লিতে বেশ জোরে ভূমিকম্পের ধাক্কা টের পাওয়া গেছে। চেয়ার, খাট নড়েছে। ফ্যান, লাইট দুলতে শুরু করে। অন্ততপক্ষে দুইবার কাঁপে দিল্লি। মানুষ ভয় পেয়ে যান। দিল্লির পাশের দুই শহর নয়ডা ও গুরুগ্রামে ভূমিকম্প আরো প্রবলভাবে অনুভূত হয়েছে। বহতল বাড়িগুলি দুলেছে। সবাইকে নিচে আসতে বলা হয়েছে। সবাই দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেছেন। তবে এরপর আর কিছু না হওয়ায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।