যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশে থাকেন, সে তালিকায় বাংলাদেশ পঞ্চম৷ এদের বেশিরভাগই প্রবাসে শ্রম দিয়ে রক্ত পানি করা অর্থ দেশে পাঠান৷ তাঁদের এই অর্থের যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত৷
বিজ্ঞাপন
ফিলিপাইন্সে সাংবাদিকতা পড়ার সময় একবার গ্লোবাল মিডিয়া স্টাডিজ বিষয়টির একটি ক্লাসে ‘কাভি খুশি কাভি গাম' মুভিটি দেখানো হচ্ছিল৷ পুরো ছবিটা আগেই দেখেছিলাম৷ তাই ফিলিপিনো-চীনা শিক্ষক যখন জোর করে আবার দেখাচ্ছিলেন পুরো ছবিটি, তখন আমার আর আমার ভারতীয় বন্ধু বিপাশার অবস্থা ছিল ‘টাইট'৷ অন্যরা ভিন্ন দেশের৷ তাই তারা আগ্রহ নিয়েই দেখছিলেন৷ ইন্দোনেশিয়ার এক বন্ধু তো চোখের জল নাকের জল এক করে ফেলছিলেন৷
শিক্ষক আসলে ‘সফট ডিপ্লোমেসি' বোঝাবার জন্য মুভিটি (তাই বলে পুরোটা?) দেখিয়েছিলেন৷ কীভাবে প্রবাসীদের দেশমুখী করা যায়, অন্তত দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন না হয়, সে চেষ্টা ভারতীয়রা বরাবরই করে গেছেন৷ সে কাজে বলিউড বিরাট ভূমিকা রেখেছে৷ তাই বলিউডের অনেক মুভিতেই দেখা যায়, দেশে ফেরার গল্প রয়েছে৷ এর মূল কারণ অর্থনৈতিক৷ দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন না হলে, অর্থ আসবে দেশে, এই চিন্তা থেকে৷
যেভাবে বাংলাদেশের পাশে জার্মানি
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জার্মানি৷ সামজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সবক্ষেত্রেই ইউরোপের দেশটি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বিশ্বস্ত সঙ্গী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উষ্ণ সম্পর্কের উপাখ্যান
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সাথে জার্মানির সুসম্পর্কের সূচনা৷ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে স্বিকৃতি দেয়া ইউরোপের প্রথম দিকের দেশগুলোর একটি জার্মানি৷ দুই জার্মানির একত্রিকরণকে স্বাগত জানাতে দেরি করেনি বাংলাদেশও৷ দেশটির বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও চার্চ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো স্থানীয় অংশীদারদের মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখছে৷ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী হিসেবেও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য
যুক্তরাষ্ট্রের পরই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি বাজার জার্মানি৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে তারা ৪২৮ কোটি ডলারের পণ্য কিনেছে, যার মধ্যে ৪০০ কোটি ডলারই ছিল তৈরি পোশাক৷ ৮.৩ কোটি ডলারের চামড়াজাত পণ্য, ৭.২ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্যও রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ৷ অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে জার্মানি আমদানি করেছে প্রায় ৮২ কোটি ডলারের পণ্য, যার অর্ধেকই ছিল মেশিনারি বা যন্ত্রপাতি৷
ছবি: Imago/Blickwinkel
উন্নয়ন প্রকল্প
১৯৭০ এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশেকে ৩০০ কোটি ইউরোর আর্থিক সহায়তা করেছে জার্মানি৷ সবশেষ গত নভেম্বরে ঢাকায় দুই দেশের সরকারি প্রতিনিধিদের মধ্যে এক বৈঠকে ২৮.৫৩ কোটি ডলার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আসে জার্মানির কাছ থেকে৷ যা ব্যয় হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও নগরে জলবায়ু মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রকল্পে৷
ছবি: DW/S. Burman
সংস্কৃতি বিনিময়
দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ দৃঢ় করতে ১৯৬১ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় জার্মান ভাষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গোয়েটে ইনস্টিটিউট৷ প্রতি বছর ১৫০০ শিক্ষার্থী এখান থেকে জার্মান ভাষা শিখছে৷ আছে জার্মান সাহিত্য, ইতিহাস ও রাজনীতির সাথে পরিচিত হবার ব্যবস্থাও৷ জার্মান চলচ্চিত্র, সংগীত ও সাহিত্য নিয়ে উৎসবের আয়োজনও করে থাকে গোয়েটে৷
উচ্চশিক্ষায় বৃত্তি
জার্মান অ্যকাডেমিক এক্সচেইঞ্জ সার্ভিস (ডিএএডি), আলেক্সান্ডার ফন হুমবল্ট ফাউন্ডেশন, ডয়চে ভেলেসহ বিভিন্ন জার্মান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের শিক্ষা ও গণমাধ্যমের উন্নয়নে অবদান রেখে চলছে৷ প্রতিবছর বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, তরুণ বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদের তারা বিভিন্ন বৃত্তি দিয়ে থাকে৷ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০০ ছাত্র-ছাত্রী জার্মানির উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি রয়েছে৷
ছবি: Munir Zaman
শিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন
ফেডারেল মিনিস্ট্রি অফ ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট বা বিএমজেড-এর অধীনে রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ১৫ লাখ ইউরো সহযোগিতা দিয়েছিল জার্মানি৷ তৈরি পোশাক কারখানার সংস্কার উদ্যোগেও পাশে আছে দেশটি৷ ২০০৫ সাল থেকেই বাংলাদেশের শিল্প কারখানায় সামাজিক ও পরিবেশগত মানদণ্ড নিশ্চিত করতে সহযোগিতা দিচ্ছে তারা৷ আছে ভবিষ্যত প্রতিশ্রুতিও৷
ছবি: DW/S. Burman
রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা সহ বিভিন্ন প্রকল্পে সহযোগিতা দিয়ে আসছে জার্মানি৷ এই খাতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশটি প্রায় ৬.৭ কোটি ইউরো খরচ করেছে৷ পরবর্তীতে আরো ৩ কোটি ইউরো সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জার্মানি৷
ছবি: DW/ P. Vishwanathan
বাংলাদেশে জার্মান প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ জ্বালানি প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে দীর্ঘদিন ধরে জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে৷ পঞ্চগড়ে ৪৭ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগড়ে উঠেছে জার্মান দু’টি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়৷ দেশটির কালি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিজবের্ক বাংলাদেশে তাদের কারখানা চালুর ঘোষণা দিয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
সিমেন্সের বড় বিনিয়োগ
বাংলাদেশে এযাবতকালের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে জার্মানির প্রতিষ্ঠান সিমেন্স৷ পায়রায় ৮০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে ৭০০ কোটি ইউরো খরচ করবে তারা৷ যার অংশ হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে ৩৬০০ মেগাওয়াটের এলএনজি পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের চুক্তি করে প্রতিষ্ঠানটি৷ বাংলাদেশের টেক্সটাইল, যোগাযোগ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Schutt
অত্যাধুনিক পাসপোর্ট তৈরি
বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট তৈরি করে দেয়ার কাজ পেয়েছে জার্মান প্রতিষ্ঠান ফেরিডোস৷ ৩৪ কোটি ইউরোর এই প্রকল্প শেষ হবে ১২ বছরে৷ ২০১৮ সালের জুলাইতে দুই দেশের সরকারের মধ্যে এবিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ সে অনুযায়ী জার্মান প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছরের জুনেই প্রথম পর্যায়ের ই-পাসপোর্ট সরবরাহের কথা রয়েছে৷ বিশ্বে প্রযুক্তিগতভাবে জার্মানির পর বাংলাদেশই এত শক্তিশালী পাসপোর্টের অধিকারী হবে, যা জাল করা প্রায় অসম্ভব৷
ছবি: DW/D. Guha
বাংলাদেশের উন্নয়নে জার্মান মডেল
এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি বাংলাদেশকে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য একটি মডেল অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছে৷ তাদের গবেষণা অনুযায়ী অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই আর দৃঢ় অর্থনীতি গড়ে তুলতে বাংলাদেশের সামনে জার্মানিই হতে পারে সম্ভাব্য মডেল৷ কেননা এসএমই খাতের বিকাশ, শিল্পভিত্তিক উন্নয়ন আর জনসংখ্যার বিকেন্দ্রিকরণের পাশাপাশি দেশটি তার সব এলাকায় সমানভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করেছে৷
ছবি: DW/M. Saleh
11 ছবি1 | 11
বিদেশে যারা থাকেন, তাদের (সাধারণভাবে) এমনিতেই দেশের প্রতি টানটা বেড়ে যায়৷ তাই অনেকে যখন বলেন, ‘‘বিদেশে বসে দেশের অবস্থা নিয়ে বড় বড় কথা বলছে!'', সেই সমালোচনাটা আসলে সাধারণভাবে খাটে না৷ সে যা-ই হোক, বিদেশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা দেশে অর্থ পাঠান মূলত পরিবারের খরচ মেটাতে, জমি-বাড়ি এসব সম্পত্তিতে বিনিয়োগ হিসেবে৷ কিন্তু এই বিনিয়োগকে আরেকটু পদ্ধতিগতভাবে উৎসাহিত করা যেতে পারে৷
গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি জানান যে, বর্তমানে বিশ্বের ১৬৫টি দেশে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত আছেন৷
বাংলাদেশে এফডিআই বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে গত এক দশক ধরে৷ এ অবস্থায় বর্তমান সরকার প্রবাসীদের বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে৷ কিন্তু কাজের সূত্রে অনেক ব্যবসায়ীই আমাকে বলেছেন যে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ পদ্ধতি জটিল৷ অনেকগুলো ধাপ৷ সরকার বলেছে যে, এসব ধাপ সহজ করে আনা হবে৷
সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, প্রবাসীরা যেন দেশে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন, সেজন্য এর ধাপগুলো সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ এটি সুখবর৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সব বিদেশ সফরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান৷ বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের কথা বলেন৷ সম্প্রতি প্রবাসী প্রকৌশলীদের সঙ্গেও এক বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল৷ আরো সম্মেলন হবার কথা রয়েছে৷
তবে প্রাতিষ্ঠানিক বা বড় আকারের বিনিয়োগের পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকেও উৎসাহিত করতে হবে৷ এর মধ্যে প্রবাসীদের জন্য চালু বন্ডগুলো ভালো উদ্যোগ৷ এখন পর্যন্ত চালু তিন বন্ডে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগও করেছেন প্রবাসীরা৷ সুদের হার বেশি হওয়ায়, বিশেষ করে ‘ওয়েজ আর্নার্স বন্ড' ভালো সাড়া পেয়েছে৷
পাঁচ বছর মেয়াদি এ বন্ডে ২৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়৷ মুনাফা ১২ শতাংশ৷ প্রতি ছয় মাস পরপর মুনাফা তোলা যায়৷ আর ছয় মাসে মুনাফা না তুললে ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে ১২ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে মুনাফা পাওয়া যায়৷
আরেকটি বিষয় হলো, আট কোটি টাকা বা তার বেশি বিনিয়োগ করলে সিআইপি সুবিধা পাওয়া যায়৷ তাই অনেক ব্যবসায়ীরও আগ্রহ আছে এতে৷ কিন্তু প্রবাসে তুলনামূলক স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে একে আরো জনপ্রিয় করতে হবে৷ এর ক্রয়পদ্ধতি সহজ করতে হবে৷ দূতাবাসগুলো এক্ষেত্রে ভুমিকা রাখতে পারে৷ আলোচনা করতে পারে প্রবাসীদের সঙ্গে৷ তুলে ধরতে পারে লাভ-ক্ষতির হিসেব৷
প্রবাসী বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এই অর্থ দেশেই থেকে যাবে৷ কিন্তু তাদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারকে উদ্যোগ বাড়াতে হবে৷ শুধু সম্মেলন বা সরাসরি যোগাযোগই নয়, প্রবাসীদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগও বাড়াতে হবে৷ নতুন নতুন সৃজনশীল ‘আইডিয়া' নিয়ে কাজ করতে হবে৷ মোট কথা, প্রবাসীদের সঙ্গে একটা সেতুবন্ধন রাখতে হবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷