‘রাষ্ট্র চাইলে যে বিচার দ্রুত করা সম্ভব, সেটা আবারও প্রমাণ হলো৷' সিলেট ও খুলনায় দুই শিশু হত্যার রায়ের পর ডয়চে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এ মন্তব্য করেন৷
বিজ্ঞাপন
[No title]
১০ কার্যদিবসে একটি এবং ১৭ কার্যদিবসে অপর মামলাটির রায় ঘোষণা হয়েছে৷ দুই মামলায় পৃথকভাবে ছ'জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত৷ পাশাপাশি অভিযুক্ত এমপির গলায় ফুলের মালা দেয়ার সংস্কৃতিরও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এই মানবাধিকার কর্মী৷ সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘গাইবান্ধায় একজন এমপি সবার সামনে একটি শিশুকে গুলি করলো৷ তাঁকে আদালত জামিন দিয়েছে৷ কিন্তু ফুলের মালা দিয়ে তাঁকে নিয়ে আসতে হবে, এ সংস্কৃতি বদলাতে হবে৷ আমরা এই খারাপ সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি৷''
এদিকে সোমবার ময়মনসিংহে অপর একটি শিশু হত্যার রায়ে ছ'জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত৷ ২০১০ সালের ৪ঠা মে মুক্তাগাছার উপজেলার খেরুয়াজানি গ্রামে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে প্রথমে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে ফরহাদ নামে একটি শিশুকে আহত করা হয়৷ এরপর তাকে হত্যা করে হাত-পা কেটে পুকুরে ফেলে দেয় খুনিরা৷ ফরহাদের বাবা আইয়ুব আলীর সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরেই এ ঘটনা ঘটায় আসামিরা৷
এর আগে রবিবার সিলেট ও খুলনায় আলোচিত দু'টি শিশু হত্যার রায় ঘোষণা করে আদালত৷ সবজি বিক্রেতা শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন (১৪) হত্যায় চারজনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়৷ এদের মধ্যে একজন কামরুল ইসলাম, যাকে সৌদি আরব থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল৷ অভিযুক্তরা শিশু রাজনকে একটি খুঁটির সঙ্গে বেধে পিটিয়ে নির্মমভাবে আহত করে৷ পরে তার মৃত্যু হয়৷ ১৭ কার্যদিবসে এই রায় দেন বিচারক৷
অন্যদিকে খুলনায় গ্যারেজ-কর্মী শিশু রাকিব (১২) হত্যার ঘটনায় দুই জনের ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত৷ গত ৮ই জুলাই চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় শিশু রাজনকে৷ ঘটনার দৃশ্য ধারণ করে নির্যাতনকারীরা ভিডিও চিত্রটি ফেসবুকে প্রকাশ করে৷ বিষয়টি দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়৷ এই রায়টি হয়েছে ১০ কার্যদিবসে৷
রাষ্ট্রে প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও স্বীকার করেন, বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চাইলে মামলার যে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, এটি তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ দুই শিশু রাজন ও রাকিব হত্যা মামলা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়ায় এই রায় বিচার বিভাগের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে৷ রাজন ও রাকিব হত্যা মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে দায়রা জজ আদালতে৷ অথচ কোনো খুনের মামলার বিচার এই দায়রা আদালতে নিষ্পত্তি হতে সাধারণত তিন বছর থেকে এক যুগ পর্যন্ত সময় লেগে যায়৷
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘দুই শিশু হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা চাই৷ কিন্তু মানবাধিকার কর্মী হিসেবে সেই শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করি আমরা৷ রাষ্ট্র যদি সব হত্যার ব্যাপারে আন্তরিক হতো, তাহলে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেক ভালো থাকত৷ অপরাধীরাও সতর্ক হয়ে যেত৷ পাশাপাশি একজন এমপি যখন অপরাধ করে তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেই বিচারটিও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা৷ সংসদ চলাকালে তিনি জামিন পেতেই পারেন৷ কিন্তু সংসদ শেষ হলে যেন তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়৷ একই সঙ্গে শিশুটির পরিবার যেন সব ধরনের আইনি সুবিধা পায়, সেটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷ তারা যেন নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে৷''
ক্যামেরার চোখে বাংলাদেশে শিশু শ্রম
বাংলাদেশে ৪৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখের বেশি আবার কাজ করে রাজধানী ঢাকায়৷ আমাদের আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন শিশুশ্রমের কিছু চিত্র তুলে এনেছেন আপনাদের জন্য৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বেলুন কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের একটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করছে দশ বছরের এক শিশু৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যার প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক খোদ রাজধানীতেই৷
ছবি: Mustafiz Mamun
নেই কোনো নজরদারি
কামরাঙ্গীর চরের এই বেলুন কারখানায় খোলামেলাভাবে নানা ধরনের রাসায়নিকের মাঝে কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সিংহভাগই শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে কমপক্ষে দশটি বেলুন তৈরির কারখানা আছে, যেগুলোর সিংহভাগেই শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সড়ক থেকে একটু আড়ালে ভেতরের দিকেই কাজ করানো হয় শিশুদের৷ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয় তাদের৷ তবে শুক্রবারে আধাবেলা ছুটি মেলে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে সিলভারের তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিক আলী হোসেন৷ মারাত্মক উচ্চ শব্দের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় তাকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ট্যানারি কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার হাজারীবাগের একটি ট্যানারি কারখানায় বাইরে কাজ করে নোয়াখালীর আসিফ৷ বয়স মাত্র বারো৷ রাসায়নিক মিশ্রিত চামড়া শুকানোর কাজ করে সে৷ দিনে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে সামান্য যে মজুরি পায় তা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করে আসিফ৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মায়ের সঙ্গে রাব্বি
কামরাঙ্গীর চরের একটি প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে মায়ের সঙ্গে কাজ করে চাঁদপুরের রাব্বি৷ এই কেন্দ্রের মালিক নাকি শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিরোধী৷ মায়ের অনুরোধে রাব্বিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ কারণ রাব্বির মা সারাদিন খেটে যে মজুরি পান তাতে সংসার চলে না৷ সংসার চালাতে তাই কাজ করতে হচ্ছে রাব্বিকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
হিউম্যান হলারে শিশু হেল্পার
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী হিউম্যান হলারগুলোতে শিশু শ্রমিক চোখে পড়ার মতো৷ বাহনগুলো দরজায় ঝুলে ঝুলে কাজ করতে হয় এ সব শিশুদের৷ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকারও হয় এসব শিশুরা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্রিক ফিল্ডে শিশুরা
ঢাকার আমিন বাজারের বিভিন্ন ব্রিক ফিল্ডেও কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ প্রতি হাজার ইট বহন করে পারিশ্রমিক পায় ১০০-১২০ টাকা৷ একটি কাঁচা ইটের ওজন কমপক্ষে তিন কেজি৷ একেকটি শিশু ৬ থেকে ১৬টি ইট এক-একবারে মাথায় নিয়ে পৌঁছে দেয় কমপক্ষে ৫০০ গজ দূরে, ইট ভাটায়৷ তাদের কোনো কর্মঘণ্টাও ঠিক করা নেই৷ একটু বেশি উপার্জনের আশায় রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেদ কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা
পুরনো ঢাকার লালবাগের একটি লেদ কারখানায় কাজ করে ১১ বছরের শিশু রহিম৷ সারাদিন লোহা কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি মেরামত, হাতুরি পেটানোসহ নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে সে৷