প্রশাসনিক রিপোর্টের পর জনসনের উপর চাপ আরো বেড়েছে। সোমবার পার্লামেন্টে বিরোধীরা তাকে চেপে ধরেন, একের পর এক প্রশ্ন করেন। করোনাবিধি ভেঙে 'নিজের মদ নিজে আনো' পার্টি নিয়ে জনসন এর আগে ক্ষমা চেয়েছিলেন। সোমবার আবার তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন।
কিন্তু বিধি ভেঙে একটা পার্টি নয়, জন্মদিনের পার্টি-সহ অনেকগুলি জমায়েতে জনসন অংশ নিয়েছিলেন। উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক অফিসার সু গ্রে এরকম ১২টি অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করেছেন। যার মধ্যে তিনটি অভিযোগ এখনো জনসমক্ষে আসেনি।
গ্রে তার রিপোর্টে বলেছেন, ''এই ধরনের পার্টি নেতৃত্বের ব্যর্থতার দিকটাই দেখিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে কিছু পার্টির অনুমতি দেয়া একেবারেই উচিত হয়নি।''
গ্রের রিপোর্টের পর লন্ডন মেট্রোপলিটান পুলিশ পার্টিগেট নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। তারা ১২টি পার্টি নিয়েই তদন্ত করবে।
রিপোর্টে কী বলা হয়েছে
গ্রে জানিয়েছেন, পুলিশ ১২টি পার্টি নিয়ে তদন্ত তো করবেই, সেই সঙ্গে তারা এটাও দেখবে জনসন করোনা বিধি ভেঙে এরকম আরো কোনো পার্টি করেছিলেন কি না।
রিপোর্টে গ্রে পরিষ্কার করে বলেননি, এই পার্টি করে নিয়ম ভাঙা হয়েছে কি না। তবে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তার পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট কড়া।
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall ১২ পাতার রিপোর্টে তিনি বলেছেন, ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট এবং ক্যাবিনেট অফিস বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দেয়া ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়ছে, করোনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যখন নাগরিকদের জন্য কড়া নিয়ম চালু করছে, সেই সময় কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের জমায়েতের ব্যাখ্যা কোনোভাবেই দেয়া যায় না। অন্তত কিছু জমায়েত থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, সরকারের কাজের ক্ষেত্রে যে উঁচু মাপদণ্ড থাকা দরকার, সেটা এখানে ছিল না। যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা তাদের কাছ থেকে এই উঁচু মাপদণ্ড প্রত্যাশা করে।
এরপর কী হবে?
গত ডিসেম্বরে পার্টিগেটের অভিযোগ আসার পর জনসনের উপর ইস্তফা দেয়ার চাপ বাড়ে। এমনকী তার দলের কিছু পার্লমেন্ট সদস্যও এই দাবি তোলেন।
সোমবার হাউস অফ কমন্সে জনসন বলেছেন, ''আমি দুঃখিত। যা ঘটেছে ও যেভাবে ঘটেছে তার জন্য আমি দুঃখিত। এটা বলার কোনো অর্থ নেই যে, কী কী বিধি ছিল, এটাও বলা অর্থহীন যে, কর্মীরা খুবই কঠোর পরিশ্রম করছিলেন। করোনা সকলের জন্যই কঠিন সময়।''
জনসন বলেছেন, ''ডাউনিং স্ট্রিটে যেভাবে কাজ হয়, তাতে কিছু পরিবর্তন দরকার। আমি বিষয়টি দেখব এবং ঠিক করব।''
অধিবেশন চলার সময় স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির নেতা আয়ান ব্ল্যাকফোর্ড বলেন, জনসন মিথ্যা কথা বলছেন। তখন তাকে অধিবেশন থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়।
কিন্তু প্রশাসনিক রিপোর্টের পর জনসন আরো চাপে পড়লেন। এখন তার দলের সদস্যরা জনসনকে সরিয়ে দেয়ার দাবি আরো জোরালোভাবে তুলতে পারেন। এই নিয়ে ভোটাভুটি করার দাবি তুলতে পারেন।
এট ঠিক, রিপোর্টে এটা বলা হয়নি, জনসন ফৌজদারি অপরাধ করছেন। এটাই তার একমাত্র রক্ষাকবচ। সেজন্য তিনি হাঁফ ছাড়ার কিছুটা সময় পেতে পারেন।
বিরোধী লেবার পার্টির তরফ থেকে বলা হয়েছে, এই রিপোর্ট প্রকাশের আগেই মানুষ জেনে গেছিলেন যে, জনসন করোনার বিধি ভেঙে পার্টি করেছেন। তিনিই নিয়ম তৈরি করেছেন। তিনিই ভেঙেছেন। তাই তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার উপযুক্ত নন।
জিএইচ/এসজি (রয়টার্স, এপি, এএফপি)