ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলার জন্য প্রশাসনের অবহেলা, ঢিলেমিকে দায়ী করছেন সংখ্যালঘু নেতা ও মানবাধিবার কর্মীরা৷ তাঁদের অভিযোগ, পুলিশকে একদিন আগে হামলার আশঙ্কার কথা জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
বিজ্ঞাপন
ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে একটি পোস্টের কথা বলে প্রতিবাদের নামে রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু জনপদে দিনভর সহিংসতা চালায় দুর্বৃত্তরা৷ ঐ ঘটনায় একটি মামলার বাদী কাজল দত্ত ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রতিবাদের নামে রবিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত নাসিরনগর উপজেলা সদরে ঘোষপাড়া, দাসপাড়া, নমঃসূদ্রপাড়া, দত্তপাড়ায় কয়েকশ লোক লাঠি-সোটা নিয়ে একযোগে হামলা চালায়৷ এ সময় তারা শতাধিক বাড়ি ঘরে হামলা-ভাঙচুর এবং লুটপাট করে৷
কাজল দত্ত
ভেঙে ফেলে প্রাচীন গৌরমন্দির, লোকনাথ মন্দির, কালী মন্দির, মহাদেব মন্দিরসহ অন্তত ১০টি মন্দির৷ তার মন্দিরের প্রতিমাও ভেঙে ফেলে৷ এ সময় নাসিরনগর গৌর মন্দিরের সেবায়েত শংকর সেন ব্রাক্ষচারীসহ হিন্দু পাড়ার অসংখ্য নারী-পুরুষকে বেধড়ক পেটানো হয়৷ এ ঘটনায় এখনও পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে৷''
এদিকে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি রানা দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ও মন্দিরের ওপর হামলা চালানো হয়েছে৷ পুলিশকে আগাম জানিয়েও কোনো নিরপত্তা পাওয়া যায়নি৷ শনিবার বিকেলেই নাসির নগরে উত্তেজনা দেখা দেয় একটি কথিত ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে৷ এরপর পুলিশকে বিষয়টি জানানো হলে তারা ঐ যুবককে আটক করে, কিন্তু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতি পুলিশ সুপার আবার ধর্মীয় অবমাননার বিরুদ্ধে সমাবেশের অনুমতি দেন, যা উত্তেজনা বাড়াতে সহায়তা করে৷''
রানা দাশগুপ্ত
রান দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ যারা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়, তারাই এর সঙ্গে জড়িত৷''
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যদি কেউ ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দিয়েও থাকেন সেটা তো তার দায়৷ এ জন্য একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর কোনো যুক্তিতেই হামলা হতে পারে না৷ তাছাড়া পুলিশ প্রশাসন আগাম নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিলে এই হামলা হতো না৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই হামলার ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আরো নিরপত্তাহীনতায় ভুগবে৷ এরইমধ্যে নিরাপত্তাহীনতার কারণে বেশ কিছু হিন্দু পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে৷ কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য শহরে আসছেন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, বাগেরহাটে সংখ্যালগুদের ওপর হামলারই ধারাবহিকতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হামলা৷ সরকারকে এই হামলা রোধ করে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে৷''
নূর খান
এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করা হয়নি বলে জানা গেছে৷ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, ‘‘ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে৷ এরপর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে৷'' পুলিশ আগাম নিরাপত্তা দেয়নি এই অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘আমরা যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিয়েছি৷''
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ ইকবাল হোসাইন জানান, ‘‘রবিবারের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পক্ষে কাজল দত্ত এবং নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে নাসিরনগর থানায় পৃথক দুটি মামলা করেছেন৷ দুই মামলায় অজ্ঞাত ১২'শ জনকে আসামি করা হয়েছে৷ নাসিরনগর থানা পুলিশ এরইমধ্যে চারজনকে আটক করেছে৷ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷''
এদিকে সোমবার বিকেলে নাসির নগরে শান্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সেখানে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন৷ ঢাকায়ও প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে৷ নাসিরনগরে তিন প্লাটুন বিজিবি, দুই শতাধিক পুলিশ এবং বিপুল পরিমাণ র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে৷ ক্ষতিগ্রস্তরা এই ঘটনার বিচার ও ক্ষতিপূরণ এবং নিরাপত্তা দাবি করেছেন৷
ধর্মের নামে মন্দির, মসজিদ ও ঐতিহাসিক স্থাপনায় হামলা
প্রাচীন স্থাপনা ও অমুসলিমদের ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করে চলেছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস৷ মসজিদের ওপরও হামলা হয়েছে৷ উপমহাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ইতিহাসও দীর্ঘ৷ ধর্মের নামে এমন ধ্বংসের ‘খেলা’ থামবে কবে?
ছবি: Reuters
মালিতে ধ্বংসলীলা
এক সময় মালির টিমবাকটু শহরের অন্য নাম ছিল ‘মরুদ্যানের মুক্তা’৷ সেই শহরের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করেই চলেছে সেখানকার ইসলামি জঙ্গি সংগঠন৷ ২০১২ সালে শহরটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলমানদের গড়া অনেক স্থাপত্য নিদর্শনও ধ্বংস করেছে তারা৷ সম্প্রতি শহরটিকে জঙ্গিদের কবল থেকে পুরোপুরি মুক্ত করার দাবি করেছে মালির সেনাবাহিনী৷
ছবি: Getty Images/AFP
সন্ত্রাসপ্রীতি এবং জ্ঞানভীতি
শুধু স্থাপনা বা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনই নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপিও ধ্বংস করেছে জঙ্গিরা৷
ছবি: DW/P. Breu
তথাকথিত আইএস-এর হামলা
সিরিয়ার পালমিরা শহরের প্রায় ২,০০০ বছরের পুরনো স্থাপনাগুলোও রেহাই পায়নি৷ সে দেশে চলছে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর ধ্বংসযজ্ঞ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পালমিরার মন্দির ধ্বংস
এক সময় সিরিয়ার হোমস নগরীর এই স্থাপনাটিকে নিয়ে গর্ব করত সিরিয়া৷ এটি এক সময় ছিল মন্দির৷ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রাচীন এই উপসনালয় দেখে পর্যটকরা মুগ্ধ হতেন৷ আইএস-এর হামলায় স্থাপনাটি এখন ক্ষতবিক্ষত৷
ছবি: Reuters/Stringer
ধ্বংস যখন প্রচারণার হাতিয়ার
ধর্মীয় সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক সহাবস্থানকে হুমকির মুখে দাঁড় করানোর চেষ্টায় আইএস অক্লান্ত৷ নৃশংসতা, বর্বরতা ক্রমেই আইএস-এর প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে উঠছে৷ এভাবে পেট্রল ঢেলে স্থাপনা পোড়ালে সংবাদমাধ্যম লুফে নেয় খবর, খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত জঙ্গিরাও পেয়ে যায় তাদের কাঙ্খিত প্রচার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
আয়ের উৎস
সিরিয়া ও ইরাকের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ শুধু ধ্বংসই করে না, অনেক সময় কদর বুঝে সেগুলো চোরাপথে চড়াদামে বিক্রিও করে আইএস৷ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছ থেকেও অমূল্য সম্পদ কেড়ে নিয়ে বিক্রি করার অভিযোগ আছে আইএস-এর বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/IS/Internet
আফগানিস্তানে তালেবান বর্বরতা
আফগানিস্তানের এই বৌদ্ধ মন্দিরটিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউনেস্কো৷ ২০০১ সালে হামলা চালিয়ে এটি প্রায় ধ্বংস করে দেয় তালেবান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Ahmed
আফ্রিকায় হামলার শিকার মসজিদ
মসজিদও অনেকক্ষেত্রে তথাকথিত ধর্মীয় উন্মত্ততার শিকার৷ ২০১৫ সালে মুসলমানদের উপাসনালয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি হামলার খবর আসে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান থেকে৷ খ্রিষ্টান-মুসলিম দাঙ্গায় সেখানে অন্তত ৪১৭টি মসজিদ আংশিক অথবা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে বলেও দাবি করা হয়৷
ছবি: ISSOUF SANOGO/AFP/Getty Images
গির্জায় হামলা
ইসলামি জঙ্গিরা আফ্রিকা অঞ্চলে গির্জাতেও প্রায়সময়ে হামলা চালায়৷ হামলায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে৷ ওপরের ছবিটিতে কেনিয়ার এক গির্জায় হামলার পরের দৃশ্য৷
ছবি: dapd
ভারতের ইতিহাসের কালো অধ্যায়
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের ইতিহাসের ‘কালো দিন’৷ ভারতের উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার বাবরি মসজিদে সেদিনই হামলা চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে হিন্দু মৌলবাদীরা৷ মুঘল সম্রাট বাবরের নামে গড়া সুপ্রাচীন এই মসজিদের ওপর হামলার ঘটনা ভারতের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
বাংলাদেশে প্রতিবছরই মন্দিরে হামলা
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মূলত একাত্তরের মুক্তযুদ্ধের সময় থেকেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুরা হামলা, নির্যাতনের শিকার৷ তবে মন্দিরে মুর্তি ভাঙা, মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের অসংখ্য ঘটনা ঘটে প্রতিবছর৷ বৌদ্ধ মন্দিরেও হামলা হয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হামলার কারণ ধর্মীয় উগ্রতা৷ সারা বিশ্বে ধর্মের নামে ধর্মীয় উপাসনালয় বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ওপর হামলা থামবে কবে?
ছবি: Reuters
11 ছবি1 | 11
আপনার এলাকাতেও কি এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷