প্রশ্নের মুখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ
১০ জুলাই ২০২৫
আইন কলেজে ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। মনোজিৎ মিশ্র নামে কলেজের ওই অস্থায়ী কর্মী দাপিয়ে বেড়াতো প্রতিষ্ঠানে। এরপরে দেখা যাচ্ছে, অন্য কলেজেও এই ধরনের ঘটনা ঘটার অভিযোগ রয়েছে, যা এখন সামনে আসছে। এর সঙ্গে আছে সম্প্রতি ওঠা অভিযোগও।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হেনস্থা
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে এক মহিলা জুনিয়র চিকিৎসককে যৌন হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে অন্য এক জুনিয়র চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। হাসপাতালের মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে। এই সংক্রান্ত অভিযোগ কলেজের জেন্ডার হ্যারাসমেন্ট কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে বলে অধ্যক্ষ মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন। অভিযুক্ত চিকিৎসক তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন।
সম্প্রতি রাজ্য বিজেপি এক্স হ্যান্ডেলে একটি ভিডিও শেয়ার করে। তাদের দাবি, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজে এক ছাত্রীর সঙ্গে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্য তন্ময় দে অশালীন আচরণে লিপ্ত হয়েছেন। এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি ডিডাব্লিউ।
এরই মধ্যে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ইউনিয়ন রুমে বসে মদ্যপানের অভিযোগ উঠেছে। হাওড়া নরসিংহ দত্ত কলেজে ইউনিয়ন রুমে প্যান্ট খুলিয়ে নবাগত ছাত্রদের উপরে র্যাগিংয়ের অভিযোগ ওঠে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের কলেজে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে এক ছাত্রী সিনিয়র দাদার মাথা টিপে দিচ্ছে। এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি ডিডাব্লিউ।
গড়িয়াহাট আইটিআই কলেজের ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষজন অভিযোগ তুলেছেন। তাদের বক্তব্য, রাত বারোটার পরেও কলেজ খোলা থাকে। সেখানে হই-হুল্লোড় চলে, উচ্চস্বরে গান বাজে। যে কোনো সময় পার্টি হয়। এই সংক্রান্ত একাধিক ভিডিও স্থানীয় বাসিন্দারা সামনে এনেছেন।
রাজন্যার বিস্ফোরক অভিযোগ
আইন কলেজে গণধর্ষণের পরে এমন নানা অভিযোগ সামনে আসছে। এতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও ছাত্র নেতৃত্বের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত মনোজিতের বিরুদ্ধে দাদাগিরির নানা অভিযোগ পরবর্তীতে উঠেছে। বিরোধীদের দাবি, কলেজে কলেজে এভাবেই দাদাতন্ত্র চলছে।
চলতি বিতর্কে সবচেয়ে বিস্ফোরক অভিযোগটি করেছেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সাসপেন্ডেড নেত্রী রাজন্যা হালদার। তিনি সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, "দলে আরো অনেক মনোজিৎ রয়েছে। তিনি সেসব মনোজিতের বিকৃতির শিকার। এআই ব্যবহার করে আমার নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে নেতৃত্বের কাছে বারবার অভিযোগ জানানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। অভিযোগ জানানোর জন্য দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছতে পারিনি।
এ নিয়ে রাজন্যার স্বামী ও তৃণমূল ছাত্র পরিষদের আর এক সাসপেন্ডেড নেতা প্রান্তিক চক্রবর্তী দলেরই কর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছেন।
এই অভিযোগের বিরুদ্ধে তৃণমূলের কয়েকজন নেত্রী মুখ খুলেছেন। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের কন্যা প্রিয়দর্শিনী হাকিম, ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের কন্যা প্রিয়দর্শিনী ঘোষ, তৃণমূল কাউন্সিলর জয় বিশ্বাস প্রমুখ। তাদের প্রশ্ন, এত দিন পরে কেন এ নিয়ে সরব হলেন রাজন্যা? তাকে দীর্ঘদিন সাসপেন্ড করা হয়েছে। তার পরেও কেন তিনি মুখ খোলেননি, এখন তার স্বামী পুলিশে অভিযোগ জানাচ্ছেন কেন?
তৃণমূলের জয়ী ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন রাজন্যা। এই ব্যান্ডের সদস্য বৈশালী দত্তগুপ্ত বলেছেন, "আমি দীর্ঘদিন দল করছি। অনেক আন্দোলনে রাত জেগেছি, সেখানে দাদা-ভাইরা পাশে থেকেছেন। কখনো মনে হয়নি যে আমি অসুরক্ষিত।"
শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, তার বাইরেও নারী নিগ্রহের অভিযোগ উঠতে থাকে। পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায় গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতিতার দাবি, তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গ্রামের দুই যুবক ধর্ষণ করে। এক্ষেত্রে পুলিশ দ্রুত গ্রেপ্তার করেছে দুই অভিযুক্তকে।
এমনকী এক তৃণমূল নেত্রী শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলেছেন ভিলেজ পুলিশের বিরুদ্ধে। নদিয়ার কৃষ্ণনগরে চাপড়া থানা এলাকার বাসিন্দা ওই মহিলার দাবি, তাকে কুপ্রস্তাব দেয়া হলে তিনি রাজি হননি। তার হাত ধরে টানাটানি করা হয়। এই অভিযোগে ভিলেজ পুলিশের কর্মী অমিত পালকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনের ছবি বিষণ্ণ করে তুলেছে শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারকে।
তিনি বলেন, "এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থার অবনমন ঘটেছে। সেটা প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক হয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত। শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা অবহেলা ও তার থেকে কিছু লাভ তোলার চেষ্টা দেখা গিয়েছে। সে কারণেই আদালত ইউনিয়ন রুম বন্ধ করে দিতে বলেছে। নির্বাচিত সংসদের জায়গায় শাসকের অনুগামী ছাত্র-ছাত্রীরা দাপট দেখানোর সুযোগ পেয়েছে। এই পরিবেশে ছাত্রীদের দিয়ে মাথা টেপানো বা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। এটা সরকারের দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছে।"
সাহিত্যিক বাণী বসু বলেন, "অপদার্থতা এবং চূড়ান্ত নীচতার ফলে এসব ঘটনা ঘটছে। এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। শুধু নারীর কথা বলে লাভ নেই, কারো অধিকারই প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। তোমাকে চাটুকার হতে হবে, অসৎ হতে হবে, না হলে কিছু হবে না। পুরো দেশটা এভাবে চলছে।"
তবে বিষয়টিকে কোন একটি দল বা সরকারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাকে দায়ী করেছেন রাজ্য নারী কমিশনের সাবেক চেয়ারপারসন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, "এ ধরনের ঘটনা পিতৃতন্ত্রের একটা নির্লজ্জ প্রকাশ। পিতৃতন্ত্রকে অস্বীকার করে লিঙ্গ সাম্য প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সরকারের যে সদিচ্ছা থাকা দরকার, তার অভাব আছে। আমরা নারী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেখেছি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে ওড়িশায় নন্দিনী শথপতিকে দেখেছি। একজন নারী সামনে আছেন ঠিকই, কিন্তু প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আছে পুরুষতন্ত্রের হাতে। তাই সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। আগে এসএফআইয়ের এরকম দাপট ছিল বাম আমলে। কেউ বিরুদ্ধে কথা বললে সে রেহাই পেতো না। প্রত্যেকটা কলেজের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজ, নেতাজিনগর, বিজয়গড় কলেজ, সব ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক দাদারা নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো বিষয়টা। ক্ষমতার হাতবদলের সঙ্গে এটা বিলুপ্ত হবে আমরা আশা করিনি। কিন্তু তার যে উগ্র মূর্তি, সেটাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি এই আমলেও।"
গত বছরের আগস্ট মাসে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে কর্তব্যরত অবস্থায় এক চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুন করা হয়। এরপর নারী সুরক্ষার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে রাজ্যের শাসক দল। যদিও তার পরের একের পর এক উপনির্বাচনে সহজে জয় পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাহলে নারী সুরক্ষা নিয়ে নাগরিক সমাজের দাবি কি মান্যতা পাচ্ছে না?
অভিনেতা বাদশা মৈত্র বলেন, "যে কোনো আন্দোলন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। একটা মিছিল বা একটা রাত দখল থেকে মানুষ তার লক্ষ্যে পৌঁছবেই, তার কোনো মানে নেই। কিন্তু এটা ঠিক, একটা মিছিল আন্দোলন বা প্রতিবাদ লক্ষ্যে পৌঁছানোর দিকে দশ পা, বিশ পা করে এগিয়ে দেয়। এই যে এত মানুষ আন্দোলনে নেমেছিলেন, এবং ভবিষ্যতেও নামবেন, এটাই সাফল্য। যত বেশি মানুষের অংশগ্রহণ বাড়বে, তত শাসক সচেতন হতে বাধ্য হবে। এখন মেয়েদের প্রতি যে ঘটনা ঘটছে, তার সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রে শাসক দলের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। তারা পার পেয়ে যাচ্ছে ভোটে জিতছে বলে। কিন্তু যদি মানুষ সচেতন হয়, রাস্তায় নেমে টানা প্রতিবাদ করতে থাকে, শাসক দল বাধ্য হবে পরিস্থিতিতে বদল আনতে অথবা তারাই ক্ষমতা থেকে সরে যাবে।"