এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে সাফল্যকে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ‘প্রশ্ন ফাঁস’৷ শুধু এইচএসসি নয়, এখন সব ধরনের পরীক্ষার প্রশ্নই ফাঁস হচ্ছে! শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই অবস্থা অব্যহত থাকলে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে৷
বিজ্ঞাপন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে কোনো পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না৷ আজ যেসব শিক্ষার্থী ভালো রেজাল্ট করল তাদেরও মন ভার কেন? কারণ অনেকেই তাদের টিপ্পনি কেটে বলবে, তোমরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল করেছ! কিন্তু আসলে সব শিক্ষার্থী তো ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়নি৷ তাহলে তাদের কেন এমন কথা শুনতে হবে?''
তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, যা একটা জাতিকে মেরুদণ্ডহীন করে দেবে৷ তাঁর কথায়, ‘‘বর্তমানে যেভাবে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে তাতে ভবিষ্যত কিন্তু অন্ধকারের দিকেই যাচ্ছে৷ এ অবস্থা অব্যহত থাকলে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাবে৷ তারা মনে করবে, লেখাপড়া করে লাভ কী? পরীক্ষার আগেই তো প্রশ্ন পাওয়া যায়৷ তা দিয়ে পরীক্ষা দিলেই তো ভালো ফল মিলবে৷''
সব দেশেই শিক্ষার ধরণ আলাদা
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে, বিশেষকরে আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে৷
ছবি: Getty Images
সব স্কুল কি এক রকম?
সারা বিশ্বের ছাত্ররা একইভাবে পড়ালেখা শেখে? না, তবে প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে৷ কোনো দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা খোলা আকাশের নীচে মাটিতে পা মুড়ে বসে লেখাপড়া করে, কোথাও আবার স্কুল বেঞ্চে বসে৷ আবার কোনো কোনো দেশের ছাত্রদের রয়েছে নিজস্ব ল্যাপটপ৷
ছবি: AP
ডিজিটাল স্কুলের বই
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমে চলে৷ প্রতিটি ক্লাস রুমেই রয়েছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট৷ সরকারের ইচ্ছে সব স্কুল বই পুরোপুরিই ই-বুকে রূপান্তরিত করার৷ ডিজিটাল সিস্টেমে লেখাপড়া করতে কোনো ছেলে-মেয়ের যেন অসুবিধা না হয় এবং ডিজিটাল বইয়ের অভাবে যেন কারো লেখাপড়া বন্ধ না হয়, সেজন্য সরকার বিনা মূল্যে তাদের ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার দিয়ে থাকে৷
ছবি: AP
গ্রামের স্কুলে যাওয়ার অসুবিধা
অন্যভাবেও পড়াশোনা চলতে পারে৷ কোনোরকমে ঝুলানো একটি ব্ল্যাকবোর্ড এবং কয়েকটি কাঠের বেঞ্চই আফ্রিকার ঘানার এই স্কুলটির জন্য যথেষ্ট৷ এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখা পড়া করা যায়, যদিও কাগজে কলমে রয়েছে ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখপড়া বাধ্যতামূলক৷ পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় গ্রামের ছাত্রদের অনেকেরই লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
টাচপ্যাডের মাধ্যমে লেখা শেখা
তবে জার্মানির এই স্কুলটি ব্যতিক্রম৷ কাগজ, পেন্সিল ছাড়া ছাত্ররা পুরোপুরি স্মার্টবোর্ড এবং নেটবুকের মাধ্যমে লেখা শেখে৷ ডিজিটাল নেটওয়ার্কিং-এর ছাত্রদের যোগাযোগের কাজে সাহায্য করে এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়৷ জার্মানিতে এখনো দুই মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখতে পড়তে পারেন না, যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে জার্মানির সবাই লেখাপড়া জানেন৷
ছবি: AP
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই সুবিধা
শিল্পোন্নত দেশ মানেই সে দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যদেশের চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকা৷ এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও সেভাবেই তৈরি করা হয়, যেমন অ্যামেরিকার এই স্কুলটিতে৷ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলার শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ৭০ শতাংশ বাচ্চাই প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার আগে অনেককিছু শিখে ফেলে৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১০ জনের মধ্যে হয়ত তিনজন কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সুযোগ পায়৷
ছবি: AP
যেখানে শিক্ষা অর্থের জন্য বাঁধাগ্রস্থ
কেনিয়াতে সব ছাত্রই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারে৷ তারপরও অনেকে তার আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়৷ স্কুল ড্রেস, বই, খাতা, জুতো ইত্যাদি জোগাড় করা অনেক বাবা মায়ের জন্য কষ্টকর হয় দাঁড়ায়৷ সেখানে ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং পড়াশোনার মানও নিম্ন৷ যাঁদের সামর্থ রয়েছে সে রকম অনেক বাবা-মা তাঁদের বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠান৷
ছবি: DW/J.Bruck
স্কুল ড্রেস পরে লেখাপড়া
ইংল্যান্ডে স্কুল ড্রেস ছাড়া কেউ স্কুলে যায় না৷ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ কারণ স্কুল ড্রেস যার যার স্কুলের পরিচয় বহন করে এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী করে৷ দরিদ্র পরিবাররের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ড্রেসের জন্য স্কুল থেকে টাকা পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
খোলা আকাশের নীচে ক্লাসরুম
একটি পাবলিক পার্কে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের একটি স্কুলে৷ গরিব বাবা-মায়েরা পয়সার অভাবে এমন স্কুলেই তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন৷ পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, কারণ সরকার শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতে বেশি খরচ করে৷ যা ছাত্ররাও বুঝতে পারছে৷
ছবি: AP
কমপক্ষে মৌলিক শিক্ষা থাকতে হবে
আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও নানা সমস্যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ বিশেষকরে মেয়েদের ক্ষেত্রে একথাটি বেশি প্রযোজ্য৷ প্রতি দশজনের একজন লিখতে পড়তে পারে সেখানে৷ তবে এ হার পুরুষদের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ জন৷ তাছাড়া স্কুলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট স্কুলও নেই, অভাব রয়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার সরঞ্জামেরও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত
আফগানিস্তানের মতো প্রায় একই অবস্থা দক্ষিণ সুদানেও৷ এদেশেও মেয়েদের প্রতি পাঁচজনের একজন লিখতে ও পড়তে পারে৷ সেজন্যই বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো সুদানের মেয়েদের শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে৷ বহু বছরের গৃহযুদ্ধ সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷ অনেক স্কুলেই বই-খাতা এবং টেবিল-বেঞ্চও ঠিকমতো নেই৷
ছবি: dapd
কো-এডুকেশন পছন্দ নয়
কো-এডুকেশন? না, ইরানে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ ছেলে এবং মেয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করে ইরানে৷ এমন কি এই ইহুদি স্কুলেও ইসলামিক স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ এখানে মেয়েরা যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাইকেই চুল ঢেকে রাখতে হবে, অর্থাৎ হিজাব পরতে হবে৷
ছবি: AP
ধনী-গরিবের পার্থক্য
ব্রাজিলের গ্রামাঞ্চলের ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া করা বেশ কঠিন৷ কারণ সেখানকার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই৷ যেমন মন্টে আলেগ্রের এই স্কুলটির মতো ৷ যদিও ব্রাজিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটি, তারপরও এদেশে গরিব এবং ধনীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা একই রকম
বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল এবং রাজধানী ঢাকা শহরের স্কুলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ বড় শহরগুলোতে ছাত্ররা কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে৷ আর গ্রামের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটার ব্যবহার করার ইচ্ছা – এখনো স্বপ্ন!
ছবি: Getty Images
13 ছবি1 | 13
অবশ্য ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘‘এবার কিছু ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে৷ এর আগেও অনেকবার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, অনেক তদন্ত কমিটিও হয়েছে৷ কিন্তু সেসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কখনও আলোর মুখ দেখেনি৷ এবার কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পর যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করেছে৷ মন্ত্রণালয় বলছে, এর বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে৷ এটা আশাপ্রদ দিক৷ তবে শুধু মুখে বললে হবে না, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে৷ তাছাড়া পাশের হার যে বাড়ছে সেটা ইতিবাচক৷ কারণ খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে থাকে৷''
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার ইংরেজি ও গণিত (তত্ত্বীয়) দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র হুবহু ফাঁস হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি৷ তাঁরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের কপিও উদ্ধার করেছে৷ কিন্তু কী ভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা বের করতে পারেনি আন্তঃমন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি৷
এ বিষয়ে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য শিক্ষাবিদ ড. আখতারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তদন্ত কমিটি দেখেছে ৪০ নম্বরের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, যেটা মূল ফলে কোনো প্রভাব ফেলেনি৷ তারপরও এটা কোনো ভালো লক্ষণ না৷ প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে অবশ্যই সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে৷''
ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘‘এখন কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে সরকারকে বিব্রতকর করতে৷ কারণ প্রশ্ন ফাঁসের পরই সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে দিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ ফাঁসকারীরা এর ফলে সরকারকে, বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সামাজিকভাবে হেয় করতে চায়৷ আর যে নম্বরের প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে তা মূল নম্বরের খুবই নগণ্য অংশ৷ তারপরও যে কোনো পরীক্ষারই প্রশ্ন ফাঁস করার বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে৷ কারণ শুধু পরীক্ষার ফল নয়, চাকরির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হচ্ছে৷ এতে করে প্রশাসনেও মেধাহীনরা ঢুকে যাচ্ছে, বাদ যাচ্ছে মেধাবীরা৷''
তিনি বলেন, এবার এইচএসসি পরীক্ষায় মেয়েরা ভালো করেছে, জিপিএ-৫ বেড়েছে ও পাশের হার বেড়েছে – এই তিনটা দিক খুবই ইতিবাচক৷ এখন তো পরীক্ষায় নকল নেই, আছে প্রশ্ন ফাঁস৷ এটা রোধ করতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে৷
এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া ভিকারুন নিসা নূর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নাসরিন আক্তার বলেন, ‘‘ভালো ফল পেয়ে ভালো লাগছে৷ কিন্তু প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি সামনে আসায় মনটা খারায় হয়ে যাচ্ছে৷ আমরা উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে দেখিয়ে দিতে চাই যে, আমরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করিনি, আসলেই আমরা মেধাবী৷''