প্রস্তুতি সেরে টিকার অপেক্ষায় বাংলাদেশ
১৮ ডিসেম্বর ২০২০![ফেব্রুয়ারিতে টিকা দেয়ার শুরু করার জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ](https://static.dw.com/image/55970655_800.webp)
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেছেন, জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি বা শেষ নাগাদ বাংলাদেশে পৌঁছাবে অক্সফোর্ডের টিকা৷ তবে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে টিকা আসার কথা৷ সেভাবেই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি৷ তবে আগে এলেও সমস্যা নেই৷ প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়েছে৷''
বাংলাদেশ আপাতত শুধু অক্সফোর্ডের টিকা নিয়েই ভাবছে৷ মডার্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিন নিয়ে ভাবনা একেবারেই নেই৷ অক্সফোর্ডের টিকা সংরক্ষনের জন্য মাইনাস ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে হবে৷ প্রতিটি জেলায় টিকা রাখার জন্য পর্যাপ্ত ফ্রিজ আগে থেকেই আছে৷ নতুন করে আরো কিছু ফ্রিজ কেনার জন্য ইতিমধ্যে টেন্ডার আহবান করা হয়েছে৷ পাশাপাশি যারা টিকা দেবেন তাদের প্রশিক্ষণও শুরু হচ্ছে ডিসেম্বরেই৷ তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত অন্য টিকাও যদি আগে পাওয়া যায় সে চেষ্টাও সরকার করছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম৷
তিনি বলেন, টিকা সংরক্ষণের জন্য কোল্ড চেইন ইকুইপমেন্ট, এডি সিরিঞ্জ, সেফটি বক্স, এইএফআই কিট বক্স, এইএফআই ফরমস, সার্জিক্যাল মাক্স, পয়েন্টিং ম্যাটেরিয়ালস, আইস প্যাক, ভ্যাকসিন ক্যারিয়ার, আইস লাইনার রেফ্রিজারেটর, পুশিং ফ্রিজ ইনডিকেটর, ফ্রিজ ট্যাগ, সেফটি বক্সসহ যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুরই ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ কিছু আমাদের আছে আর কিছু কেনার জন্য ইতিমধ্যে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে৷ এসব চাহিদা পূরণের জন্য সরকারকে আগেই চিঠি দিয়েছিল টিকা সংক্রান্ত কমিটি৷
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, প্রতি বছর সাড়ে তিন কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের৷ ফলে প্রতি মাসে যে ৫০ লাখ করে টিকা আসবে, সেটার ব্যবস্থাপনা খুব একটা কঠিন হবে না৷ এমনকি বেশি এলেও কোনো সমস্যা নেই৷ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে দেশে আসার পর বেক্সিমকো নিজ তত্ত্বাবধানেই প্রতিটি জেলায় পৌঁছে দেবে৷ এরপর সরকারি উদ্যোগে উপজেলায় নেওয়া হবে৷
উপজেলা পর্যায়ে টিকা কিভাবে নেওয়া হবে? ডা. আলম বলেন, ‘‘টিকা বহনের জন্য যে ধরনের সরঞ্জাম দরকার সেটা আমাদের আছে৷ এমনকি যারা টিকা দেবেন তাদের প্রশিক্ষনও শুরু হচ্ছে ডিসেম্বরের শেষে৷''
সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে যে চুক্তি হয়েছে তাতে পর্যায়ক্রমে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে৷ ভ্যাকসিন কেনা ও বিতরণ মিলে খরচ হবে এক হাজার ৫৮৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা৷ প্রথম ডোজের ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজের হিসেবে প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ দেয়া যাবে ২৫ লাখ মানুষকে৷ সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে পাওয়া টিকা যাদের দেওয়া হবে তাদের কোন খরচ দিতে হবে না৷ এই খরচ সরকার বহন করবে৷ এটা দেওয়া হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে৷ ১০ ধরনের অগ্রাধিকার তালিকা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করে ফেলেছে সরকার৷
ভ্যাকসিন বিষয়ক এই কর্মসূচি পরিচালিত হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মা, শিশু ও কিশোর স্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায়৷ কর্মসূচির পরিচালক ডা. শামসুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য ১০ হাজার ৪০০ টিম তৈরি করেছি৷ প্রতিটি টিমে ৬ জন করে থাকবেন৷ এর মধ্যে দুই জন স্বাস্থ্য সহকারি এবং বাকি ৪ জন স্বেচ্ছাসেবক৷ প্রতিটি টিম মাসে ১২ দিন করে টানা ৬ মাস দায়িত্ব পালন করবে৷ তাদের প্রশিক্ষণের গাইডলাইনও চূড়ান্ত৷ যে কোনো দিন প্রশিক্ষন শুরু হবে৷ টিকা কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে আমাদের ৩ থেকে ৯ বছর বয়সি শিশুদের হাম ও রুবেলার টিকা দেওয়া কর্মসূচি চলছে৷ এটা আগামী ২৩ জানুয়ারির মধ্যে শেষ হবে৷''
ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তিন কোটি ছাড়াও গ্যাভির ছয় কোটি ৮০ লাখসহ মোট নয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ৷ ডা. শামসুল হক বলেন, ‘‘এই ভ্যাকসিন দিয়ে প্রতি দুই ডোজ একজন হিসেবে তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষকে দেওয়া যাবে৷ ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে৷
এদিকে করোনা ভাইরাসের টিকা দেয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার তালিকা করতে উপজেলা কমিটি গঠন করেছে সরকার৷ গত সোমবার এই কমিটি গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আদেশ জারি করা হয়েছে৷ এই কমিটি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রদান সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে কাজ করবে৷ কমিটির উপদেষ্টা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)৷ এছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে, সহকারি কমিশনার (ভূমি), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), পৌরসভার মেয়র, উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, আইসিটি অধিদফতরের সহকারী প্রেগ্রামার, দু'জন গণ্যমান্য ব্যক্তি ও স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কাজ করে এমন দু'জন এনজিও প্রতিনিধি (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনোনীত)৷ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন৷
ন্যাশনাল ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির চেয়ার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘‘ভ্যাকসিন দেয়া হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে৷ ১০ ধরনের অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা হয়েছে৷ যে ১০ ধরনের জনগোষ্ঠীতে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে আছেন, মুক্তিযোদ্ধা, করোনা মোকাবিলায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী, সম্মুখসারির কর্মী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী, বয়োজ্যেষ্ঠ জনগোষ্ঠী, দীর্ঘ মেয়াদী রোগে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী, শিক্ষা কর্মী, গণমাধ্যম কর্মী৷ ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, বয়োজ্যেষ্ঠ বলতে ষাটোর্ধ ব্যক্তিদের বোঝানো হচ্ছে৷
বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন দুই লাখ ১০ হাজার, সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন তিন লাখ, বেসরকারি কর্মী রয়েছেন সাত লাখ, স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন এমন এনজিও কর্মী রয়েছেন দেড় লাখ৷ গণমাধ্যম কর্মী রয়েছেন ৫০ হাজার৷ জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাঁচ হাজার৷ পুলিশ বাহিনীর সদস্য দু'লাখের ওপরে৷ ক্যানসার, যক্ষ্মা আর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী ধরা হয়েছে এক লাখ দুই হাজারের মতো৷ সেনাবাহিনীর জন্য ধরা হয়েছে তিন লাখ৷ সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধি ধরা হয়েছে ৭০ হাজার৷ এরা অগ্রাধিকার তালিকায় আছেন৷