গবেষণাগারে প্রাণীদের উপর পরীক্ষা শুধু নিষ্ঠুর ও কষ্টকরই নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তা সবসময় কার্যকরও নয়৷ জার্মানির একদল বিজ্ঞানী এর বিকল্প ও অনেক নিখুঁত পদ্ধতি সৃষ্টি করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
মার্সেল লাইস্ট-এর নেতৃত্বে গবেষকদের এক দল জানতে চান, কোন পদার্থ মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে৷ কোষগুলি এমন এক নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা অনেকটা ক্ষুদ্রকায় মস্তিষ্কের মতো৷ ভ্রূণের মস্তিষ্কের সঙ্গে তার তুলনা করা চলে৷
বিজ্ঞানীরা তাতে কীটনাশক যোগ করলে টাইমল্যাপ্স ভিডিওতে দেখা যায়, স্নায়ুকোষের নেটওয়ার্ক কীভাবে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে৷ প্রাণীর উপর পরীক্ষা চালিয়ে তা দেখা সম্ভব হতো না৷ মার্সেল লাইস্ট বলেন, ‘‘এগুলি মানুষের নিউরন৷ আমরা ইঁদুরের উপর বিষক্রিয়ার প্রভাব নিয়ে আগ্রহী নই৷ তাহলে তো ইঁদুরের বিষ তৈরি করতাম৷ আমরা মানুষের ক্ষেত্রে পূর্বাভাষ দিতে চাই৷ আমাদের মতে, একমাত্র মানুষের কোষ দিয়েই তা সম্ভব৷''
টোমাস হার্টুং ও মার্সেল লাইস্ট দীর্ঘকাল ধরে একসঙ্গে কাজ করছেন৷ আশির দশকে ট্যুবিঙেন শহরে উচ্চশিক্ষার সময়ে বিষক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাণীদের উপর পরীক্ষা স্বাভাবিক বিষয় ছিল৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীদের উপর পরীক্ষার সার্বিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের মনে সংশয় বাড়ছে৷ মার্সেল বলেন, ‘‘শিল্পজগতে এবং পরে ওষুধ সৃষ্টির কাজ করার সময় আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে৷ আমরা বার বার দেখেছি, যে প্রাণীদের ক্ষেত্রে আমাদের পর্যবেক্ষণ হাসপাতালে হুবহু কাজ করেনি৷''
টোমাস হার্টিং বাল্টিমোরে যে সফটওয়্যার সৃষ্টি করেছেন, তাঁর ছাত্রছাত্রীদের তিনি তা দেখাচ্ছেন৷ সেটি প্রাণীদের উপর পরীক্ষা সংক্রান্ত বিশাল তথ্যভাণ্ডার মূল্যায়ন করে৷ তাতে দেখা গেছে, এমনকি একটি প্রাণীর উপর পরীক্ষা চালালে তার ফলাফল অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও পুরোপুরি খাটে না৷
যেসব তারকা প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করেন
বিশ্বব্যাপী প্রাণীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছু সংগঠন৷ তাদের কার্যক্রমে মানুষকে আকৃষ্ট করতে তারকাদের সহায়তা নেয় এসব সংস্থা৷
ছবি: AP
রায়ান গোসলিং
ক্যানাডীয় অভিনেতা ও সংগীত শিল্পী গোসলিং ২০০৩ সালে কেএফসির কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন৷ মুরগি পালন ও জবাইয়ের ক্ষেত্রে আরেকটু মানবিক হতে কেএফসিকে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ পরবর্তীতে ম্যাকডোনাল্ডসকেও একইরকম বার্তা পাঠান গোসলিং৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Horcajuelo
এলেন ডিজেনেরাস
মার্কিন এই কমেডিয়ান টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর জনপ্রিয় শো-তে নিয়মিতভাবে প্রাণী অধিকারের বিষয়টি তুলে আনেন৷ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৯ সালে তাঁকে ‘ওমেন অফ দ্য ইয়ার’ খেতাব দেয় প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশ্বের অন্যতম বড় সংগঠন ‘পিপল ফর দ্য এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অফ অ্যানিমেল’ (পেটা)৷
ছবি: Getty Images/K. Winter
ক্রিস্টেন বেল
মার্কিন অভিনেত্রী ও সংগীত শিল্পী বেল ১১ বছর বয়স থেকেই ভেজিটেরিয়ান৷ পেটা ২০০৬ সালে তাঁকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে যৌনআবেদনময়ী ভেজিটেরিয়ান’-এর খেতাব দেয়৷ প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনকে তিনি আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকেন৷ মাঝেমধ্যে তাঁদের কার্যক্রমেও অংশ নেন বেল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sanchez-Gonzales
কেশা
২৮ বছর বয়সি মার্কিন এই সংগীত শিল্পী সীল, সিংহ ও হাঙরের মতো প্রাণীর অধিকারের জন্য তাঁর জনপ্রিয়তা কাজে লাগাচ্ছেন৷ কসমেটিকস তৈরিতে বিভিন্ন প্রাণী নিধনের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার৷ এ ধরনের কাজের জন্য তিনি স্বীকৃতিও পেয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভিওলা ডেভিস
সার্কাসের হাতিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা বাধ্য করে আইন করতে যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ড স্টেটের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন মার্কিন অভিনেত্রী ভিওলা ডেভিস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ডেমি মুর
সার্কাসের হাতিদের প্রশিক্ষণে অঙ্কুশ ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রাণীদের প্রতি তাঁর অনুভূতির জানান দেন ডেমি মুর৷
ছবি: Getty Images
পল ম্যাকার্টনি
নিজেদের পালিত একটি ভেড়াকে জবাইয়ের পর নিজেদের প্লেটে মাংস হিসাবে রূপান্তরিত হতে দেখে ভেজিটেরিয়ান হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিটলসখ্যাত পল ও তাঁর স্ত্রী লিন্ডা ম্যাকার্টনি৷ সেই থেকে এই দম্পতি পেটা সহ অন্য আরেকটি প্রাণী অধিকার বিষয়ক সংগঠনকে সহায়তা করে থাকে৷ তাঁরা বলেন, ‘‘যদি কসাইখানাগুলোর দেয়াল কাচের হতো তাহলে সবাই ভেজিটেরিয়ান হয়ে যেত৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Scheidemann
প্যামেলা অ্যান্ডারসন
বেওয়াচখ্যাত অভিনেত্রী প্যামেলা অ্যান্ডারসন পেটা-র হয়ে অনেকগুলো কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন৷ যেমন ২০০৩ সালে তিনি পেটা-র ‘পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরার পরিবর্তে আমি নগ্ন হয়ে থাকব’ কর্মসূচিতে অংশ নেন৷ ২০০১ সালে তিনি কেএফসি-র বিরুদ্ধে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘প্রতিবছর কেএফসি সাড়ে সাতশ মিলিয়ন মুরগির সঙ্গে যা করে তা গ্রহণযোগ্য নয়৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
বলিউড তারকারাও সোচ্চার
বেশ কয়েকজন বলিউড তারকাও প্রাণী অধিকারের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন৷ এঁদের মধ্যে আছেন হেমা মালিনি, মাধুরী দীক্ষিত, জন আব্রাহাম, সেলিনা জেটলি, শিল্পা শেঠী, অর্জুন রামপাল ও শাহেদ কাপুর৷
ছবি: UNI
9 ছবি1 | 9
টেস্ট টিউবে মানুষের কোষ নিয়েইন-ভিট্রো পদ্ধতিতে পরীক্ষা চালানোই এর সমাধানসূত্র৷ এই কোষগুলি ‘মিনি-মস্তিষ্ক'-এর মতো ক্ষুদ্রকায় ইন্দ্রিয় তৈরি করে৷ বৈজ্ঞানিকদের মনে সুস্পষ্ট প্রশ্ন থাকলে তবেই ইন-ভিট্রো পদ্ধতি কাজ করে৷ যেমন কোন পদার্থ মস্তিষ্কের কোন কোষের ক্ষতি করে? তবে প্রাণীদের উপর পরীক্ষা পুরোপুরি বন্ধ হতে অনেক সময় লাগবে৷ বিশ্বব্যাপী বছরে আনুমানিক ৪ লক্ষ খরগোশকে এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়৷ অথচ টোমাস হার্টুং এর বিকল্প প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেছেন৷
পাইরোজেন পরীক্ষার সময় খরগোশের কানে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ওষুধ, টিকা অথবা রক্ত প্রবেশ করানো হয়৷ সেই কারণে জ্বর হলে জ্বর সৃষ্টিকারী পাইরোজেন পরীক্ষার স্যাম্পেলগুলি অশুদ্ধ করে তোলে৷
হার্টুং-এর পদ্ধতিতে খরগোশের বদলে মানুষের রক্ত ব্যবহার করা হয়৷ তরলের রং পরিবর্তনই স্যাম্পেলের অশুদ্ধতা দেখিয়ে দেয়৷ তার থেকেও খারাপ বিষয় হলো, এখন আর এমন পরীক্ষা প্রায় হয়-ই না৷
অর্থাৎবিকল্প ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কোম্পানিগুলি প্রাণীর উপর পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে৷মার্সেল লাইস্ট তাতে দমে যাবার পাত্র নন৷ ২০০৬ সাল থেকে তিনি কনস্টানৎস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন৷ জার্মানিতে এই ক্ষেত্রে প্রথম এমন পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল৷ এর মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তনও ঘটেছে৷ মার্সেল লাইস্ট বলেন, ‘‘১০ বছর আগে এমন পরীক্ষার সুযোগই ছিল না৷ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব ছাড়া কারো কাছে এমন প্রক্রিয়া ছিল না৷ এর মধ্যে এমন পরীক্ষার বিকল্প পদ্ধতির সরঞ্জাম কেনা যায়৷ যত বেশি কোম্পানি অন্যান্য কোম্পানিগুলিকে এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে দেখছে, সেই পদ্ধতির ব্যবহারও বাড়ছে৷''
এর মধ্যে শিল্পজগতে গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাণীর উপর পরীক্ষার প্রায় ৮০ শতাংশ বন্ধ করে নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ করা হচ্ছে৷ তার পেছনে কনস্টানৎস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের বিশাল অবদান রয়েছে৷
প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশের অদ্ভুত ব্যবহার
হাতির দাঁত ও গণ্ডারের শিং-এর যে মূল্যবান ব্যবহার আছে তা আমরা অনেকেই জানি৷ এর বাইরেও অদ্ভুত ও অনেকটা অপ্রয়োজনীয় কারণে প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশ কাজে লাগায় মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacad
ভল্লুকের থাবা
ভল্লুকের পিত্ত ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে৷ এছাড়া তাদের থাবা খাবার হিসেবে খেয়ে থাকেন এশিয়ার কয়েকটি দেশের মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/ChinaFotoPress
কচ্ছপের খোলস
কয়েক শতাব্দী আগে কচ্ছপের খোলস দিয়ে অলংকার, শিল্পকর্ম, চুলের অ্যাকসেসরিজ ইত্যাদি তৈরি করা হতো৷ এ কাজে সাধারণত ‘হকসবিল’ কচ্ছপের খোলস ব্যবহৃত হতো৷ ফলে ধীরে ধীরে ঐ কচ্ছপের বিলুপ্তি ঘটছিল৷ তাদের বাঁচাতে ১৯৭৩ সালে কচ্ছপের খোলসের ব্যবসার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও বিশ্বের অনেক অঞ্চলে এখনও তা চলছে৷
ছবি: Robert Harding
নপুংসকতার চিকিৎসায় বাঘের হাড়
চীনে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বাঘের চামড়ার কদর আছে৷ এর বাইরে বাঘের হাড় দিয়ে ওয়াইন তৈরি করা হয়৷ নপুংসকতা ও বাতের চিকিৎসায়ও বাঘের হাড় ব্যবহৃত হয়৷
ছবি: EIA
হাঙরের ডানা
স্যুপ হিসেবে খাওয়ার জন্য হাঙরের ডানা কেটে নেয়া হয়৷ কিন্তু হাঙরের মাংসের যেহেতু কোনো কদর নেই, তাই ডানা কাটা অবস্থাতেই হাঙরগুলোকে সাগরে ছেড়ে দেয়া হয়৷ কিন্তু ডানা না থাকায় হাঙরের পক্ষে সাঁতার কাটা সম্ভব হয় না৷ ফলে সাগরে নামিয়ে দেয়ার কয়েকদিনের মধ্যে কষ্ট পেয়ে প্রাণ হারায় সে৷
ছবি: Gerhard Wegner/Sharkproject
চিতার ত্বক
মধ্য এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ আর রাশিয়ায় পোশাক তৈরিতে চিতার চামড়ার ব্যবহার আছে৷ এছাড়া বাঘের মতো চিতার হাড়ও এশিয়ায় ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হরিণের লালাগ্রন্থি
সুন্দর গন্ধের জন্য পারফিউম তৈরিতে হরিণের লালাগ্রন্থি ব্যবহৃত হয়৷ লালাগ্রন্থি সংগ্রহ করতে হরিণকে মারার প্রয়োজন না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটিই করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/Mary Evans Picture Library
ধনেশ পাখির শিং, পালক
ছবিটি রাইনোসেরোস গোত্রের ধনেশ পাখির৷ পোষা প্রাণী হিসেবে তাদের ব্যবহার আছে৷ এছাড়া তাদের পালকও অনেক কাজে লাগে৷ হেলমেটেড ধনেশের শিং হাতির দাঁতের মতোই মূল্যবান৷