এই হিন্দু পরিবারের এক সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন৷ প্রাণের বিনিময়ে টাকা পেয়েছে সেই পরিবার, তবে হামলাকারীদের কোনো শাস্তি হয়েছে কিনা, তা তাদের অজানা৷ হামলার দিন ও পরের এক বছরে কী হয়েছে শুনুন এক ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকারে৷
বিজ্ঞাপন
২০১৪ সালে বিশ্বের কোন দেশের মানুষ কেমন ধর্ম পালনের সুযোগ পেয়েছে, কোন দেশের সংখ্যালঘুরা কেমন অধিকার ভোগ করেছে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার৷ ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও উপস্থিত ছিলেন প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে৷ প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘ইন্টারন্যশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম ইন ২০১৪'৷ তাতে মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের পরিস্থতিই উঠে এসেছে৷
বুধবার ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মূলত তিনটি বিষয় বলা হয়েছে – এক, বাংলাদেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ২০১৪ সালে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়ার কাজে দক্ষতার পরিচয় দেয়নি৷ দুই, হামলার ঘটনা তদন্তে সরকারি প্রশাসনকে অনিচ্ছুক বলে মনে হয়েছে৷ এবং তিন, পুলিশ হামলা প্রতিরোধে অনেক ক্ষেত্রে আগাম ব্যবস্থা তো নেয়নি, হামলার পর অনেক জায়গায় তারা মামলাও নেয়নি৷
এক সংখ্যালঘুর সাক্ষাৎকার
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত হিন্দুদের প্রায় ২৬ লক্ষ একর জমি অর্পিত সম্পত্তি আইনের আওতায় দখল হয়েছে৷ দশ লক্ষেরও বেশি মামলা হয়েছে৷ কিন্তু একটি মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি৷
বাংলাদেশের কয়েকটি প্রথম সারির মানবাধিকার সংস্থার তথ্য ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি এই বার্ষিক প্রতিবেদনে কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে৷ ২০১৪ সালের মে মাসে ১২ বছর বয়সি এক হিন্দু মেয়েকে জোর করে মুসলমান বানানো হয়৷ মেয়েটির পরিবার থানায় গিয়েছিল অভিযোগ দায়ের করতে৷ কিন্তু পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়৷
অনেক সময় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণেও সংখ্যালঘু, বিশেষত হিন্দুদের ওপর ব্যাপক হামলা-নির্যাতন হয় – এমন তথ্যও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে৷ দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ২০১৪ সালেরই আরেকটি ঘটনা৷ ৫ই জানুয়ারি একটি নির্বাচনি এলাকায় দুই হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করা হয়৷ ধর্ষণে জড়িত সন্দেহে দু'জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, নির্বাচনের কারণেই হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর হামলা চালানো হয়েছে৷ ২০১৪ সালে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই সংখ্যালঘুদের ওপর সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে৷
অমিয় দাশ সাক্ষাৎকার ২
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চিকইকাচদহ গ্রামের এই পরিবারটির ওপরও ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের দিনেই হামলা হয়েছিল৷ একটি ভোটকেন্দ্রের কাছেই এক হিন্দু পাড়ায় তাদের বাড়ি৷ ভোট কেন্দ্রে শুরু হওয়া সংঘর্ষের রেশ অকারণেই এসে পড়ে হিন্দু পাড়ায়৷ অসুস্থ সত্যেন্দ্রনাথ বর্মন তখন নিজের বাড়িতে বসেছিলেন৷ লাঠিসোঁটা নিয়ে ছুটে আসা কিছু লোকের হামলায় তিনি আহত হন৷ হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান সত্যেন্দ্র৷
নিহত সত্যেন্দ্র নাথ বর্মনের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানা গেল, হামলার পর পুলিশ তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিল, মামলা করা হবে, হামলাকারীদের শাস্তিও দেয়া হবে৷ কিন্তু গত দেড় বছরেরও বেশি সময়ে কোনো মামলা হয়েছে কিনা, তা পরিবারটির জানা নেই৷
অডিও সাক্ষাৎকারটি শুনে অনুমান করুন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের তথ্যগুলো কতটা সঠিক, গাইবান্ধার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিছু হিন্দু পরিবার আসলে কেমন আছেন৷
মালোপাড়ার হিন্দুদের কান্না থামেনি
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়াকে ঘিরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার মালোপাড়ায় ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি লুটপাটও করা হয়৷
ছবি: DW
নেই নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া
যশোরের অভয়নগরের চাপাতলী গ্রামের প্রবেশপথে পুলিশের সতর্ক অবস্থান৷ গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের দিন এই গ্রামের নিম্নবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত মালোপাড়ায় বসবাসরতদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে৷ আক্রান্তরা জানান, ঘটনাস্থলের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে থানার অবস্থান হলেও অনেক ফোন করেও সে সময়ে পুলিশ কিংবা কোনো নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া মেলেনি৷
ছবি: DW
‘নদী ঠাকুর’
দুর্বৃত্তদের হামালায় লণ্ডভণ্ড মায়া রানি বিশ্বাসের একমাত্র মাথা গোঁজার ছোট্ট নিবাস৷ সেদিন হামলা শুরু হলে পাশের বুড়ি ভৈরব নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে উঠে প্রাণে বেঁচে যান বিধবা এই নারী৷ তাঁর ভাষায় ‘নদী ঠাকুর’ সেদিন না থাকলে জানটা হয়ত থাকতো না৷
ছবি: DW
প্রাণ বাঁচাতে নদীতে
নিজের ঘরের ভাঙা আসবাব, টেলিভিশনের পাশে মালোপাড়ার গৃহবধু উজ্জ্বলা বিশ্বাস৷ হামলাকারীদের ভয়াবহ রূপ সামান্য দেখেছিলেন তিনি৷ প্রাণ বাঁচাতে তিনিও ঝাঁপ দেন বুড়ি ভৈরবে৷ হামলার সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল যে ভগবান সেদিন পাশে ছিলেন না৷
ছবি: DW
বই-পত্র পুড়িয়ে দিয়েছে
কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের বই-পত্র, এমনকি সার্টিফিকেটও পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা৷
ছবি: DW
সুন্দর স্বপ্নে চির
হামলাকারীদের ভেঙে দেয়া আয়নায় কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব৷ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো এই ভাঙা আয়নার মতোই মঙ্গলার সুন্দর স্বপ্নেও চির ধরিয়েছে হামলাকারীরা৷ মঙ্গলার আক্ষেপ, তাঁর বই-পত্র আর সার্টিফিকেট কী দোষ করলো?
ছবি: DW
আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয়
হামলার ছয় দিন পরে এঁরা ফিরছেন বাড়িতে৷ হামলার সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: DW
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী
৮৬ বছর বয়সি মৃত্যুঞ্জয় সরকার সেদিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও দেশ ছাড়েননি তিনি৷ কিন্তু হামলার পর তাঁর মনে হচ্ছিল যে, সে সময়ে ছেড়ে যাওয়াটাই উচিত ছিল তাঁর৷
ছবি: DW
গাছও রেহাই পায়নি
বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি মালোপাড়ার গাছও জ্বালিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: DW
পলাতক জামায়াত নেতা
মালোপাড়ায় হামলার পরে চাপাতলী গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বালিয়াডাঙ্গায় স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর থানা আমীর মাওলানা আব্দুল আজিজের বাড়ি ভাঙচুর করে যৌথবাহিনী৷ ঘটনার আগে থেকেই পলাতক রয়েছেন এ জামায়াত নেতা৷
ছবি: DW
আক্রান্তদের অভিযোগ
জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুল ওহাব৷ মালোপাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য জামায়াত শিবির ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলকেও দায়ী করেছেন অনেকে৷ সাবেক এই সাংসদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন৷ সেখানে নতুন প্রার্থী হিসেবে রণজিৎ রায় মনোনয়ন পাওয়ায় এই দুই জনের সমর্থকদের মাঝে বেশ উত্তেজনা ছিল পুরো নির্বাচনের সময়টায়৷
ছবি: DW
গণধর্ষণ
যশোরের আরেক ভয়াল জনপদ মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল গ্রামের দাসপাড়ার বাসিন্দা অনারতী দাস৷ ৭ জানুয়ারি রাতে তাঁর সামনেই অস্ত্রের মুখে একদল দুবৃত্ত গণধর্ষণ করে পুত্রবধু মনিমালা দাস আর ভাতিজি রূপালী দাসকে৷
ছবি: DW
ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী
কার্তিক দাসকেও সেদিন রাতে সেই ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিল৷ দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার নিম্নবর্ণের হিন্দু মনিমালা দাসের শ্বশুর ও রূপালী দাসের চাচা তিনি৷
ছবি: DW
বাড়িঘর ছেড়েছেন
দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার হওয়া পরিবার দুটি আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়েছেন৷
ছবি: DW
শুধুই আতঙ্ক
দাসপাড়ার এক নারী৷ দাসপাড়ার নারীদের এখন নির্ঘুম রাত কাটে আতঙ্কে৷