প্রাথমিক পর্যায়ের স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দিষ্ট করে দেওয়া বিধি কেন মেনে চলা হয়নি, জানতে চাইছে কলকাতা হাইকোর্ট৷
বিজ্ঞাপন
৬ ফেব্রুয়ারি শুনানির দিন৷ ওই দিনই কলকাতা হাইকোর্টের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে, প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া আইনি বিধি কেন মেনে চলা হয়নি৷ এর আগে কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল, শিক্ষক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে যাঁদের শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ আছে, তাঁদের অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ তাঁদের পরে সুযোগ পাবেন, যাঁদের প্রশিক্ষণ নেই, তাঁরা৷
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক স্কুলগুলির প্রায় ৪০ হাজার শূন্য পদের মধ্যে ২৭ হাজার পদে নিয়োগের জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশন যে পরীক্ষা নিয়েছিল, তার ফলাফলের ভিত্তিতে যে নিয়োগপত্র দেওয়া শুরু হয়েছে, সেখানে এই নিয়ম মেনে চলা হয়নি৷ ওই ২৭ হাজার শূন্য শিক্ষক পদের জন্য যে ১৭ লক্ষ আবেদনকারী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র এক হাজার জন এই আপত্তি তুলে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন৷ আর তাতেই রাজ্য জুড়ে আটকে গিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ৷ অথচ কিছু সফল প্রার্থী তাঁদের নিয়োগপত্র এর মধ্যেই হাতে পেয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা কাজে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন৷ এবং বলা বাহুল্য, চাকরি পাওয়া যে কোনও বাড়িতেই অত্যন্ত খুশির খবর৷ কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশ সেই খুশিতে জল ঢেলেছে কারণ, নিয়ম মেনে চলেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর৷
সব দেশেই শিক্ষার ধরণ আলাদা
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে, বিশেষকরে আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে৷
ছবি: Getty Images
সব স্কুল কি এক রকম?
সারা বিশ্বের ছাত্ররা একইভাবে পড়ালেখা শেখে? না, তবে প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে৷ কোনো দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা খোলা আকাশের নীচে মাটিতে পা মুড়ে বসে লেখাপড়া করে, কোথাও আবার স্কুল বেঞ্চে বসে৷ আবার কোনো কোনো দেশের ছাত্রদের রয়েছে নিজস্ব ল্যাপটপ৷
ছবি: AP
ডিজিটাল স্কুলের বই
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমে চলে৷ প্রতিটি ক্লাস রুমেই রয়েছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট৷ সরকারের ইচ্ছে সব স্কুল বই পুরোপুরিই ই-বুকে রূপান্তরিত করার৷ ডিজিটাল সিস্টেমে লেখাপড়া করতে কোনো ছেলে-মেয়ের যেন অসুবিধা না হয় এবং ডিজিটাল বইয়ের অভাবে যেন কারো লেখাপড়া বন্ধ না হয়, সেজন্য সরকার বিনা মূল্যে তাদের ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার দিয়ে থাকে৷
ছবি: AP
গ্রামের স্কুলে যাওয়ার অসুবিধা
অন্যভাবেও পড়াশোনা চলতে পারে৷ কোনোরকমে ঝুলানো একটি ব্ল্যাকবোর্ড এবং কয়েকটি কাঠের বেঞ্চই আফ্রিকার ঘানার এই স্কুলটির জন্য যথেষ্ট৷ এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখা পড়া করা যায়, যদিও কাগজে কলমে রয়েছে ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখপড়া বাধ্যতামূলক৷ পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় গ্রামের ছাত্রদের অনেকেরই লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
টাচপ্যাডের মাধ্যমে লেখা শেখা
তবে জার্মানির এই স্কুলটি ব্যতিক্রম৷ কাগজ, পেন্সিল ছাড়া ছাত্ররা পুরোপুরি স্মার্টবোর্ড এবং নেটবুকের মাধ্যমে লেখা শেখে৷ ডিজিটাল নেটওয়ার্কিং-এর ছাত্রদের যোগাযোগের কাজে সাহায্য করে এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়৷ জার্মানিতে এখনো দুই মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখতে পড়তে পারেন না, যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে জার্মানির সবাই লেখাপড়া জানেন৷
ছবি: AP
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই সুবিধা
শিল্পোন্নত দেশ মানেই সে দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যদেশের চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকা৷ এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও সেভাবেই তৈরি করা হয়, যেমন অ্যামেরিকার এই স্কুলটিতে৷ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলার শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ৭০ শতাংশ বাচ্চাই প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার আগে অনেককিছু শিখে ফেলে৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১০ জনের মধ্যে হয়ত তিনজন কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সুযোগ পায়৷
ছবি: AP
যেখানে শিক্ষা অর্থের জন্য বাঁধাগ্রস্থ
কেনিয়াতে সব ছাত্রই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারে৷ তারপরও অনেকে তার আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়৷ স্কুল ড্রেস, বই, খাতা, জুতো ইত্যাদি জোগাড় করা অনেক বাবা মায়ের জন্য কষ্টকর হয় দাঁড়ায়৷ সেখানে ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং পড়াশোনার মানও নিম্ন৷ যাঁদের সামর্থ রয়েছে সে রকম অনেক বাবা-মা তাঁদের বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠান৷
ছবি: DW/J.Bruck
স্কুল ড্রেস পরে লেখাপড়া
ইংল্যান্ডে স্কুল ড্রেস ছাড়া কেউ স্কুলে যায় না৷ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ কারণ স্কুল ড্রেস যার যার স্কুলের পরিচয় বহন করে এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী করে৷ দরিদ্র পরিবাররের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ড্রেসের জন্য স্কুল থেকে টাকা পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
খোলা আকাশের নীচে ক্লাসরুম
একটি পাবলিক পার্কে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের একটি স্কুলে৷ গরিব বাবা-মায়েরা পয়সার অভাবে এমন স্কুলেই তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন৷ পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, কারণ সরকার শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতে বেশি খরচ করে৷ যা ছাত্ররাও বুঝতে পারছে৷
ছবি: AP
কমপক্ষে মৌলিক শিক্ষা থাকতে হবে
আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও নানা সমস্যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ বিশেষকরে মেয়েদের ক্ষেত্রে একথাটি বেশি প্রযোজ্য৷ প্রতি দশজনের একজন লিখতে পড়তে পারে সেখানে৷ তবে এ হার পুরুষদের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ জন৷ তাছাড়া স্কুলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট স্কুলও নেই, অভাব রয়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার সরঞ্জামেরও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত
আফগানিস্তানের মতো প্রায় একই অবস্থা দক্ষিণ সুদানেও৷ এদেশেও মেয়েদের প্রতি পাঁচজনের একজন লিখতে ও পড়তে পারে৷ সেজন্যই বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো সুদানের মেয়েদের শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে৷ বহু বছরের গৃহযুদ্ধ সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷ অনেক স্কুলেই বই-খাতা এবং টেবিল-বেঞ্চও ঠিকমতো নেই৷
ছবি: dapd
কো-এডুকেশন পছন্দ নয়
কো-এডুকেশন? না, ইরানে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ ছেলে এবং মেয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করে ইরানে৷ এমন কি এই ইহুদি স্কুলেও ইসলামিক স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ এখানে মেয়েরা যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাইকেই চুল ঢেকে রাখতে হবে, অর্থাৎ হিজাব পরতে হবে৷
ছবি: AP
ধনী-গরিবের পার্থক্য
ব্রাজিলের গ্রামাঞ্চলের ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া করা বেশ কঠিন৷ কারণ সেখানকার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই৷ যেমন মন্টে আলেগ্রের এই স্কুলটির মতো ৷ যদিও ব্রাজিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটি, তারপরও এদেশে গরিব এবং ধনীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা একই রকম
বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল এবং রাজধানী ঢাকা শহরের স্কুলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ বড় শহরগুলোতে ছাত্ররা কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে৷ আর গ্রামের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটার ব্যবহার করার ইচ্ছা – এখনো স্বপ্ন!
ছবি: Getty Images
13 ছবি1 | 13
কিন্তু এখানেই শেষ নয়৷ বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশ দাবি করছে, বর্তমান তৃণমূল সরকারের নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী, বিধায়ক অথবা পুরপ্রতিনিধি, পঞ্চায়েত সদস্যদের ঘনিষ্ঠজনেরা, তাঁদের আত্মীয়রা এই নিয়োগ পদ্ধতিতে ঢালাও হারে সফল হয়েছেন, যা নিয়ে অনেক সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ আছে৷ সরকার পক্ষের নেতা-নেত্রীদের নাম করে করে রীতিমত অভিযোগ করা হচ্ছে, তাঁদের কোন কোন আত্মীয় এই সুযোগে স্কুলে চাকরি পেয়ে গিয়েছেন৷ এই অভিযোগের একাংশও যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তা হলে বলতে হবে, শিক্ষাক্ষেত্রকে রাজনীতিমুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস এই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল, তা অত্যন্ত প্রতীকীভাবে, প্রাথমিক স্তরেই বিনষ্ট হল৷ পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার ঠিক এভাবেই শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পদ তথাকথিত নিজেদের লোক দিয়ে ভর্তি করে শিক্ষাব্যবস্থার রাজনীতিকরণ করেছিল৷
এদিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার কী হাল, সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক৷ শিক্ষিত সংস্কৃতিমনস্ক বলে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গে স্কুলছুটের হার রীতিমত উদ্বেগজনক৷ কোনও রাজনৈতিক অপপ্রচার নয়, ইউনেস্কোর রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সারা ভারতে, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং ওড়িশায় স্কুল-পালানো বা স্কুলে না যাওয়া শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷ তবে বিহারে স্কুলছুটদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে, যেমন কমছে ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড় এবং মনিপুরে৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের লক্ষণ সেই তুলনায় আদৌ সুবিধের নয়, বরং রীতিমত অস্বস্তিতেই আছেন ভারত সরকারের সর্বশিক্ষা মিশনের কর্মীরা৷
এবার দেখা যাক পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকদের পরিসংখ্যানটা কী৷ ২০০৯ সালে ভারতে সমস্ত শিশুর বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে যে আইন পাস হয়েছিল, তা সব অর্থেই ছিল ঐতিহাসিক৷ সেই আইন অনুযায়ী, প্রতি ৩০ জন শিশুর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকা উচিত৷ সেখানে ভারতের জাতীয় গড় হল প্রতি ৩৪ জন শিশুপিছু একজন করে প্রাথমিক শিক্ষক৷ ব্যতিক্রমী রাজ্য হল মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড বা পশ্চিমবঙ্গের মতো জনবহুল রাজ্য, যেখানে ৬০ জন শিশুর জন্য একজন করে শিক্ষক আছেন৷ তার পরেও শিশুদের স্কুলমুখো করতে সফল হয়েছে ঝাড়খণ্ড, কিন্তু পারেনি পশ্চিমবঙ্গ৷
এই পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষা রাজ্য সরকারের অন্যতম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত ছিল৷ সারা রাজ্যে ৪০ হাজার শূন্য শিক্ষকপদে উপযুক্ত নিয়োগ হওয়া উচিত ছিল আবশ্যিক৷ কিন্তু আদালতে পরীক্ষার্থীদের একাংশ যে অভিযোগ এনেছেন, যার ভিত্তিতে সরকারের জবাবদিহি চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট, তাতে প্রমাণ হচ্ছে, যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি হয়নি শিক্ষক নির্বাচনে৷ আর রাজনৈতিক আত্মীয়তার জেরে নিয়োগের অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তা হলে সত্যিই আতঙ্কিত হওয়ার সময় পশ্চিমবঙ্গবাসীদের ভবিষ্যৎ ভেবে!