বনের এরিশ কেস্টনার স্কুলে ক্লাস থ্রির ১২টি দেশের ২৩ জন ছাত্রছাত্রীকে পড়ান গাব্রিয়েলা শেফার৷ এমরের মতো কারুর কারুর রয়েছে কয়েকটি ‘দেশ’৷ সে জানায়, ‘‘আমার বাবা এসেছেন ইরান থেকে৷ বাসায় আমরা ফার্সি ভাষায় কথা বলি৷’’
বিজ্ঞাপন
এমরে বেশ গর্বিত যে সে জার্মান ভাষার পাশাপাশি অনর্গল ফার্সি বলতে পারে৷ হ্যাঁ, জার্মান ভাষা শিখতে তেমন অসুবিধা হয়নি এমরের৷ যদিও প্রথম দিকে তাকেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে৷
এমরে, পাউলিনে, আলি এবং লেওর মতো নানা দেশ ও জাতির ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করে এরিশ কেস্টনার স্কুলে৷ কিন্তু এ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয় না সেখানে৷ স্কুলটি শহরের এমন এক অংশে অবস্থিত, যেখানে সামাজিক ভাতার ওপর নির্ভরশীল মানুষের বসবাস বেশি৷ কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে রয়েছে এক রঙিন মিশ্রণ৷
জার্মান ভাষা জানার বিকল্প নেই
জার্মান ভাষা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ ভারত-বাংলাদেশের মতো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এ ভাষা শেখার জন্য রয়েছে গ্যোটে ইন্সটিটিউট৷ তবে জার্মানিতে থেকে সে’ দেশের ভাষা না জানলে যে পদে পদে সমস্যা!
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
যদি ভাষা জানেন, সুবিধা পাবেন
যে কোনো দেশে থাকতে হলে সে দেশের ভাষা জানা খুবই জরুরি৷ তা না হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার তেমন কোনো সুযোগই থাকেনা৷ ভাষা না শেখার কারণে খালিদ, আইচো, শিরিয়া, আরিয়ানা বা রাইসার মতো অনেকেই নিজের দেশে চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করলেও জার্মানিতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Doc RaBe - Fotolia.com
সেবিকা থেকে ক্লিনার
শিরিয়া কসোভো থেকে বেশ কয়েকবছর আগে স্বামী, সন্তান নিয়ে জার্মানিতে এসেছে৷ নিজের দেশে একটি হাসপাতালে নার্স বা সেবিকা হিসেবে কাজ করতো৷ প্রথমে ভাষা শেখাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে আর শেখাও হয়নি৷ বেঁচে থাকার জন্য এখন তাকে অন্যের বাড়িতে ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে৷ জার্মান ভাষা জানা থাকলে সহজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়তো আবারও সেবিকার কাজ পেতে পারতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খালিদের অনেক দুঃখ
খালিদ পোল্যান্ডের একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতো৷ ভাষা শেখেনি, তাই এখন নিজেকেই এ সব কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে৷ ভাষা না শেখার কারণ জানতে চাইলে কিছুই বলেনা৷ তবে এখন বুঝতে পারছে সে ভাষা না শিখে ভুল করেছে এবং মানসিকভাবে অনেক কষ্টও পাচ্ছে৷ যদিও জার্মানিতে কম আয়ের বিদেশিদের জন্য বিনে পয়সায় ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে৷
ছবি: Kzenon - Fotolia.com
আরিয়ানা
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা আরিয়ানা প্রায় দশ বছর আগে ইউক্রেন থেকে এসেছে৷ নিজের দেশে টুকটাক জার্মান ভাষা শিখেছিলো, তবে জার্মানিতে এসে আর শেখা হয়নি কোলে বাচ্চা থাকায়৷ তবে ওর স্বামীর জার্মান ভাষা মোটামুটি শেখাতে একটি চাকরি এবং জার্মানিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আরিয়ানাকেও কাজ করতে হয়৷ স্বামীর সহায়তায় অগত্যা একটি সরকারি অফিসে মেঝে মোছার কাজই করছে সে এখন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বসনিয়ার মেয়ে মারিয়ম
১৫ বছর বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে জার্মানিতে এসেছে মারিয়ম৷ প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধা হলেও বাবা মায়ের উৎসাহে এবং নিজের মনোবলের কারণে ভালোভাবেই জার্মান ভাষা রপ্ত করতে পেরেছে৷ এখন সে নিজেই চাকরির জন্য অফিসে দরখাস্ত করছে৷ ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
জব সেন্টারে ঘোরাঘুরি
অনেকে প্রতি সপ্তাহেই চাকরির খোঁজে জব সেন্টারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভাষা না জানার কারণে ওদের জন্য তেমন কোনো চাকরির সুখবরও থাকেনা৷ তবে এরা সরকার থেকে বেকার ভাতা বা সামাজিক ভাতা পায় নিয়মিত৷
ছবি: dpa
ভাষা শিখে স্বপ্ন পূরণ
লায়লা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চা ভালোবাসে তার ইচ্ছে বাচ্চাদের সাথে কাজ করবে৷ লায়লার জন্য ভাষা শেখা কোনো সমস্যাই ছিলোনা৷ সাধারণ স্কুলের পাশাপাশি আলাদাভাবে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাস সে করেছে৷ যার ব্যয়ভার জার্মান সরকার বহন করেছে৷ কিন্ডারগার্টেনের ট্রেনিং শেষে পছন্দের চাকরিও সে পেয়ে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বখাটে তরুণ
যারা জার্মান ভাষা শেখেনা, তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ কোনো প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র এলেও সেগুলো তারা পড়তে বা বুঝতে পারেনা৷ ফলে সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়৷ ভাষা না জানা এই প্রজন্মের অনেক ছেলে মেয়েকে পয়সার জন্য অন্যায় পথে পা বাড়াতেও দেখা যায়৷ কেউ কেউ আবার অন্য বাড়ির দরজায় গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে৷
ছবি: fotolia/imageteam
জন্ম থেকে জার্মানিতে, জার্মান ভাষার প্রতি আগ্রহ নেই
জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি রয়েছে৷ যাদের জন্ম জার্মানিতে, জার্মান স্কুলে পড়ে – তারপরও অনেকেই তেমন ভালো জার্মান ভাষা জানেনা৷ কারণ হিসেবে অনেক সময় বলা হয় জার্মান স্কুলের বাইরে অর্থাৎ নিজেদের মধ্য এরা সবসময়ই তুর্কি ভাষায় কথা বলে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
নারীদের ভাষা শেখার আগ্রহ খুব কম
নিজ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকেই জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে পুরুষরা কিছুটা জার্মান ভাষা শিখে বিভিন্ন দোকান, কারখানা, রেস্তোরাঁতে কাজ করছেন৷ এদেশে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক বলে বাচ্চারাও স্কুলে যায়৷ তবে এসব পরিবারের খুব কম নারী জার্মান ভাষা শেখে৷ অনেক বছর থাকার পরও কথা বলতে পারেন না৷ যদিও এদেশে তুর্কি নারী সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তিন বোন
পোল্যান্ড থেকে আসা এক পরিবারের তিনজন৷ ছোটবোন ভালো জার্মান ভাষা শিখেছে বলে মোটামুটি ভালো বেতনে দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করছে৷ দ্বিতীয়জনের জার্মান ভাষার জ্ঞান আরো কম বলে সে একটি ফ্যাক্টরিতে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ করে, যেখানে তাকে বেশি কথা বলতে হয়না৷ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেতন বেশ কম৷ আর সবচেয়ে বড় বোন একদমই ভাষা জানেনা৷ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন বাড়িতে ক্লিনারের কাজও কেউ দিতে চায়না৷
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
11 ছবি1 | 11
বিশেষ করে বিদেশি বাচ্চাদের মধ্যে অনেকেই ডাক্তার, প্রফেসর বা পদস্থ ব্যক্তির সন্তান৷ স্কুলে গেলে লক্ষ্য করা যায়, একই দেশ থেকে এলেও বাচ্চারা পরস্পরের সঙ্গে তাদের মাতৃভাষায় কথাবার্তা বলছে না৷ অবশ্য টিফিনের সময় অনেক সময় ভিনদেশি ভাষায় কথাবার্তা বলে ছেলে-মেয়েরা৷ বিশেষ করে ‘গোপন' কোনো বিষয় থাকলে৷
আলাদা কোচিং-এর ব্যবস্থা
ভাষার কারণে যে সব বিদেশি বংশোদ্ভূত বাচ্চা ক্লাসের পড়া ঠিকমতো বুঝতে পারে না, তাদের জার্মান ভাষা শেখার জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে এরিশ কেস্টনার স্কুলে৷ যেখানে এই ধরনের প্রতিটি বাচ্চার জন্য আলাদা আলাদা কোচিং দেওয়া হয়৷ অভিবাসী শিশুদের জন্য দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে জার্মান পড়ানোর ব্যবস্থা প্রায় সব স্কুলেই রয়েছে৷ কিন্তু এরিশ কেস্টনার স্কুলের, বিশেষ করে জার্মান অভিভাবকরা মনে করেন, এই ব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল না৷
আর তাই তো, ছেলে-মেয়েরা যেন শিক্ষায় সবচেয়ে ভালো সহায়তা পায়, সেজন্য অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারা৷ এই লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয় একটি সমিতি৷ যেটি স্কুল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় অর্থায়নের দিকটি দেখাশোনা করছে৷ অনেক বাবা-মা সমিতিতে মোটা অঙ্কের অর্থ দান করে থাকেন৷
এই সব অভিভাবক বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার ব্যাপারে চিন্তিত, নাকি সহপাঠীদের ভাষা সমস্যার কারণে সন্তানদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে শংকিত, তা নিয়ে মাথা ঘামান না শিক্ষিকা গাব্রিয়েলা শেফার৷ অল্প অর্থের বিনিময়ে ভাষার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের যে সাহায্য করা যাচ্ছে, এটাই তাঁর কাছে বড় কথা৷
জাতীয়তা নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না
গাব্রিয়েলা শেফারের ক্লাস থ্রি-তে বাচ্চাদের জাতীয়তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না৷ যেমন শাংহাই থেকে আসা ভিক্টরকেও আলাদা করে চোখে পড়ে না৷ মাত্র দু'বছর আগে জার্মানিতে এসেছে সে৷ জার্মান ভাষা একটুও জানতো না৷ কিন্তু এখন বেশ ভালোই পারে৷ তাই এমরে ও অন্য আরো কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে সাধারণ ক্লাসের পর বইয়ে ভর্তি পাশের ছোট ক্লাসরুমটিতে নিয়মিত যেতে হয় তাকে৷ ভাষা শিক্ষক মার্কুস ভল্ফ এই সব বাচ্চাদের নিয়ে জার্মান ভাষা চর্চা করেন৷ ‘‘আমরা শিক্ষকদের সঙ্গে মিলে প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাঠ্যক্রম তৈরি করেছি৷ কেননা একেক জনের চাহিদা একেক রকমের৷'' জানান এই শিক্ষাবিদ৷
ভিক্টর, লেও, আলির মতো অনেক বাচ্চাই জার্মানের পাশাপাশি দ্বিতীয় আরেকটা ভাষা জানে বলে বেশ গর্বিত৷ তাদের এই দক্ষতা মাঝে মাঝে ক্লাসে কাজেও লেগে যায়৷ ‘‘কোনো শব্দের ইংরেজি না জানা থাকলে লেওর কাছে সাহায্য পাওয়া যায়৷'' জানায় রাবেয়া৷ আর জার্মানির এলা বলে, ‘‘তারা নিজেদের ভাষায় কী যেন বলে, চীনা ভাষায় হাতের তালুতে লেখে৷ সত্যি কী সুন্দর্য''!
ঠিক পথেই এগুচ্ছে স্কুলটি
জার্মান ছাত্রছাত্রীদের হাবভাব দেখেই বোঝা যায় যে, এরিক ক্যাস্টনার স্কুল সঠিক পথেই এগুচ্ছে৷ জানান ক্লাস টিচার গাব্রিয়েলা শেফার৷ তাঁর কথায়, বাচ্চারা ‘‘অন্যান্য দেশের ছেলে-মেয়েদের স্বাভাবিক বলেই মনে করে৷ তাদেরকে সাহায্য করতে পেরে খুশিও হয়৷'' ভিক্টর, এমরে ও লেও তাদের পূর্ব পুরুষের দেশ ও পরিবার সম্পর্কে গল্পগুজব করতে থাকলে এলা জড়সড় হয়ে পাশে বসে থাকে৷ মনে হয় যেন একটু ঈর্ষাও অনুভব করে৷ আর তাই তো নিজেকেও ‘কিছুটা অভিবাসী' বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে মেয়েটি৷ বলে, ‘‘আমি এলা৷ আমি দক্ষিণ জার্মানি থেকে এসেছি৷''