1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হারানোর ব্যথা আর অভাবে চলে কষ্টের জীবন

সুলাইমান নিলয়
২৫ জুলাই ২০১৭

‘গুম হওয়া’ মানুষদের পরিবারের সদস্যদের জীবন কেমন করে কাটে-কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে প্রিয়জন হারানোর কষ্টের পাশাপাশি রয়েছে অভাব-অনটনও৷ বিচার না পাওয়ার কষ্ট তো রয়েছেই৷

প্রতীকী ছবিছবি: Shahidul Alam/Drik/Majority World

শামছুন নাহার নূপুর ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেনকে৷ স্বামী ছিলেন পেশায় প্রাইভেটকার চালক৷ বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুনে ঘটনায় তিনি প্রথমে অপহৃত হন৷ পরে তাঁর লাশ উদ্ধার করা৷

নূপুর জানান, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল তাঁর স্বামী অপহৃত হওয়ার দিন তিনি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন৷ তখন তাদের বিয়ের আট মাস চলছিল৷ দু'মাস পর তাঁর এক কন্যা সন্তান হয়৷ ভালোবাসার মানুষ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা ছিল সন্তানকে ডাক্তারি পড়াবেন৷ স্বামীর মৃত্যুর মাধ্যমে সবকিছু তছনছ হয়ে যায়৷ প্রসবের কিছুদিন পর গৃহিনী নূপুরকে জীবিকার জন্য রাস্তায় নামতে হয়৷ এক সময় একটি অস্থায়ী চাকুরি পান নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে৷ বর্তমানে সেখান থেকে মাসে ৬ হাজার টাকা রোজগার তাঁর৷ এই উপার্জনেই জেলা শহরটিতে সন্তানকে নিয়ে বাঁচার লড়াই করে যাচ্ছেন৷ নিম্ন আদালতের রায় কার্যকর দেখতে চান তিনি৷ তিনি বলেন, স্বামী দেখে যেতে পারেনি, আমাদের একটা ফুটফুটে কন্যা হয়েছে৷ আমিও এই বয়সে বিধবা হয়ে গেলাম৷ আনার পর স্বামীর মুখটাও দেখতে পারিনি৷ যারা জড়িত ছিল তাদের ফাঁসি হোক৷ 

Nupur Final - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তাঁর কথায়, ‘‘যে রায় হয়েছে, সেটা কার্যকর হোক৷ অন্যদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে, আমার স্বামী তো পেটের দায়ে কাজ করতে গেছে৷ সে তো চুরি-ছেছরামি করতে যায়নি৷ তাকে কেন মারলো, আমি কেন বিধবা হলাম, আমার সন্তান কেন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হলো?''

তবে পঞ্চগড়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ রুহুল আমিনের কষ্ট অন্য জায়গায়৷ ২০১২ সালের মার্চে তাঁর বড় ছেলে ইমাম হাসান অপহৃত হন৷ প্রথম দিকে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার নিভু নিভু আশা থাকলেও এরপর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ নেই৷ ইমাম হাসান কাজ করতেন সাটার এবং গ্রিলের কারখানায়৷ পেশায় হকার বাবার দাবি, তাঁর সন্তানে নিজ কাজে ছিলেন দক্ষ এবং মনোযোগী৷ মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা রোজগার করতো৷ পিতা মাতার প্রতিও তাঁর খুব ভালো খেয়াল ছিল৷ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসাধীনে থাকা ছোট ভাইয়ের প্রতিও নিতেন যত্ন৷ বাবা তাই অনেকটা অবসর জীবনেই চলে গেছেন৷ সন্তান হারানোর পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তরে-আদালতে ঘুরছেন তিনি৷ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জীবিকার তাড়নাও৷ ফিরে আসেন পুরনো পেশা হকারিতে৷

তাঁর ছেলে অপহৃত হওয়ার গল্পটা একটু ভিন্ন৷ তাঁর ছেলেকে তৃতীয় পক্ষ অপহরণ করে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করার পর তারা ছেলেকে উদ্ধারও করে৷ এক পর্যায়ে ব়্যাবের এক কর্মকর্তা ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে ১ লাখ টাকা ঘুস চান৷ তিনি ৪০ হাজার টাকা দেন৷ 

Ruhul Amin - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তিনি জানতে পেরেছেন, পুরো টাকা না দেয়ায় ব়্যাব দপ্তর থেকে তাঁর ছেলেকে গুম করে দেয়া হয়৷ তিনি বলেন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছে গিয়েছি, হাই কোর্ট রুল দিয়েছে৷ কিছুতেই কিছু হয়নি৷

তিনি জানান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক কর্মকর্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁকে আপোশের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমার ছেলেকে জীবন্ত ফেরত দেন৷ তাহলে আপোশ হবে৷ ছেলে বেঁচে না থাকলে আপোশ নাই৷ এত বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে আমার ছেলে খুনেরও বিচার হবে৷'' 

তিনি আরো জানান, তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে৷ এ কারণে তিনি এক জায়গায় থাকতে পারেন না৷ জায়গা বদল করে করে তিনি থাকেন৷ বলেন, ‘‘নারায়ণগঞ্জে যারা অপহৃত হয়ে খুন হন, তারাও কিছুটা প্রভাবশালী ছিল৷ তাই ঐ ঘটনার বিচার হয়েছে৷ আমি হকার বলে, অর্থবল লোকবল নেই বলে আমি বিচার পাচ্ছি না৷''

গ্রামের মেয়ে রওশন আরা জীবনটা একটু অন্যরকম৷ তাঁর স্বামী আবদুর রহমানের বাড়ি কিশোরগঞ্জ৷ তিনি পেশায় ঠিকাদার৷ নির্মাণ শ্রমিক লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন তিনি৷ ২০১০ সালের ১৭ মে তিনি আইয়ুব আলীর সাথে নিখোঁজ হন৷ এরপর দুই বছর ঢাকায় থেকে স্বামীর খোঁজ করেন রওশন আরা৷ এক সময় আর্থিক টানাটানিতে তাঁকে স্বামীর গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়৷ এক সময়কার গৃহিনী রওশন আরা সন্তানদের নিয়ে কিছুদিন পূর্বে ফিরেছেন ঢাকায়৷ এবার কাজের খোঁজে৷

যে সন্তানদেরকে পড়াশোনা করিয়ে উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদেরকে কাজে দিয়ে দেন৷ বড় সন্তান অষ্টম শ্রেণি, মেঝ সন্তান সপ্তম শ্রেণি এবং সেজ সন্তান চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে৷ এখন সবাই কাজ করছে৷ গৃহের আঙিনা পেরিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন রওশন আরা নিজেও৷

এতদিন পরে ফোন করায় এই প্রতিবেদকের কাছেই বারবার স্বামীর সন্ধান পাওয়া গেছে কিনা জানতে চান তিনি৷ সবশেষ দীর্ঘশ্বাস, ‘‘আর কী করবো, বেঁচে থাকলে হয়ত আসবেন একদিন৷''

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন৷ দুই কন্যাকে নিয়ে স্বামীর পথ চেয়ে চেয়ে বসে আসেন স্ত্রী নাসিমা আক্তার৷ এত দিনেও কোনো খোঁজ নেই, এরপরও তাঁর বিশ্বাস স্বামী জীবিতই রয়েছেন৷ নাসিমা জানান, ‘‘ব়্যাব তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে৷ কিন্তু পরে যোগাযোগ করলে তারা অস্বীকার করে৷ তারা বলে, আমরা আনিনি৷ উনি বিএনপি করতেন৷ এটাই উনার সমস্যা৷''

‘গুম' হওয়ার চার-পাঁচ মাস পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সত্যি কথা বলতে, প্রথম চার-পাঁচ মাস আমার শাশুড়ি কিছুই করেননি৷ আমার ছেলেকে যদি কিছু করে ফেলে৷ এই ভয়ে কোনো মিডিয়া বাসায় আসতে দেয় নাই৷ কোনো লোককে আসতে দেয় নাই৷ পাঁচ মাস পর আস্তে আস্তে শুরু করি৷ আমার ননদ তুলি, মানববন্ধন করলো, হাইকোর্টে গেল...৷'' 

Nasima Akhtar - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

এই দম্পতি দুই কন্যা রয়েছে, বড়টি এখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে৷ ছোট মেয়ে কেজিতে পড়ে৷ তাঁর কথায়, ‘‘খুব করুণ অবস্থায় আমাদের সময় কাটতেছে৷ এখনকার সময় বলে বোঝানো যাবে না৷ ছোট বাচ্চাটা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বাবাকে ‘ফিল' করে৷ প্রতিদিনই বাবার কথা বলে৷ দেওয়ালে বাবার ছবি দেখে বলে, বিছানায় দেখায় এখানে বাবা থাকবে, মাঝে সে থাকবে, এরপর মা থাকবে৷ বাবা ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবে৷ ওর জন্য অনেক কিছু কিনে আনবে৷''

বলেন, ‘‘আমি নিজেও শারীরিক দিক দিয়ে বিভিন্নভাবে অসুস্থ্য হয়ে গেছি৷ মেয়ে দু'টোর কী হবে জানি না৷ যদিও আমরা অনেক চেষ্টা করেও সন্ধান পাচ্ছি না৷ আমার কাছে মনে হয়, আছে, হঠাৎ করে হয়ত একদিন বাসায় এসে হাজির হবেন৷ আসলে ও আর নেই, এটা মনে হয় না৷ আশা করি, সরকার একটা গতি করবে৷ আমার স্বামীর মত অনেক মানুষ গুম হয়ে আছে৷ তাদেরকে হয়ত কোথাও নিয়ে রেখেছে...৷''

এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ‘‘জীবিত থাকার বিষয়টা কেবল আশা৷ মৃত এই কথাটা মনে আনতে পারছি না৷'' 

বেঁচে থাকতে রাজনীতির পাশাপাশি পরোপকার করে বেড়াতেন বলেও জানান তাঁর স্ত্রী৷ যে যখন ডাকতো লাফ দিয়ে চলে যেত৷ আত্মীয় স্বজনের কথা বাদ দেন, এলাকায় এমন কোনো মানুষ নাই, যারা ওর জন্য কাঁদে না৷

Roushan Ara - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

শেষ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ডিসেম্বরের চার তারিখে ধরা পড়লেন৷ ধরা পড়ার দু'দিন আগে বাসায় এসে সবাইকে স্বান্তনা দিয়ে যায়৷ সাবধানে থাকতে বলে৷ এমন নানা স্মৃতি ভিড় করছে৷ সুমন সত্যিই রাজনীতি করতে গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারতো না৷ পরিবারের সদস্যদের এই অনুযোগ ছিল সব সময়ই৷ জানুয়ারির নির্বাচনে ভালো কিছু না হলে একটা ‘সাইড' হয়ে যাবেন বলে তিনি স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন৷ নাসিমার কথায়, ‘‘তিনি আমার কাছে চার-পাঁচ মাস সময় চেয়েছিলেন৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

সুলাইমান নিলয় বর্তমানে উন্নয়ন পেশাজীবী হিসেবে কাজ করছেন৷ তার আগে দীর্ঘদিন আইন সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ