বড় বিপদে আছে ফেসবুক৷ আজকাল তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, মামলায় হেরে জরিমানাও গুনতে হয় তাকে৷ কোথাও আবার ফেসবুকের সঙ্গে সামান্য বিচ্ছেদেই শুরু হয় গণকান্নাকাটি৷ সব দেখি আর ভাবি, ‘‘ফেসবুক প্রিয় বেশি, নাকি অপ্রিয়?’’
বিজ্ঞাপন
কণ্ঠ, সুর থাকলে আর বাংলা জানলে ফেসবুক নিশ্চয়ই মুখ বেজার করে গাইতো, ‘‘কারে বা জানাই বলো বেদনা আমার/ বুঝিলো না কেহ আমারে৷'' অথবা একদিকে তীব্র ঘৃণা, আরেকদিকে তীব্র প্রেমে ব্যতিব্যস্ত হয়ে হয়ত গাইতো, ‘‘কারে বা শোনাই বলো, কেইবা শোনে মোরে হায়, আমার মনের কথা কেউ জানে না৷''
বাংলাদেশে ফেসবুক: ব্যবহারের ভাল-মন্দ
সব বয়সী মানুষের কাছেই জনপ্রিয় এক সামাজিক মাধ্যম এখন ফেসবুক৷ যা ব্যবহার ছাড়া অনেকে একটি মুহূর্ত ভাবতে পারেন না৷ মাধ্যমটি অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে মানুষের জীবন যাত্রার সাথে৷ যা ভালোর পাশাপাশি অনেক মন্দ প্রবণতারও জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: Reuters/D. Ruvic
‘দ্য ফেসবুক’ থেকে শুধু ‘ফেসবুক’
২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দ্য ফেসবুক নামের একটি ওয়েবসাইট খোলেন যুক্তরাষ্ট্রের হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মার্ক জাকারবার্গ ও তার বন্ধুরা৷ শুরুতে এটি ছিল শুধু হাভার্ডের ব্যবহারকারীদের জন্য৷ ২০০৫ সালে নামের শুরুতে থাকা ‘দ্য’ ফেলে দেয় ফেসবুক৷ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৬ থেকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় ১৩ বছরে উপরের সব বয়সীদের জন্য৷
ছবি: REUTERS
১০০০ ডলার থেকে বিলিয়ন ডলার
২০০৪ সালে যাত্রা শুরুর সময় দ্য ফেসবুকে জাকারবার্গদের বিনিয়োগ ছিল মাত্র এক হাজার ডলার৷ বর্তমানে সেই কোম্পানির বার্ষিক আয় দাড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৫৮৩ কোটি ডলারে৷ ২০১৮ সালে তাদের নিট মুনাফা হয়েছে দুই হাজার ২১১ কোটি ডলার৷ ফোর্বসের তালিকায় সবচেয়ে দামী ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ফেসবুক আছে শীর্ষ পাঁচে৷
ছবি: AP
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা
বর্তমানে বিশ্বে ফেসবুক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২২৫ কোটির বেশি৷ সাম্প্রতিক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট নিয়ে বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে৷ চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ২২০ কোটি অ্যাকাউন্ট এ কারণে বন্ধ করে দিয়েছে ফেসবুক৷
ছবি: Reuters/D. Ruvic
বাংলাদেশে তিন কোটি
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ফেসবুক ব্যবহারকারী কত তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী দেশে তিন কোটি মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি ব্যবহার করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. A. Thu
যোগাযোগের নতুন মাধ্যম
ফেসবুক এখন সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে বড় এক মাধ্যম৷ যেখানে খুজে পাওয়া যায় পরিচিত মানুষ৷ রাখা যায় তাদের খোঁজ, খবর৷ যোগাযোগের এই গণ্ডি পেরিয়ে যেতে পারে এমনকি দেশের সীমানা৷ আর এভাবে গড়ে উঠছে নতুন নতুন বন্ধুত্ব৷ বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে চেনা অচেনা মানুষ সাহায্যও করছে একে অপরকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Alfiky
তাৎক্ষণিক যোগাযোগ, ফোন কল
ফেসবুক অনেকের কাছে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের এক মাধ্যমও৷ মোবাইল নেটওয়ার্কে বার্তা পাঠানোর বদলে ফেসবুকের মাধ্যমেই যোগাযোগ চলে৷ ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে এমনকি ফোনে কথা বলার কাজও সারে৷
ছবি: Imago/ZUMA Press
অনলাইন মার্কেটিং, এফ কমার্স
ফেসবুকের মাধ্যমে এখন অনেকে আয় রোজগার করছেন৷ বিভিন্ন ব্যবসায়িক পেইজ খুলে তারা নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, সরাসরি যোগাযোগ করছেন ক্রেতাদের সাথে৷ এই ধরণের ব্যবসা পরিচিত এফ কমার্স নামে৷ ই কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের হিসাবে, দেশে এখন এমন প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেইজ আছে৷ যার মধ্যে ১২ হাজার চালাচ্ছেন নারীরা৷
ছবি: Colourbox/T. Vitsenko
শিক্ষামূলক পেইজ
ফেসবুকে আছে বিভিন্ন শিক্ষামূলক সাইট ও গ্রুপ৷ তেমনই একটি সার্চ ইংলিশ৷ বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই ফেসবুক গ্রুপটিকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছে ফেসবুক বিজনেস৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Kiran
তথ্যের উৎস
ফেসবুক এখন অনেকের কাছে হয়ে উঠেছে তথ্য ও সংবাদের উৎস৷ ব্যবহারকারীরা নিজেরাই প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে অনেক সময় বিভিন্ন খবর বা তথ্য জানাচ্ছেন৷ আবার বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলোর পেইজ থেকেও সবশেষ খবর পাওয়া যায় ফেসবুকে৷
ছবি: picture-alliance/maxppp/P. Proust
রক্তদান
কারো জরুরি রক্তের প্রয়োজনে ফেসবুকের সহযোগিতা নিতে পারেন৷ বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে ২০১৮ সালে ‘ব্লাড ডোনেশনস হাব' তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি৷ এতে আগ্রহী রক্তদাতারা সাইন আপ করতে পারেন৷ আর যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁর আশপাশে রক্তদাতা কে আছেন সেই তথ্য জানাতে পারেন৷
ছবি: Fotolia
প্রতিবাদের মাধ্যম
ফেসবুক অনেকের কাছে মত প্রকাশ আর প্রতিবাদের মাধ্যমও৷ দেশের বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ এতে অনেক সময় তৎপর হয় সরকার বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামলকান্তির অবমাননা,
সিলেটে শিশু রাজন হত্যাসহ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে ওঠায়ও ভূমিকা ছিল ফেসবুকের৷
ছবি: Facebook/Mushfiqur Rahim
ব্যক্তিগত সম্প্রচার মাধ্যম
অনেকের কাছে ফেসবুক হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত সম্প্রচার মাধ্যম৷ নিজেদের সৃজনশীল কাজ, লেখালেখি, বক্তৃতা করে কেউ কেউ এমনকি সেলিব্রেটিও বনে গেছে৷ ফেসবুকে তাঁদের লাখো ফলোয়ার বা অনুসারীও আছে৷
ছবি: Facebook/A. Sadiq
নারী অবমাননা
ফেসবুকে অনেক সময় প্রতারণা আর নিপীড়নের শিকার হন নারীরা৷ আইডি হ্যাক করে, অপ্রিতীকর ছবি ছড়িয়ে দিয়ে এমনকি পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে নারীদের ব্ল্যাকমেইল করে অনেক অপরাধী৷
ছবি: DW
অপরাধ প্রবণতা
ফেসবুক অপরাধ প্রবণতা তৈরি করছে অনেক কিশোর ও তরুণদের মধ্যে৷ ঢাকার উত্তরা এলাকায় এক কিশোর হত্যার ঘটনায় তরুণদের ফেসবুক ব্যবহারের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে৷ তারা ফেসবুক পেজ খুলে গড়ে তোলো নানা সন্ত্রাসী গ্রুপ৷আবার ধানমন্ডিতে এক কিশোরকে আরেক কিশোর গ্রুপ মারধর করে তার ভিডিও আপলোড করে দেয় ফেসবুকে৷ তরুণদের একাংশ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, ব্ল্যাকমেল করতে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমটি ব্যবহার করছে৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Bangla Tribune/Humayun Masud
ভুয়া খবর ও গুজব
চলতি বছরের জুন-জুলাই মাসের দিকে ‘পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে ফেসবুকের মাধ্যমে সারাদেশে গুজব ছড়ানো হয়৷ এরপর ছেলেধরা সন্দেহে কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ গত বছর কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও শিক্ষার্থী ধর্ষণের গুজবে সংঘর্ষ বাড়ে৷ ফেসবুকে হরহামেশাই এমন গুজব আর ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Singh
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা
কারো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সেখান থেকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট৷ যাকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা৷ কক্সবাজারের রামুতে হামলা থেকে শুরু করে গত কয়েক বছরে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে৷ যার সবশেষটি হয়েছে ভোলাতে৷
ছবি: AFP/Getty Images
রাষ্ট্রীয় দমন, সন্ত্রাসীদের নিপীড়ন
ফেসবুকে মত প্রকাশ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বা সন্ত্রাসীদের নিপীড়নের মধ্যেও পড়তে হয়েছে অনেককে৷ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে এজন্য অনেককে জেলেও যেতে হয়েছে৷ আবার ফেসবুক স্ট্যাটাসের ভিন্ন মত সহ্য করতে না পেরে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে বুয়েটে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
17 ছবি1 | 17
ফেসবুকের মনের আসল কথাটা হলো, ‘‘নাও, এখানে যে যেভাবে চাও সময় কাটাও৷ যত খুশি সময় কাটাও৷ কারো পকেট কাটবো না, কিন্তু আমার পকেট ঠিকই ভারি হবে৷''
আর ওখানেই যত সমস্যা৷ ফেসবুকের ‘প্রেমিক/ প্রেমিকা' লাভ, লোভের শেষ নেই৷ বাজারটা খুবই বড়৷ ইধারকা মাল উধার করার সুযোগও অবারিত, অসীম৷তাই না জানিয়ে তথ্য পাচার চলছে অবিরাম৷ইদানিং ধরা পড়ে জরিমানাও গুনছে ফেসবুক৷
মাস তিনেক আগেই গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন, এফটিসি৷ গুনে গুনে ৫০০ কোটি ডলার দিয়ে অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে ফেসবুক৷
এন্তার অভিযোগ ফেসবুকের বিরুদ্ধে৷ ফেসবুক-আসক্তি আপনকে পর করছে৷ তাই বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে৷ কিশোররা বখে যাচ্ছে৷ মতলববাজরা নানা মতলবে ব্যবহার করছে ফেসবুক৷ কেউ হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, কেউ ছদ্মবেশে প্রতারণা করছে, কেউ বা গুজব রটিয়ে হামলা চালাচ্ছে দুর্বলের ওপর৷ এসব কারণে কেউ কেউ বিদায়ও নিচ্ছে ফেসবুক থেকে৷
তাতে বয়েই গেল! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনো ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয়৷ সারা বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা কত, জানেন? ২৩৫ কোটিরও বেশি!
সংখ্যাটা আরো বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে৷ কারণ, ফেসবুক যে খুব বড় প্রেম!
এমন প্রেমের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে শরৎবাবু বহু আগেই লিখে গেছেন, ‘‘বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়৷'' সুতরাং কিছু মানুষ তো ফেসবুক ছেড়ে যেতেই পারে!
আমার কাছে অবশ্য ফেসবুক বড় প্রেম নয়, বড় প্রয়োজন৷ বড় প্রেম হলে হয়ত চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষতে হতো, হিসেবের গরমিলে মন ভাঙতো আর তখন হয়ত ছেড়েও যেতে হতো৷ আমার চাহিদা খুব কম৷ বন্ধু তালিকা দীর্ঘ করা বা অনুসারী বাড়ানোর কোনো ইচ্ছা বা তাগিদ আমার নেই৷ অল্প কিছু বন্ধু নিয়ে ছোট একটা পৃথিবীতে তাই দিব্যি আছি৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷