ভারতে নদনদীকে যেখানে দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হয়, জীবনরেখা বলা হয়, সেখানে সবথেকে নদী দূষণ হয় এ দেশেই৷ আর রাজধানী দিল্লি ও তার আশেপাশের রাজ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদী বিশ্বের অন্যতম দূষিত নদী৷ প্রশ্ন হলো, এ জন্য দায়ী কে?
বিজ্ঞাপন
গঙ্গার দীর্ঘতম শাখানদী যমুনা পৌরানিক ও ঐতিহাসিক – দু'দিক থেকেই প্রেমের নদী৷ তা সে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের জলকেলি হোক বা মোগল বাদশাদের নৌকা বিহার, অথবা সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের স্মারক তাজমহল – হিমালয়ের যমুনোত্রী হিমবাহ থেকে নেমে উত্তরভারতের উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের মধ্য দিয়ে গিয়ে মিশেছে বারাণসীতে গঙ্গার সঙ্গে৷ এহেন এক নদী আজ হেজে মজে মরতে বসেছে দূষণের কারণে৷ যেটুকু জল আছে তা এত বিষাক্ত যে পান করা তো দূরের কথা, স্নান করা এবং কাপড় কাচাও বিপজ্জনক৷ তাছাড়া যমুনার জল বিভিন্ন রোগের উত্স হয়ে উঠেছে, উঠছে ক্রমশই৷ এক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় বলা হয় যে, এই দূষিত জল ব্যবহার করলে কলেরা, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, আমাশা, চর্মরোগ, এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে৷ যমুনার প্রবাহ পথের উভয় তীরের জনজীবনের শিয়রে এখন শমন৷
কেন এমন দশা হলো? এর কারণ কী? কারণ নির্বিচারে বর্জ্য পদার্থ নদীতে ফেলা, যার মধ্যে আছে যমুনার দু'পাশের কলকারখানা থেকে নিসৃত অশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ, আছে ক্রোমিয়াম,আর্সেনিক ও কোডমিয়াম, আছে শহরের নালি নর্দমার নোংরা জল, প্লাস্টিক, চাষাবাদের কীটনাশক পদার্থ৷ এর সঙ্গে আছে মানুষ, গবাদি পশুর মলমূত্র৷ এমনকি হাতি, উটও বাদ নেই৷ রয়েছে ফুল বেলপাতা থেকে যাবতীয় সব পুজো সামগ্রী৷ দূষণের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় যমুনার জলে অক্সিজেন না থাকার মতো৷ তাই মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীও লুপ্তপ্রায়৷ দিল্লির রাজধানি এলাকায় যমুনার প্রবাহপথের ২২ কিলোমিটারের মধ্যে দিল্লি মহানগরীর ৬০ শতাংশ আবর্জনা পড়ে যমুনার জলে৷ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দিল্লির নির্মিয়মান মেট্রো রেলের ৫১ হাজার টন রাবিশ ফেলা হয়েছে এই জলে৷
বুড়িগঙ্গায় দূষণ: শত্রু কারা কারা?
২২শে মার্চ ছিল বিশ্ব পানি দিবস৷ সবার কাছে সুপেয় পানি পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই দিনটি উদযাপিত হয়৷ অথচ বিশ্বে জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি কমছে পানির সরবরাহ৷ তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবেশ দূষণ৷ ঠিক যেমনটা ঘটছে বুড়িগঙ্গা নদীতে...
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদী
একসময় মহানগরীর প্রাণ হিসেবে গণ্য হতো বুড়িগঙ্গা নদী৷ কিন্তু এই শহরের শিল্প আর মানব বর্জ্য সরাসরি এ নদীতে নির্গমনের ফলে নদীটি পানি ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে৷ এই ছবিটি শহরের বাবুবাজার সেতু থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
নোংরা গন্ধযুক্ত পানি
ব্যবহারের অনুপোযোগী হলেও মানুষের হাত-পা বাঁধা৷ তাই বুড়িগঙ্গা নদীর নোংরা, গন্ধযুক্ত পানির ওপর দিয়েই খেয়াপার হচ্ছেন কর্মজীবী মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
গরিব মানুষের বাস
ঢাকার এই এলাকায় বাড়ি ভাড়া কম হওয়ায় নদীর ওপারের কেরানীগঞ্জ এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি৷ ছবিটি সদরঘাট এলাকা থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ
বুড়িগঙ্গা আজ যেন সত্যিই বুড়ি হয়ে গেছে৷ নদীতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে বুড়িগঙ্গার পানির রং এখন কুচকুচে কালো, আর দুর্গন্ধযুক্ত৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূষণের কারণে বেড়েছে ঘনত্ব
বুড়িগঙ্গার দূষিত পানির উপর দিয়ে জাহাজ চলার পরের দৃশ্য এটি৷ কি ভয়াবহ! আসলে দূষণের কারণে পানির ঘনত্ব বেড়ে গেছে বুড়িগঙ্গার৷
ছবি: DW/M. Mamun
নদীতে লঞ্চ চলাচল
দূষণের এই ভয়াবহ মাত্রার পরও বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে চলছে লঞ্চ৷ জিনিস-পত্র পারাপার তো বটেই, নদী পথে যে এখনও পার হচ্ছে মানুষ৷ ছবিটি কামরাঙ্গীরচর থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
রাসায়নিকের বস্তা পরিষ্কার
বুড়িগঙ্গার পানিতে রাসায়নিকের বস্তা পরিষ্কার করছেন শ্রমিকরা৷ তাঁদের কি আর কোনো উপায় নেই? তাঁরা কি আদৌ জানেন এর পরিবেশগত প্রভাব? সরকারই বা নিরব কেন?
ছবি: DW/M. Mamun
ধোপাদেরও প্রয়োজন নদী
বুড়িগঙ্গার দূষিত জলেই কাপড় ধোয়ায় ব্যস্ত ধোপারা৷ এ সব কাপড়ের বেশিরভাগই ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত বিছানার চাদর, ডাক্তারদের অ্যাপ্রন, অপারেশন থিয়েটার বা ওটি-তে পড়ার ড্রেস ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ধোয়া কাপড়
বুড়িগঙ্গা নদীর দূষিত জলে ধোয়া কাপড় এবার মেলে দেওয়া হয়েছে৷ নদীর পাড়েই শুকানো হচ্ছে এগুলি৷ ছবিটি কামরাঙ্গীরচর থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্জ্য মিশছে সরাসরি
ঢাকা শহরের সুয়ারেজের লাইন থেকে সরাসরি বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গা নদীর জলে৷ এমন দশা চলতে থাকলে অচিরেই যে অন্ধকার নেমে আসবে – তা বলাই বাহুল্য৷ শহরের বাবুবাজার সেতুর নীচ থেকে তোলা এ ছবিটি৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূষণের অন্যতম কারণ ট্যানারি
বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের অন্যতম কারণ ট্যানারি শিল্পর বর্জ্য৷ ঢাকার হাজারীবাগে বেশ কিছু ট্যানারি শিল্প থাকলেও কারুরই নেই বর্জ্য শোধনাগার৷ তাই এ সব ট্যানারির রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য সরাসরি গিয়ে মিলে বুড়িগঙ্গায়৷ গত এক যুগ ধরে ঢাকার বাইরে ট্যানারি শিল্পের জন্য আলাদা জায়গা দেওয়া হলেও, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ট্যানারি মালিরা কারখানাগুলো স্থানান্তর করছেন না৷
ছবি: DW/M. Mamun
শুধু দূষণই নয়...
শুধু দূষণেই থেমে নেই বুড়িগঙ্গা৷ আছে দখলও৷ দূষণ আর দখলে থেমে যেতে বসেছে বুড়িগঙ্গার গতিপথ৷ কামরাঙ্গীরচরে বুড়িগঙ্গা যেন এখন মরা খাল!
ছবি: DW/M. Mamun
আর এক শত্রু প্লাস্টিক
শিল্প আর মানব বর্জ্য ছাড়াও বুড়িগঙ্গা দূষণের আরেক অংশীদার প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য৷ প্রতিদিন প্রচুর প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য মিশছে বুড়িঙ্গার জলে৷ এ ছবিটি বাদামতলী থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
13 ছবি1 | 13
বুজে আসছে যমুনার দুই পাড়৷ তাই যমুনা এখন একটা বড় খাল, আবার কোথাও কোথাও একটা বড় নালার মত হয়ে গেছে৷ জলের বহমানতা না থাকায় যমুনা এখন একটা অগভীর বদ্ধ জলাশয়৷ সেই সুযোগে যমুনা নদীর একপাড়ে দ্রুত গজিয়ে উঠছে বস্তি, অন্য পাড়ে তৈরি হয়েছে কৃষি ক্ষেত৷ আগ্রায় যমুনার তীরে যে তাজমহল, সেই যমুনাও আজ মজে গিয়ে তাজমহলের সৌন্দর্যকে করেছে ম্লান৷
সরকার ও জনসমাজের কারোরই যেন কোনো হেলদোল নেই৷ অথচ ঢাকঢোল পিটিযে ৯০-এর দশক থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে যমুনা অ্যাকশন প্লান৷ বরাদ্দ ২০০০ কোটি টাকা৷ খরচ দেখানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কাজ কি হয়েছে? হলে কতটুকু হয়েছে? হিসেবটা অতি নগণ্য৷ যে কয়েকটা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট বা জল পরিশোধন প্লান্ট বসানো হয়েছে তার বেশির ভাগই নিষ্ক্রিয়৷ যমুনা পাড়ে গজিয়ে ওঠা বস্তি তুলে দেবার কথা, কিন্তু ভোট ব্যাংকের তাগিদে সেখানেও বাধা৷ নদীবক্ষের পলি তোলা যমুনা অ্যাকশন প্লানের আবশ্যকীয় শর্ত, তা ফাইলবন্দি থেকে গেছে আজ অবধি অবোধ্য কারণে৷ একমাত্র আশার দীপ জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনাল৷ এর প্রধান বিচারপতি সতন্ত্র কুমার হুঁশিয়ারি জারি করেছেন, কোনো সংস্থা যদি যমুনায় রাবিশ ফেলে তাহলে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে৷
শিল্প কারখানাগুলির ওপর অশোধিত বর্জ্য পদার্থ ফেলার ওপর আরোপ করা হয়েছে কড়া নিষেধাজ্ঞা৷ গ্রিন ট্রাইব্যুনালের মতে, যমুনার জলকে দূষণমুক্ত করতে পারলে সরকার চিকিত্সা বা ওষুধপত্রের জন্য যে কোটি কোটি টাকা খরচ কোরে থাকে, সেটা অনেক কমে যাবে. নদী বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সেদিন বেশি দূরে নেই, যেদিন যমুনা নদীও সরস্বতী নদীর মতোই অদৃশ্য হয়ে যাবে৷
বন্ধু, আপনি কি কখনও যমুনা নদী দেখেছেন? তাহলে জানান আমাদের৷ পাঠাতে পারেন ছবিও৷
ভারতের পরিবেশবান্ধব ধর্মীয় আচার
মন্দিরের ফুলগুলো পুনঃব্যবহার করার যন্ত্র তৈরি করে মানুষের মধ্যে দূষণ বিষয়ে সচেতনা তৈরিতে এগিয়ে এসেছেন ভারতের পরিবেশবিদরা৷ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যত ফুল ব্যবহার হয় সাধারণত সেগুলো নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়, যার ফল পানি দূষণ৷
ছবি: DW
ধর্ম ও নদীর ভূমি
ভারতের লাখো মন্দিরে প্রতিদিন পূজার সময় অনেক ফুল ব্যবহার হয়, যেগুলো শেষ পর্যন্ত ফেলে দেওয়া হয় নদীতে৷ প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত পূজা দিতে যান এসব মন্দিরে৷ এই ছবিটি দিল্লির লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দিরের৷
ছবি: picture alliance/DINODIA
ফুল দিয়ে ভক্তি প্রদর্শন
ঈশ্বরের প্রতি একাত্মতা এবং ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্য ভক্তরা এই ফুল দেবতার চরণে অর্পণ করেন৷ তবে কেবল হিন্দু মন্দিরগুলোতেই নয়, ভারতের শিখ সম্প্রদায়ের উপাসনালয় গুরুদ্বয়ারাতেও ফুল অর্পণ করেন অনেক ভক্ত৷ এছাড়া ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মাজারেও ফুল দেন৷
ছবি: DW/A. Ashraf
আরাধনা থেকে আর্বজনা
ফুল অর্পণের মধ্য দিয়ে ভক্তরা যখন পূজা সম্পাদন করেন, কেউ অল্প কিছু ফুল বাসায় নিয়ে যান৷ আর কিছু রয়ে যায় মন্দিরেই৷ এগুলো শুকিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলা হয় পার্শ্ববর্তী নদীতে৷ বেশিরভাগ ভক্তই পরিবেশের কথা না ভেবে কাজটি করেন৷
ছবি: DW/A. Ashraf
বাড়ছে আবর্জনা, তার সঙ্গে পরিবেশ দূষণ
কেবল দিল্লি শহরেই মন্দির আছে প্রায় ২৩ হাজার৷ আর প্রতিটি মন্দিরের বাইরেই আছে ফুলের দোকান৷ ওআরএম গ্রিন নামে একটি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, প্রতিদিন এ সব মন্দির থেকে ২০ হাজার কিলোগ্রাম ফুল পাওয়া যায়৷ এদের মধ্যে ৮০ ভাগ যমুনা নদীতে ফেলা হয়৷
ছবি: picture alliance / dpa
দূষণ সমস্যা
ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নদীকে পবিত্র মানলেও পরোক্ষোভাবে সেই নদীরই দূষণ ঘটাচ্ছেন তাঁরা৷ কেবল যমুনা নদীকে দূষণমুক্ত করতে ভারত সরকার গত কয়েক বছরে খরচ করেছে অন্তত ২০ বিলিয়ন ইউরো৷
ছবি: DW/A. Ashraf
নতুন ভাবনা
ওআরএম গ্রিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট অঙ্কিতা কলসি বলেছেন, ধর্মীয় আচার আচারণে কিছুটা পরিবর্তন আসছে৷ এই বেসরকারি সংস্থাটি মন্দিরের ফুলগুলো রিসাইকেল করে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে৷
ছবি: DW/A. Ashraf
ফুল থেকে জ্বালানি
কলসি এবং তাঁর সহকর্মীরা এমন একটি যন্ত্র বানিয়েছেন, যেটার মাধ্যমে ফুলগুলো প্রক্রিয়াজাত করে ধূপকাঠি বা রান্নার জন্য ‘বায়োফুয়েল’ তৈরি করা যায়৷ ব্লেসড ফ্লাওয়ার নামে ঐ যন্ত্রটি তৈরিতে এক বছর এবং ১০ হাজার ইউরো খরচ হয়েছে৷ দিল্লির সাঁইবাবা মন্দিরে এই যন্ত্রটি স্থাপন করা হয়েছে৷
ছবি: DW/A. Ashraf
সচেতনতা বাড়ানো
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দিল্লির অন্তত ৩০টি মন্দিরে এই যন্ত্রটি স্থাপনের কথা ভাবছে ওআরএম গ্রিন৷ যন্ত্রটি আরো উন্নত করার পরিকল্পনা করছে তারা, যাতে গাছের পাতাও প্রক্রিয়াজাত করতে পারে এটি৷ এর ফলে মানুষের মধ্যে পরিবেশ দূষণ বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে বলেও আশা করছে সংস্থাটি৷