প্রয়াণের ৭০ বছরে ভারতজুড়ে চলছে গান্ধি-স্মরণ৷ কলকাতায় মহাত্মার স্মৃতি তর্পণ করছেন এক প্রবীণ৷ তাঁর বাবা যশোরের হেমন্ত সেনগুপ্ত ছিলেন গান্ধিজির দেহরক্ষী৷ ১০০ নং বালিগঞ্জ বাড়িতে বসে সেই স্মৃতিই ভাগ করে নিলেন চণ্ডী সেনগুপ্ত৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: ১৯৪৭ সালে গান্ধিজি কলকাতায় এসেছিলেন৷ বেলেঘাটা অঞ্চলে আজকের গান্ধি ভবনেই কি আপনি গান্ধিজিকে দেখেছিলেন?
চণ্ডী সেনগুপ্ত: তখন গান্ধি ভবনের নাম ছিল হায়দারি মঞ্জিল৷ ঠিকানা ১৫০ বি বেলেঘাটা মেন রোড৷ আজকের মতো এমন সুন্দর সাজানোও ছিল না৷ মালকিন ছিলেন বৃদ্ধা বেগম আম্মা৷ বাড়িটার তখন জরাজীর্ণ অবস্থা৷ পিছনে একটা পুকুর৷ তখন তার নাম হলো গান্ধি ক্যাম্প৷
আসলে বেলেঘাটায় তখন টানটান উত্তেজনা৷ গান্ধিজিকে ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছিল ক্যালকাটা পুলিশ৷ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমার বাবা হেমন্ত সেনগুপ্তকে৷ বাবা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বলে সর্বক্ষণ বাপুর পাশে পাশে থাকতেন৷ স্বাধীন ভারতে তিনিই গান্ধিজির সর্বপ্রথম বাঙালি দেহরক্ষী৷ সেই সুবাদে আমার গান্ধি ক্যাম্পে যাতায়াত ছিল৷
কতদিন নিরাপত্তার ভার ছিল তাঁর হাতে?
১৩ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর — এই ২৫ দিন কলকাতায় গান্ধিজির নিরাপত্তার ভার ছিল বাবার হাতে৷ হায়দারি মঞ্জিল থেকে প্রার্থনাসভা, প্রাক-স্বাধীন ও স্বাধীনত্তোর ভারতে বাবাই ছিলেন ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত অফিসার এবং বাপুর ছায়াসঙ্গী৷
তখনকার কথা কতটা মনে পড়ে?
অনেকটাই পড়ে৷ বাবার জিপ থাকত গান্ধিজির গাড়ির সামনে৷ সবার আগে চলত সেই ক্যালকাটা পুলিশের জিপ৷ নম্বর ছিল সিপি ৩৭৷ হুডখোলা জিপে বাবা দাঁড়িয়ে থাকতেন৷ বাপুকে দেখতে রাস্তার দু'পাশে জনতার ঢল৷ তারা যাতে গাড়ির সামনে চলে না আসে, তা দেখতেন বাবা৷ সমানে হাত নেড়ে চলতেন হুডখোলা জিপে দাঁড়িয়ে৷ গম্ভীর কণ্ঠ ছিল তাঁর৷ বার বার তিনি হাঁক দিয়ে জনতাকে সরে যেতে বলতেন৷
বাবার সঙ্গে আপনি যেতেন হায়দারি মঞ্জিলে?
কতবার গিয়েছি! গান্ধিজির কাছাকাছি মেঝেয় পাতা চাটাইয়ে বসে থাকতাম৷ একটা ঘরেই যাবতীয় কর্মকাণ্ড৷ সবাইকে জায়গা দেওয়া যেত না৷ জানলায় মাথা গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকত কত মানুষ৷ বাপু খাটো ধুতি পরে বসতেন৷ ঘরের দেওয়াল পিঠ দিয়ে৷ তাঁকে ঘিরে পারিষদরা অর্ধেক চাঁদের মতো বৃত্ত করে বসতেন৷ মানু ও আভা গান্ধি থাকতেন সর্বক্ষণ৷ থাকতেন বাপুর সচিব নির্মল বসু৷ রোজ তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন ডাক্তার মেহতা৷ সামনের সারিতে এসে বসতাম আমি৷
মহাত্মা কখনও আপনার সঙ্গে কথা বলেছিলেন?
না, নিজে কখনও বলেননি৷ বার বার আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতেন৷ আমি প্রার্থনাসভায় গিয়ে ভাঙা ক্যামেরা দিয়ে তাঁর ছবি তুলতাম৷ বাপু কথা না বললেও নির্মল বসু আমার সঙ্গে কথা বলেছেন টুকটাক, কতজন আদর করেছেন৷
কারা আসতেন গান্ধিজির সঙ্গে দেখা করতে?
তখন কি আর দেখে বুঝতাম! পরে জেনেছি সে সব নাম৷ সুরাবর্দি থেকে রাজা গোপালাচারি, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ থেকে কৃপালিনী৷ বাংলার নেতা জ্যোতি বসু, ভূপেন গুপ্ত, প্রফুল্ল ঘোষ — কত নাম সেই তালিকায়৷
বাবার কাছে সাম্প্রদায়িকতার পরিস্থিতি নিয়ে কী শুনেছেন?
এটা পরে শুনেছি৷ গান্ধিজির অহিংসার আবেদন সত্ত্বেও বেলেঘাটায় গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়েছিল৷ হানাহানি শুরু হয়, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাপাতে থাকে দুষ্কৃতীরা৷ আবেদনে কাজ না হওয়ায় বাপু অনশন শুরু করেন৷ দুষ্কৃতীরা অস্ত্র সমর্পণ না করা পর্যন্ত তিনি কিচ্ছুটি মুখে তুলবেন না৷ কলকাতা পুলিশও অস্ত্র উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ নেতৃত্বে ছিলেন আমার বাবা৷ দুষ্কৃতীরা অস্ত্র জমা দিয়ে যায় বাবার কাছে৷ খবরের কাগজে বাবার ছবিও প্রকাশিত হয়েছিল৷ অস্ত্রগুলো রয়েছে আজকের গান্ধি ভবনে৷
বাপুর কথা আর কী শুনেছেন, কী দেখেছেন?
খুবই নিয়মানুবর্তী ছিলেন বাপু৷ শেষ রাতে তিনি বিছানা ছাড়তেন৷ সূর্যের আলো ফোটার আগে প্রার্থনা সেরে নিতেন বাড়ির ভেতরেই৷ তারপর বাইরে বেরিয়ে খানিকটা পায়চারি করে কিছুক্ষণ ঘুমোতেন৷ উঠে ম্যাসাজ-স্নান ও প্রাতঃরাশ৷ এরপর হায়দারি মঞ্জিলের বাঁদিকের ঘরটায় গিয়ে বসতেন৷ ওখানেই হরিজন পত্রিকার কাজ হতো৷
মহাত্মা গান্ধীর জানা-অজানা তথ্য
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম জনক তিনি৷ তাঁর অহিংস সত্যাগ্রহের পথকে সম্মান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন ‘মহাত্মা’ শব্দটি৷ সেই তখন থেকেই আপামর বিশ্বের কাছে গান্ধী পরিচিত হন মহাত্মা গান্ধী নামে৷
ছবি: picture-alliance/akg-images/K. Gandhi
জন্মের দেড়শ বছর
অহিংস আন্দোলনের প্রতীক, শান্তিকামী নেতা মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ভারতের গুজরাট রাজ্যের পরবনদার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জাতিসংঘ মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনটিকে অহিংসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
মহাত্মা
৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮৷ এমনই এক শীতের বিকেল৷ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন দিল্লির বিড়লা হাউসে৷ যাচ্ছিলেন সর্বধর্ম প্রার্থনাসভায়৷ ঠিক তখনই বিড়লা হাউসের বাগানে পরপর গুলি করে মহাত্মাকে হত্যা করেন নাথুরাম গডসে৷
ছবি: picture-alliance/akg-images/K. Gandhi
দক্ষিণ আফ্রিকা সংযোগ
ব্যারিস্টারি পড়তে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন গান্ধী৷ প্রথম শ্রেণির টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাঁকে উঠতে দেওয়া হয়নি ট্রেনে৷ বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন৷ সেখানেই প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন৷ পরবর্তীকালে দক্ষিণ আফ্রিকাতেই চরমপন্থি আন্দোলন করে জেলে যান নেলসন ম্যান্ডেলা৷ জেলে বসে গান্ধীর জীবনী পড়েন তিনি৷ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ম্যান্ডেলা জানিয়েছিলেন, তিনি এখন গান্ধীর আদর্শে দিক্ষিত৷ অহিংসার পথ বেছে নিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মার্কিন গণ আন্দোলন
অ্যামেরিকার গণ আন্দোলনের অন্যতম মানুষ মার্টিন লুথার কিং৷ ডক্টর কিং-ও বলেছিলেন, গান্ধীর আদর্শ তাঁকে ছুঁয়ে গিয়েছে৷ নিজেকে গান্ধীবাদী মনে করতেন তিনি৷ এর বহু পরে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও গান্ধীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা জানিয়েছিলেন৷
ছবি: Getty Images/Central Press
গান্ধী আদর্শ
মতের মিল হয়নি অনেক বিষয়ে, কিন্তু গান্ধীর ভাবনাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন বিশ্বের বহু বিখ্যাত মানুষ৷ অ্যালবার্ট আইনস্টাইন থেকে রবীন্দ্রনাথ, জন লেনন থেকে হো চি মিন, অনেকেই গান্ধীর আদর্শকে নিজেদের পাথেয় করে তুলেছিলেন নিজ নিজ কাজে৷
ছবি: Getty Images/Hulton Archive
গান্ধী এবং কংগ্রেস
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন গান্ধী৷ ঘুরে দেখেছিলেন গোটা দেশ৷ বোঝার চেষ্টা করেছিলেন মানুষের সমস্যা৷ এরপর কংগ্রেসে যোগ দেন৷ তাঁর নির্দেশেই স্বাধীনতার আন্দোলন করেছে জাতীয় কংগ্রেস৷ কিন্তু কোনোদিন কোনো পদ গ্রহণ করেননি গান্ধী৷ নিজের দলের সহিংস আন্দোলনের প্রেক্ষিতেও অনশনে বসেছেন একাধিকবার৷
দেশভাগ
দেশভাগের মূল্যে স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেননি গান্ধী৷ জাতীয় রাজনীতি থেকে অনেকটাই দূরত্ব তৈরি করেছিলেন সেই পর্বে৷ পায়ে হেঁটে তিনি তখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন দাঙ্গা বিধ্বস্ত অঞ্চল৷ দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য নোয়াখালি এবং কলকাতায় অনশনে বসেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হে রাম
গান্ধীর নীতি এবং আদর্শের সঙ্গে বহু সময়েই একমত হতে পারেনি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি৷ তাঁর সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভাবনাকে অনেকেই তীর্যক চোখে দেখেছিলেন৷ যার পরিণাম প্রাণ দিয়ে চোকাতে হয় গান্ধীকে৷ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নেতা নাথুরাম গডসে গুলি করে হত্যা করেন জাতীর জনককে৷
ছবি: picture-alliance/Imagno
8 ছবি1 | 8
পত্রিকার কাজ কীভাবে চলত?
আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে গান্ধিজি নিজের পত্রিকার কাজ সেরে নিতেন৷ তিনি বলে যেতেন, পার্শ্বচররা নোট নিতেন৷ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ত৷ জনতার মধ্যে ছিল একদল অটোগ্রাফ শিকারী৷ হরিজন তহবিলে পাঁচ টাকা দিলে গান্ধিজির সই মিলত৷ সাদা কাগজে মহাত্মা শুধু লিখতেন ‘চিরঞ্জীব', তার নীচে অনুরাগীর নাম৷ আমাকেও অটোগ্রাফ দিয়েছেন বাপু৷ তাঁর জন্য অনেকেই ফল ও মিষ্টি নিয়ে আসতেন৷ রোজই তার ভাগ পেতাম৷
কখনও কোনো সভায় গিয়ে বাপুর কথা শুনেছেন?
হ্যাঁ৷ রোজ গান্ধিজি বিভিন্ন স্থানে প্রার্থনা সভা করতে যেতেন৷ সুরাবর্দি কয়েকদিন নিজেই গাড়ি চালিয়ে তাঁকে প্রার্থনাসভায় নিয়ে গিয়েছেন৷ শহরের ধনী ব্যক্তিরাও গাড়ি নিয়ে আসতেন বাপুর জন্য৷ স্থানীয় কোনো মাঠে বসত সেই সভা৷ প্রার্থনা সভা হয়েছে ময়দানের মনুমেন্টের নীচে৷ কাছেই মহামেডান স্পোর্টিংয়ের মাঠ৷ প্রবল বৃষ্টিতে থকথকে কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে কত মানু্ষ বাপুর কথা শুনেছে৷ যূথিকা রায়, বিজনবালার মত কণ্ঠশিল্পীরাও থাকতেন সভায়৷
এবার ১৫ আগস্টের কথা জানতে চাইব...
কালীঘাটে তখন আমাদের বাসা৷ ১৫ আগস্ট আমি হায়দারি মঞ্জিলে যাইনি৷ নিজের ভাঙা ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম শহরের রাস্তায়৷ যা দেখেছি, তার ছবি তুলেছি৷
আর বাপু?
শুনেছিলাম ওই দিন ভোর দুটোয় ঘুম থেকে উঠেছিলেন তিনি৷ মুসলিম সম্প্রদায়ের কয়েকজন প্রতিনিধি তখনই চলে এসেছেন হায়দারি মঞ্জিলে৷ তাঁদের একটাই ইচ্ছে, জাতির জনককে দর্শন করে রোজা ভাঙবেন৷ সেখানে হিন্দুরাও ছিলেন৷ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, পরবর্তীকালে যিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি বাপুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন৷ সুরাবর্দির অনুরোধে গাড়ি চড়ে শহর ঘোরেন তিনি৷ বাপু দেখলেন, হিন্দু-মুসলিম হাত ধরাধরি করে ঘুরছে৷ হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই স্লোগান উঠেছে৷ শহরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তিনি যখন যান, মহাত্মার নামে জয়ধ্বনি উঠেছিল৷
আজকে মৌলবাদীরা যখন উপমহাদেশে খুব সক্রিয়, সেই সময় গান্ধিজির বাণী কতটা কাজে আসতে পারে?
বাপু তাঁর কাজেই পথ দেখিয়েছেন৷ ১৩ আগস্টের ঘটনা বলি৷ সেদিন গান্ধিজি বেলেঘাটায় আসতেই কয়েকজন হিন্দু যুবক তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখায়৷ তাদের বক্তব্য, ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়েছিল৷ সে সময় তাদের রক্ষা করার কেউ ছিল না৷ এখন কেন আপনি মুসলিমদের বাঁচাতে এসেছেন? তাদের শান্ত করে বাপু বলেন, আগেকার ঘটনার কথা তুলে এখন প্রতিশোধ নেওয়া উচিত নয়৷ যারা হত্যা করছে, আগুন লাগাচ্ছে, লুঠ করছে, তারা নিজেদের ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে৷ নোয়াখালির মুসলিম নেতাদের আমি বলেছি, যদি ওখানে আবার দাঙ্গা শুরু হয়, তা হলে আমাকে আগে হত্যা করতে হবে৷ গত বছরের কথা তুলে কেন এই সময়কে আপনারা বিষাক্ত করছেন? আপনারা যতই প্রতিবাদ করুন, আমি এই এলাকা ছাড়ব না৷ আমার নাম, আমার কাজ, সবটাই প্রমাণ করে আমি হিন্দু৷ এ সব শুনে যুবকরা শান্ত হয়, গান্ধিজির পাশে দাঁড়ায়৷
সাত দশক আগে গান্ধিজিকে হত্যা করা হয়েছিল....১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারির কথা কিছু মনে পড়ে?
পড়ে বৈকি৷ হাজরার কালিকা হলে পুলিশের একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ সময় পার হয়ে গেলেও পর্দা উঠছিল না৷ একজন এসে গান্ধিজির হত্যার খবর ঘোষণা করলেন৷ বাবা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন কাছের ভবানীপুর থানায়৷ মহাত্মার হত্যার খবরে শহরে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় ফোন ঘুরিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ মোতায়েনের কথা বলছিলেন৷ ব্যক্তিগত আবেগ ঝেড়ে ফেলে তিনি ছুটেছিলেন দায়িত্ব সামলাতে৷
কলকাতার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি৷ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের আঁতুড়ঘর ছিল বাংলা৷ এই শহরেই স্বাধীনতার মুহূর্তে অনশনে বসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সাত দশক পেরিয়ে নজর ইতিহাসের আলো-আঁধারিতে৷
ছবি: DW/Payel Samanta
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়
১৯০২ সালে ব্রিটিশ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে অনুশীলন সমিতি৷ পি মিত্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল সকলেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ এখানে শরীরচর্চা, অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ হতো৷ প্রকাশিত হত সাপ্তাহিক ‘যুগান্তর’৷
ছবি: DW/Payel Samanta
৩২ নং মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়ি
সশস্ত্র বিপ্লবীদের এই মূল আখড়াতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে বোমা তৈরির মালমশলা উদ্ধার করে৷ গ্রেপ্তার করা হয় অরবিন্দ ও বারীন ঘোষ সহ একাধিক বিপ্লবীকে৷ শুরু হয় ঐতিহাসিক আলিপুর বোমার মামলা৷ আজ সেই বাগানবাড়ি নেই, তবে বোমার মাঠ টিকে আছে৷ প্রোমোটারের হাত থেকে এই মাঠ রক্ষায় চলছে আন্দোলন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
আদালতে
আলিপুর বোমার মামলা ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়৷ এই মামলায় ৩৭ জনের বেশি সন্দেহভাজনের বিচার হয়েছিল আলিপুর জাজেস কোর্টে৷ মৃত্যুদণ্ড, দ্বীপান্তর এবং যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেওয়া হয় বিপ্লবীদের৷
এই কাঠগড়াতেই অপরাধীর ভূমিকায় ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ৷ এজলাসে সাক্ষীর কাঠগড়া, সেকেলে সিলিং ফ্যান, বিচারকের চেয়ার, টাইপরাইটার আজও রয়েছে৷ এই কক্ষেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অরবিন্দের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন৷ বিচারে অরবিন্দ মুক্তি পান৷
ছবি: DW/Payel Samanta
আলিপুর জেলে ফাঁসির মঞ্চ
এই জেলে বন্দি রাখা হত বিপ্লবীদের৷ আলিপুর বোমা মামলায় বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে এখানেই হত্যা করেন কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বসু৷ ১৯০৮ সালে এখানেই তাঁদের ফাঁসি হয়৷ এই জেলে অরবিন্দ ঘোষের ভাগবৎ দর্শন ঘটে৷ নেতাজি থেকে বিধানচন্দ্র রায় এই কারাগারে বন্দি ছিলেন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
শক্তির আরাধনায় বিপ্লবীরা
শক্তিরূপে দেবীর আরাধনার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী যুবশক্তিকে সংগঠিত করার প্রয়াসে একসময় দুর্গাপুজোর সূত্রপাত হয়েছিল কলকাতায়৷ ১৯২৬ সালে বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসুর হাত ধরে শুরু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতির দুর্গোৎসব৷ এখানেও ছিল বিপ্লবীদের শরীরচর্চার আখড়া৷
ছবি: DW/Payel Samanta
প্রাণ হলো বলিদান...
১৯৩০ সালের রাইটার্স বিল্ডিং বা মহাকরণে বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্তের অভিযানে মারা পড়েন কুখ্যাত পুলিশকর্তা সিম্পসন৷ তারপর এই ভবনের অলিন্দেই ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে তাঁদের গুলির লড়াই হয়৷ তিন বিপ্লবীর স্মরণে এই এলাকার নাম বিবাদী বাগ৷
ছবি: DW/Payel Samanta
পুলিশের জাদুঘর
সুকিয়া স্ট্রিটের কাছে এই ভবন ছিল রাজা রামমোহন রায়ের৷ সেখানেই তৈরি হয়েছে কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম৷ কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য ব্যবহৃত বোমা, আলিপুর বোমা মামলার নথি থেকে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস বা দীনেশ মজুমদারের পিস্তল রয়েছে এই সংগ্রহশালায়৷
ছবি: DW/Payel Samanta
বেলেঘাটায় গান্ধী
কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থামাতে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ বেলেঘাটার হায়দারি মঞ্জিলে ছিলেন ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর৷ এখানেই গড়ে উঠেছে গান্ধী ভবন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
স্বাধীনতার মুহূর্তে
দাঙ্গা থামাতে হায়দারি মঞ্জিলে গান্ধীজি অনশন করেন৷ তাতে থেমেছিল রক্তপাত৷ ৪ সেপ্টেম্বর দাঙ্গাবাজেরা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয় বাপুর কাছে৷ দুই সম্প্রদায়ের তরফে দেওয়া হয়েছিল শান্তির লিখিত প্রতিশ্রুতিও৷
ছবি: DW/Payel Samanta
স্বাধীনতা এলো
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বদেশিয়ানার প্রতীক ছিল গান্ধীর চরকা৷ সাত দশক আগে বাপুর ব্যবহৃত চরকা গান্ধী ভবন সংগ্রহশালার আকর্ষণ৷
ছবি: DW/Payel Samanta
জীবন যখন বাণী
১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট এই ঘরে বাপু অনশনে বসেছিলেন৷ এখানেই করতেন প্রার্থনা৷ বিশিষ্ট এই ভবনে এসেছেন দিকপাল ব্যক্তিত্বরা৷ তবুও কলকাতার পর্যটন মানচিত্রে ব্রাত্য গান্ধী ভবন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস
উত্তর কলকাতার এই বাড়িটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ অথচ সংরক্ষণের অভাবে স্বাধীনতার এমন বহু স্মারক হারিয়ে যেতে বসেছে৷