ভারতের সাবেক ও প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মারা গেলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
বিজ্ঞাপন
শেষ হয়ে গেল ভারতীয় রাজনীতির একটা অধ্যায়। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন।
২১ দিন ধরে সেনা হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। তিনি বাড়ির বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে দেখা যায়, তাঁর মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন করা হয়। তাঁর করোনাও ধরা পড়ে। ফুসফুস আক্রান্ত হয়। অপারেশনের পরে তাঁকে ভেন্টিলেটারে রাখতে হয়। কিছুদিন পরে তিনি গভীর কোমায় চলে যান। রোববার রাত থেকে তাঁর শরীর আরো খারাপ হয়। সোমবার বিকেলে তিনি মারা যান।
পশ্চিমবঙ্গে বীরভূমের গ্রাম কীর্ণাহার থেকে প্রণববাবুর দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার ইতিহাস ঘটনাবহুল এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তির পরিচায়ক। সাধারণ ঘরের একজন মানুষ যে দেশের সর্বোচ্চ পদে যেতে পারেন, প্রণববাবু তা প্রমাণ করেছিলেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায়: কীর্ণাহার থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন
বীরভূমে কীর্ণাহার গ্রামে জন্ম প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। সেখান থেকে ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হওয়ার কাহিনি চমকপ্রদ।
ছবি: AP
শুরু বাংলা কংগ্রেসে
প্রণববাবুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু কংগ্রসে নয়। অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেস থেকে। ১৯৬৯ সালে বাম সমর্থিত বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে তাঁর রাজ্যসভায় প্রবেশ। কিছুদিনের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়ে যান। বাংলাদেশ যুদ্ধের পর থেকে তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের শুরু।
ছবি: Reuters
মন্ত্রী প্রণব
রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার চার বছরের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হলেন প্রণব। ১৯৭৩ সালে তিনি শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রকের ডেপুটি মিনিস্টার বা উপ মন্ত্রী হন। এরপর ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু পর্যন্ত প্রণববাবু রাজনীতিতে দ্রুত উঠে এসেছেন৷
ছবি: UNI
ইন্দিরা গান্ধীর অর্থমন্ত্রী
জরুরি অবস্থার সময়েও মন্ত্রী ছিলেন প্রণব। পরে '৭৭ সালে জরুরি অবস্থা তোলার পরে অনেক কংগ্রেস নেতা দল ছেড়েছিলেন। কিন্তু দুঃসময়ে ইন্দিরার পাশে ছিলেন প্রণব। আবার ইন্দিরা ক্ষমতায় এলেন ১৯৮০তে। দুই বছর পরে ১৯৮২ সালে প্রণববাবু পেলেন অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব। ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভায় অঘোষিত দুই নম্বর স্থানে চলে এলেন প্রণব।
ছবি: UNI
তুখোড় রাজনৈতিক বুদ্ধি
প্রণববাবু জননেতা ছিলেন না। দীর্ঘদিনের সাংসদ, জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান নেতা হলেও পশ্চিমবঙ্গে আমজনতার মধ্যে প্রণববাবুর যে ভয়ঙ্কর জনপ্রিয়তা ছিল তা নয়। জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সাফল্যের পিছনে ছিল তুখোড় রাজনৈতিক বুদ্ধি, ঠিক পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা, সংবিধান, সংসদীয় রীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান এবং যে কোনো সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার কৌশল ঠিক করার ক্ষমতা।
ছবি: AP
ক্ষমতার বাইরে
দেহরক্ষীদের গুলিতে মারা গেলেন ইন্দিরা গান্ধী। রাজীব গান্ধী তখন পশ্চিমবঙ্গ সফর করছেন। দিল্লি ফেরার সময় বিমানে প্রণবের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এরপর কার প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত? তাঁর জবাব ছিল, অতীতে দুই বারই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর সব চেয়ে প্রবীণ মন্ত্রী হয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে রাজীবেরই হওয়া উচিত। কংগ্রেসে গুঞ্জন উঠল, প্রণববাবু প্রধানমন্ত্রী হতে চান। পরে রাজীবের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হলো না তাঁর।
ছবি: AP
নিজের দল গড়লেন
রাজীব গান্ধীর আমলে কংগ্রেসে অবহেলিত হলেন প্রণববাবু। প্রথমে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ পড়লেন। তারপর তাঁকে ছয় বছরের জন্য দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। নিজের দল গড়লেন প্রণব। রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। পরে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দল খুব খারাপ ফল করল। প্রণব তো জননেতা ছিলেন না। তাঁর জোরের জায়গা ছিল প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধি।
ছবি: AP
আবার কংগ্রেসে
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আবার কংগ্রেসে ফেরা ১৯৮৮ সালে। তখন বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজীব কোণঠাসা। সে সময় আবার প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজীব গান্ধীর সম্পর্ক ভালো হলো। তিনি দলে ফিরলেন। ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনের দায়িত্ব পেলেন এবং দলকে জেতালেন।
ছবি: DW
এ বার বিদেশমন্ত্রী
নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হলেন ১৯৯১ সালে। তিনি প্রণববাবুকে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান করলেন। পরে তিনি মন্ত্রিসভায় নিলেন প্রণববাবুকে। ১৯৯৫ সালে প্রণববাবু বিদেশমন্ত্রী হলেন।
ছবি: UNI
ইউপিএ-র কান্ডারী
ইউপিএ আমলে আবার ক্ষমতার শিখরে প্রণব মুখোপাধ্যায়। মনমোহন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভায় আবার দুই নম্বর ব্যক্তি প্রণব। সরকারে বা দলে সমস্যা হলেই ভরসা প্রণব। একগুচ্ছ মন্ত্রিগোষ্ঠীর প্রধান। বামেদের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী। আন্না হাজারে থেকে রামদেবকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের দায়িত্বে। আর ২০০৪ সালে প্রথমবারের জন্য লোকসভায় জিতে আসতে পারলেন প্রণববাবু।
ছবি: AP
প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি
২০১২ সালে প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হয়ে রাইসিনা হিলসের প্রসাদোপম রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করেলন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন কপি বুক রাষ্ট্রপতি। পাঁচ বছর ধরে রাষ্ট্রপতি থেকেছেন বিতর্কহীন হয়ে। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। মনমোহন বিদায় নিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী এসেছেন। কিন্তু প্রণবের সঙ্গে সকলেরই সম্পর্ক ছিল অসাধারণ। পরে তাঁকে ভারতরত্নে সম্মানিত করেন মোদী।
ছবি: picture alliance/Photoshot/Bi Xiaoyang
আরএসএসের অনুষ্ঠানে
তিনি বরাবর সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শের সমালোচনা করে এসেছেন। কিন্তু সেই প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আরএসএসের অনুষ্ঠানে দেখা যাওয়ায় কংগ্রেসিরা অবাক হয়েছিলেন।
ছবি: picture-alliance/AP Photo
রাজনৈতিক যুগের অবসান
প্রণবের চলে যাওয়ার ফলে ভারতে অবসান হলো একটা রাজনৈতিক যুগের। বীরভূমের কীর্ণাহার থেকে এসে দেশের সর্বোচ্চ পদে বসেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর এই উত্থান ভারতীয় গণতন্ত্রের জয়৷
ছবি: UNI
12 ছবি1 | 12
তাঁর রাজনীতির শুরু অবশ্য কংগ্রেস থেকে নয়। তাঁর বাবা কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা হলেও প্রণববাবুর রাজনৈতিক জীবন শুরু অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেস থেকে। বাংলা কংগ্রেসে থাকার সময়ই বামেদের সমর্থনে তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। ইন্দিরা গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী। পরে অবশ্য বাংলা কংগ্রেস মিশে যায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় তাঁকে রীতিমতো প্রাধান্য দেন ইন্দিরা গান্ধী। পরে তিনিই হয়ে ওঠেন ইন্দিরার অন্যতম বিশ্বস্ত নেতা এবং মন্ত্রিসভায় দুই নম্বর মন্ত্রী। তারপর রাজীব গান্ধীর আমলে তিনি প্রথমে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। দল থেকেই বহিষ্কৃত হন। নতুন দল গড়েন। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে লড়েন।
কিন্তু প্রণববাবু সেই অর্থে জননেতা ছিলেন না। তাঁর জনভিত্তি এমন ছিল না যে তিনি নিজের দলকে জিতিয়ে আনবেন। তাঁর নিজের দল ভোটে শোচনীয় ফল করে। রাজীবের সময়ই আবার তিনি কংগ্রেসে ফেরেন। নরসিমা রাওয়ের আমলে যোজনা কমিশনে ডেপুটি চেয়ারম্যান হন। সেখান থেকে আবার মন্ত্রী। ইউপিএ আমলে আবার দুই নম্বর স্থান ফিরে পান। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন।
প্রণববাবুর বিশেষত্ত্ব ছিল তাঁর রাজনৈতিক কৌশল রচনা করার ক্ষমতা, সংবিধান ও রাজনীতি সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞান, যুক্তি দিয়ে ভাষণ দেয়ার ক্ষমতা এবং অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও রাজনৈতিক বুদ্ধি। যার জোরে তিনি বারবার মন্ত্রিসভায় ও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। তবে ২০০৪ সালে তিনি লোকসভায় জেতেন তাঁর নিজের জেলা বীরভূমের জঙ্গিপুর আসন থেকে।
প্রণববাবু ছিলেন কপিবুক রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি থাকার সময় বারবার বলতেন, সংবিধানের বাইরে এক পাও তিনি ফেলবেন না। তাই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। রাষ্ট্রপতি ভবনকে তিনি সাধারণ লোকের কাছে খুলে দিয়েছিলেন।