প্রয়াত শিল্পপতি রতন টাটা
১০ অক্টোবর ২০২৪রতন টাটা ছিলেন ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্পগোষ্ঠী টাটা সনস-এর চেয়ারম্যান এমিরেটাস। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি এই শিল্পগোষ্ঠী পরিচালনা করেছেন। তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তবে শুধু এটুকু বললে তার পরিচয় সম্পূর্ণ হবে না।
তিনি একদিকে ছিলেন দূরদর্শী শিল্পপতি, যিনি টাটাকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে পরিণত করেছিলেন, সংস্থার লাভের পরিমাণ অনেকটা বাড়িয়ে নিয়ে যেতে পেরেচিলেন, পরিষেবা ক্ষেত্রে টাটাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন আদ্যন্ত মানবিক। একটা সংস্থা কেমন করে মানবিক মুখ নিয়ে চালাতে হয়, তার অন্যতম সেরা উদাহরণ হিসাবে তিনি থেকে যাবেন।
সেই সঙ্গে তিনি অসংখ্য মানুষকে সাহায্য করেছেন। তিনি যদি বুঝতেন, কেউ সৎভাবে পরিশ্রম করে কোনো ভালো কাজ করতে যাচ্ছে, তিনি তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। আর এটাই তাকে অন্য শিল্পপতিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। তিনি যখন টাটা গোষ্ঠীর পরিচালক, তখন তা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভারকে অধিগ্রহণ করে। টাটা স্টিল কোরাসকে নিয়ে নেয়। এভাবেই বিশ্বের শিল্প মানচিত্রে টাটা নিজেদের গুরুত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে নেয়।
রতন টাটার কর্মজীবন
১৯৯১ সালে জাহাঙ্গির রতনজি দাদাভাই(জেআরডি) টাটা চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন, আর সেই পদে অভিষেক হয় রতন টাটার।
তিনি চেয়ারম্যান হিসাবে দুইটি কাজ করেন। প্রথমত, সংস্থার ভিতর প্রশাসনিক সংস্কার এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে টাটাকে ছড়িয়ে দেয়া। তার আমলে ৩২টি সংস্থা তৈরি হয়, নতুন নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে টাটা।
রতন টাটার দূরদর্শিতার ফলে গাড়ি, বিমা, সার, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, হোটেল, সফটওয়ার, কনসালটেন্সির ক্ষেত্রে ভারতে অন্যতম প্রধান সংস্থারয় পরিণত হয় টাটা।
ছোট গাড়ি তৈরি
রতন টাটার স্বপ্ন ছিল সাধারণ মধ্যবিত্তের জন্য চারচাকার গাড়ি। সেখান থেকেই ন্যানো গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা। তিনি বলেছিলেন, একবার তিনি মোটরসাইকেলে একজনকে পুরো পরিবারকে নিয়ে যেতে দেখেন। বাবা, মা ও তাদের দুই সন্তান সেই মোটর সাইকেলে সওয়ার ছিলেন। তারপরই তিনি এমন গাড়ি করতে চান, যা কেনার ক্ষমতা মধ্যবিত্তের থাকবে। তাদের এইভাবে দ্বিচক্রযানে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে পুরো পরিবারকে নিয়ে কোথাও যেতে হবে না। সেই চিন্তা থেকেই এক লাখ টাকার ন্যানো গাড়ি তৈরির উদ্যোগ।
সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা তৈরি করার জন্য জমি দেয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে টাটা মোটরসের সমঝোতা হয়। তারপর সেই জমি অধিগ্রহণ, বিক্ষোভ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্যদের আন্দোলন, শেষপর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ থেকে ন্যানো কারাখানা বন্ধ করে টাটার চলে যাওয়া, এই পুরোটাই হয়েছে রতন টাটার সময়েই। তবে তারপরেও ন্যানো গাড়ি রাস্তায় নামিয়েছেন তিনি, তবে তা সফল হয়নি।
নীতি মেনে
২০১২ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন। কারণ, টাটার নীতি হলো চেয়ারম্যান ৭৫ বছর পর্যন্ত পদে থাকেন। এই নীতি তিনিই তৈরি করেছিলেন।
জন্মলগ্ন থেকে টাটা গোষ্ঠী জনহিতকর কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছে। রতন টাটার আমলে সেই কাজের আরো বিস্তার হয়েছে। গ্রামোন্নয়ন, চিকিৎসা, শিক্ষা, জলের সমস্যার সমাধান, মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলার মতো কাজ অক্লান্তবাবে করেছেন রতন টাটা। তিনি রতন টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমেও জনসেবার কাজ করে গেছেন।
২০০৮ সালে মুম্বইতে তাজমহল হোটেলে জঙ্গি হামলার পর যেভাবে তিনি কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তার তুলনা পাওয়া বার।
তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে দপ্তরে যেতেন। বিমান চালাতে পারতেন। মানুষকে প্রত্যাশার থেকে বেশি দিতে চাইতেন। তিনি বলেছিলেন, টাটা গোষ্ঠীকে তিনি পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থেকে শিল্পোদ্য়োগী সংস্থায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
এই অকৃতদার, ব্যতিক্রমী মানুষটি ভারতীয় শিল্পমহলে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করে চলে গেলেন।
জিএইচ/এসজি(পিটিআই, এএনআই)