৯১ বছর বয়স হয়েছিল তার। মস্কোর এক হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে মিখাইল গর্বাচভের।
বিজ্ঞাপন
সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের জীবনাবসান। ৯১ বছর বয়সে মস্কোর সেন্ট্রাল ক্লিনিক্যাল হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে তার। বয়সজনিত অসুখে বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন তিনি। কিডনির সমস্যাও ছিল। মঙ্গলবার মৃত্যু হয় তার। তবে তার মৃত্যু সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
গর্বাচভের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন এবং জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস। ক্রেমলিনের মুখপাত্র জানিয়েছেন, পুটিন গর্বাচভের পরিবারের প্রতি শোকপ্রকাশ করেছেন। বুধবার তিনি একটি টেলিগ্রামও করতে পারেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে পুটিন ছিলেন কেজিবি এজেন্ট। তার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট গর্বাচভের সম্পর্ক অবশ্য অস্পষ্ট। পুটিন কখনোই তা প্রকাশ করেননি।
দেওয়ালের ২৮ বছর, ভাঙারও
১৯৬১ থেকে ১৯৮৯, বার্লিনকে দু’টুকরো করে রেখেছিল একটা দেওয়াল৷ ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর দেওয়ালের পতন হয়৷ ২৮ বছর ২ মাস ২৭ দিন পর৷ দেওয়াল ভাঙার পর ৫ ফেব্রুয়ারি অতিক্রম করল ২৮ বছর ২ মাস ২৭তম দিন৷
ছবি: picture-alliance/W.Kumm
দেওয়াল তৈরির দিনগুলি
১৯৬১ সালের ১৩ অগস্ট বার্লিনের প্রাচীর তৈরির কাজ শুরু হয়৷ পৃথিবী তখন দু’ভাগে বিভক্ত৷ একদিকে সোভিয়েত বা কমিউনিস্ট ব্লক অন্যদিকে গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী উদারনৈতিক ব্লক৷ পূর্ব জার্মান গণপ্রজাতন্ত্র সোভিয়েতের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ তাদের নেতৃত্বেই দেওয়াল তৈরির কাজ শুরু হয়৷ এক সপ্তাহের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় দেওয়াল৷ লাগিয়ে দেওয়া হয় কাঁটাতার৷
ছবি: Stiftung Berliner Mauer/M. R. Ernst
পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্ব চরমে
বার্লিন দেওয়াল গোটা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ বিশ্ব মেরুকরণ আরো পোক্ত হয়েছিল৷ ১৯৬২ সাল থেকে দেওয়াল পেরিয়ে এক দিক থেকে আরেক দিকে যাওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ পালানোর চেষ্টা করলে নাগরিকদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতো পূর্ব জার্মানি৷
ছবি: Stiftung Berliner Mauer
প্রথম পালাতে গিয়ে মৃত্যু
দেওয়াল তৈরির প্রায় ১ বছর পর পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিমে প্রথম পালিয়ে আসার চেষ্টা করেন পেটার ফেষ্টার নামে এক ১৮ বছরের তরুণ৷ দেওয়াল টপকানোর চেষ্টা যখন চালাচ্ছেন তিনি পূর্ব জার্মানির সেনারা তাঁকে তাক করে গুলি করে৷ প্রায় ১ ঘণ্টা পূর্ব জার্মানির দিকে দেওয়ালের ধারে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকেন তিনি৷ এরপর তাঁকে উদ্ধার করা হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আমিওএকজন বার্লিনবাসী
১৯৬৩ সালের ২৬ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি পশ্চিম জার্মানি আসেন৷ বার্লিনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, অ্যামেরিকা পশ্চিম জার্মানির পাশে আছে৷ পশ্চিম বার্লিনকে কোনো ভাবেই সোভিয়েতের হাতে যেতে দেওয়া হবে না৷ কেনেডি উচ্চারণ করেছিলেন বিখ্যাত বাক্য, ‘আমিও একজন বার্লিনবাসী’৷
ছবি: picture-alliance/Heinz-Jürgen Goettert
নোম্যান’স ল্যান্ড নাকি মৃত্যু উপত্যকা
পূর্ব জার্মানির দিকে বার্লিন প্রাচীর থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত নোম্যান’স ল্যান্ড তৈরি করা হয়েছিল৷ গোটা অঞ্চল জুড়ে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল কাঁটাতার৷ তৈরি করা হয়েছিল কাঠের ওয়াচটাওয়ার৷ সর্বক্ষণ সেখানে টহল দিত সেনাবাহিনীর গাড়ি৷
ছবি: Stiftung Berliner Mauer/W. Rupprecht
ক্রমবর্ধমান আতঙ্ক
১৯৭৩ সালে আতঙ্ক আরো বৃদ্ধি পায়৷ পূর্ব বার্লিনের দিকে দেওয়াল ছিল মৃত্যু উপত্যকা৷ পশ্চিম বার্লিনের দিকে দেওয়াল জুড়ে তৈরি হয়েছিল আবর্জনা ফেলার জায়গা৷ কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছিল গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা৷ কোথাও আবার শিল্পীরা দেওয়াল জুড়ে এঁকে দিতেন পুনরএকত্রীকরণের ভাবনা৷ পূর্ব বার্লিনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ এবং স্লোগান লিখে দিতেন কেউ কেউ৷
ছবি: Stiftung Berliner Mauer/W. Schubert
দেওয়ালের সংস্কার
১৯৭৫ সালে দেওয়ালের সংস্কারের কাজ শুরু করে পূর্ব জার্মানি৷ দেওয়ালের উচ্চতা বাড়িয়ে করা হয় ১১ দশমিক ৮ ফুট৷ যে সমস্ত জায়গায় ফাটল ছিল, সেসব জায়গা নতুন করে ভরাট করা হয়৷ ক্রেনের সাহায্যে দেওয়ালের উপরেও লাগানো হয় কাঁটাতার৷ পশ্চিম বার্লিন থেকে সে দৃশ্য দেখছিলেন মার্কিন সেনার একটি দল৷
ছবি: Stiftung Berliner Mauer/E. Kasperski
দেওয়ালের গায়ে সাদা রং
ছবিতে যে সাদা রঙের দেওয়াল দেখা যাচ্ছে, তা পূর্ব বার্লিনের দিকে৷ পিছনের সেন্ট টমাস চার্চ পশ্চিম প্রান্তে৷ পুরো অঞ্চলটা জুড়েই ছিল কড়া প্রহরা৷ দেওয়াল ডিঙিয়ে চার্চে যাওয়া মোটেই সহজ ছিল না৷ কখনো কখনো ওপারে যাওয়ার জন্য স্লিপ ইস্যু করা হতো৷
ছবি: Stiftung Berliner Mauer/M. Schuhhardt
স্পষ্ট এবং জোড়ালো দাবি
১৯৮৭ সালের জুন মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান পশ্চিম বার্লিনে আসেন৷ ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সভা করেছিলেন তিনি৷ বলেছিলেন, ‘‘গর্বাচেভ, এবার দরজা খুলুন৷ ভেঙে ফেলুন এই দেওয়াল৷’’ ৪০ হাজার দর্শক উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্বাধীনতার পর্ব
অবশেষে ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাস স্বাধীনতার বার্তা বয়ে আনে৷ দেওয়াল ভাঙার পর্ব শুরু হয়৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে আসতে শুরু করেন৷ ১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে মোট ১০১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন দেওয়াল পেরতে গিয়ে৷ কিন্তু দেওয়াল ভাঙার পর্বে কারো মৃত্যু হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/W.Kumm
নতুন বার্লিনের পথে
১৯৯০ সালের জুন মাস থেকে পূর্ব বার্লিনের দিকের সমস্ত সেনা নির্মাণ ভেঙে নতুন করে রাস্তাঘাটতৈরির কাজ শুরু হয়৷ বড় বড় ক্রেন ব্যবহার করে সরিয়ে দেওয়া হয় সমস্ত আবর্জনা৷ নতুন চেহারায়তৈরি হতে শুরু করে বার্লিন৷
ছবি: Stiftung Berliner Mauer/H. P. Guba
বেলুন দেওয়াল
২০১৪ সালে দেওয়ালের খুব সামান্য অবশিষ্ট ছিল৷ যেটুকু আছে এখনো তা দর্শকদের দেখানোর জন্যই৷ কিন্তু ১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত দেওয়ালের এলাকা জানা ছিল সকলের৷ ২০১৪ সালে সেখানে হাজির হন দুই শিল্পী৷ ক্রিস্টোফার এবং মার্ক৷ ৬৮৮০ টি আলো লাগানো বেলুন দিয়ে তাঁরা আলোর দেওয়াল রচনা করেন৷
ছবি: Stiftung Berliner Mauer
12 ছবি1 | 12
জাতিসংঘের প্রধান তার শোকপ্রস্তাবে লিখেছেন, ''বিশ্বে শান্তি ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন গর্বাচভ। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে তিনি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।''
গর্বাচভের আমলেই সোভিয়েতের পতন হয়। যা নিয়ে ইতিহাস যেমন তার গুণগান করেছে আবার একাংশ তার তীব্র নিন্দা করেছে। বস্তুত, তার হাত ধরেই কমিউনিস্ট বিশ্বের মহীরুহ পতন হয়। আবার তার হাত ধরেই ঠান্ডাযুদ্ধের অবসান ঘটে। বার্লিনের দেওয়াল ভাঙার সময় যাতে কমিউনিস্ট বিশ্বে কোনো প্রতিক্রিয়া না ঘটে, তার দায়িত্ব নিয়েছিলেন গর্বাচভ। এখনো ইতিহাস মনে রেখেছে ব্রান্ডেনবুর্গ গেটে রোনাল্ড রেগনের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা, ''মিস্টার গর্বাচভ এই গেট খুলে দিন, ভেঙে ফেলুন পাঁচিল।'' বস্তুত, এর ঠিক দুইবছর পর বার্লিন পাঁচিল ভেঙে ফেলা হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন শোকপ্রকাশ করে লিখেছেন, গর্বাচভ ছিলেন আস্থাভাজন এবং সম্মাননীয় ব্যক্তি। তার জন্যই লৌহ-যবনিকার পতন সম্ভব হয়েছিল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁও বলেছেন, গর্বাচভ ইউরোপের ইতিহাস বদলে দিতে পেরেছিলেন। ইতিহাস সে কারণেই তাকে মনে রাখবে।