বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রয়োজন সমতার সম্পর্ক৷ কারণ এখন যে সম্পর্ক আছে তা স্বাভাবিক নয়৷ ঢাকায় শনিবার এক সেমিনারে এ কথা বলেন ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের ‘স্কুল অফ অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক ড. মুশতাক খান৷
বিজ্ঞাপন
মুশতাক খান তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের চারটি মডেল তুলে ধরেন৷ এর মধ্যে তিনটি মডেলকেই তিনি অসম্ভব এবং অবাস্তব বলে চিহ্নিত করেন৷ তাঁর কথায়, দু'দেশের সম্পর্ককে বাস্তব সম্মত উপায়ে সমতার ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের তেমন কোনো ‘হোমওয়ার্ক' করা নেই৷ তাঁরা জানেন না, ভারত বাংলাদেশকে কতটুকু গুরুত্ব দেয় অথবা কী কারণেই বা গুরুত্ব দেবে৷ সম্পর্ক করতে চাইলেই যে হবে না৷ যার সঙ্গে সম্পর্ক করতে চাই, সে আমাকে কী দৃষ্টিতে দেখে – তা ভালোভাবে বোঝা প্রয়োজন৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশকে নিয়ে নিরাপত্তার কোনো ভয় নেই ভারতের৷ ভয় আছে জনসংখ্যার হিসেবে৷ আরো সুনির্দষ্ট করে বললে, মুসলিম জনসংখ্যার বিষয়টি বলতে হয়৷ ভারত চায়, বাংলাদেশকে কাঁটাতারে বেড়ার মধ্যে বন্দি করে সম্পর্ক স্থাপন করতে৷ এছাড়া, তারা এদেশে তাদের নানা প্রয়োজনের নামে অবাধে বিচরণ করতে চায়৷''
ড. মুশতাক খান বলেন, ‘‘ভারত যদি বাংলাদেশকে ৫০ শতাংশ তিস্তার পানি দেয়, তবুও ট্রানজিট দেয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়৷ এতে বাংলাদেশ ভারতের দাসে পরিণত হবে৷ এটা হবে বাংলাদেশের চরম বোকামি৷''
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে খুব চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে৷ অথচ বাংলাদেশের পণ্য সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না৷ কারণ অশুল্ক বাধার মাধ্যমে পণ্য আটকে দেয়া হয়৷''
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র আয়োজিত এই সেমিনারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক: প্রগতিশীল রাজনীতির চ্যালেঞ্জ'৷ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আহমেদ কামালের সভাপতিত্বে এই সেমিনারে শিক্ষক, গবেষক এবং রাজনৈতিক কর্মীরা উস্থিত ছিলেন৷ তাঁদের প্রশ্নের জবাবও দেন অধ্যাপক ড. মুশতাক খান৷ তিনি নানা প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘অতীত ইতিহাস দেখলে এটা স্পষ্ট যে মুখে প্রগতিশীলতা বা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা হলেও, এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা একটা বড় বিষয়৷ আর তা না হলে দুই বাংলা এক থাকত৷ সেটা করা হয়নি৷ কারণ তাহলে ভোটের রাজনীতিতে দুই বাংলার নিয়ন্ত্রণ থাকত মুসলমানদের হাতে৷''
তাঁর বক্তব্য, ‘‘নারায়ণ মোদীর হিসাবও স্পষ্ট৷ তিনি ভোটের হিসাবে কোনো পরিবর্তন চান না৷ কংগ্রেসও এটা চায় না৷ তবে মোদী সেটা কোনো রাখ ঢাক না করেই প্রকাশ করেছেন৷ তাই তো বাংলাদেশি মুসলিম ‘অনুপ্রবেশকারী' নিয়ে তাঁর আপত্তি, বাংলাদেশি হিন্দুদের নিয়ে নয়৷''
ড. মুশতাক খান বলেন, ‘‘এইসব বিষয়ে সচেতন থেকে আমাদের ভারতের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে৷ প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ এবং কর্মীদের সচেতন থেকে প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে৷ নয়ত পরিস্থিতি এমন হবে যে তখন তা আর সামাল দেয়া যাবে না৷''
সভাপতির বক্তব্যে ড. আহমেদ কামাল বলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ ছাড়া কোনো সম্পর্ক নেই৷ ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিটের নামে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে চাইছে৷ তারা বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যে ভরিয়ে দিচ্ছে এবং বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে সীমান্তে হত্যা করছে৷''
তাই তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রগতিশীলদের এগিয়ে আসতে হবে৷ তা না হলে দেশের মানুষের অধিকার রক্ষা হবে না, বাংলাদেশের জনগণ ভারতের আগ্রাসন সম্পর্কে সচেতন হবে না৷''