মরা মাছ আর পাখিদের পেটে ক্রমেই আরো বেশি করে প্লাস্টিকের জিনিস পাওয়া যাচ্ছে: ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের জিনিস, যা শেষমেষ সাগরে গিয়ে পড়ে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ বিষয়ে কিছু করতে চায় – কিন্তু কিভাবে?
বিজ্ঞাপন
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাব হলো, সদস্যদেশগুলো তাদের প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার ৮০ শতাংশ কমাবে৷ এর পটভূমিতে রয়েছে, সাগরে ভেসে বেড়ানো প্লাস্টিক আবর্জনার সমস্যা, যে বিষয়ে জার্মানির প্রকৃতি সুরক্ষা সমিতি ‘নাবু'-র আবর্জনা বিশেষজ্ঞ বেনিয়ামিন বনগার্ড বলেছেন: ‘‘সমস্যাটা এত বড় যে তার পরিমাপ করাই সম্ভব নয়৷'' সাগরে যে কি পরিমাণ প্লাস্টিক ভাসছে, তা নাকি কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়৷
গবেষকরা এক দশকের বেশি সময় ধরে তীরে ভেসে আসা মরা পাখিদের লাশ কেটে দেখছেন, সাগরে দূষণ কতদূর অবধি এগিয়েছে৷ প্রতিটি মরা পাখির পেটে নাকি গড়ে ৩১টি প্লাস্টিকের টুকরো পাওয়া গিয়েছে৷ সেই হিসেবে প্রতি বর্গকিলোমিটার সাগরের পানিতে ১৮ হাজার প্লাস্টিকের টুকরো ভেসে বেড়ানোর কথা: তার মধ্যে অনেক টুকরো হয়ত মাইক্রোস্কোপে চোখ দিয়ে দেখতে হয়; আবার কিছু টুকরো প্লাস্টিকের ব্যাগের মতো বড়৷
বালির বস্তা থেকে ব্যাগ তৈরি
গত জুন মাসে বন্যার কারণে ড্রেসডেন শহরটি ছিল হুমকির মুখে৷ বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে ড্রেসডেনবাসীরা নদীর কিনারে হাজার হাজার বালির বস্তা জড়ো করেছিল৷ ছাত্র-ছাত্রীরা সেই পুরনো চটের বস্তা থেকেই নতুন ব্যাগ তৈরি করছে৷
ছবি: Stefan Nöbel-Heise
বস্তা আর কাপড়ের টুকরোগুলো পড়েই ছিল
জুন মাসের প্রথমদিকে জার্মানির প্রায় সব এলাকাই বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল৷ ঐতিহাসিক পুরনো শহর ড্রেসডেনকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে হাজার হাজার বালির বস্তা জড়ো করা হয়৷ আর এই কাজে যাঁরা স্বেচ্ছায় সাহায্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরাও ছিল৷ বস্তা টানাটানির সময়ই ছাত্র-ছাত্রীদের মাথায় পুরনো বস্তা কেটে নতুন ব্যাগ তৈরির ভাবনাটা এসেছে৷
ছবি: Stefan Nöbel-Heise
স্বেচ্ছাকর্মীদের উদ্যোগ
ইয়োহানা মাত্র কয়েকদিন যাবত ‘চটের ব্যাগ’ তৈরির উদ্যোগের সাথে জড়িত হয়েছে৷ ড্রেসডেন শহরের ‘নয়স্টাট’ এলাকায় ওদের দোকান৷ সাতজন উদ্যোগীর পছন্দে যার নাম হয়েছে ‘চটের ব্যাগ’৷ বালির বস্তার ভেতের কাপড় ঢুকিয়ে আর বেল্ট লাগিয়ে মোটামুটি আধা ঘণ্টার মধ্যেই ইয়োহানার একটি ব্যাগ সেলাই করে ফেলতে পারে৷
ছবি: Stefan Nöbel-Heise
উদ্যোগী মিশা এবং বেন
চটের ব্যাগ তৈরির মূল উদ্যোক্তা মিশা এবং বেন৷ ‘এলবে’ নদী যখন বন্যায় প্লাবিত তখনই বেন-এর মাথায় এই চিন্তাটা এসেছে৷ বেন বলেন, ‘‘বন্যার কাজে সাহায্য করে দিনের শেষে যখন আমরা বিয়ার হাতে নিয়ে বসেছিলাম আর ভাবছিলাম, কি করে আমরা আরো সাহায্য করতে পারি, তখনই আইডিয়াটা এসেছে এবং তার দুই সপ্তাহ পরেই কাজ শুরু করি৷’’
ছবি: Stefan Nöbel-Heise
সীমিত উপাদান
মিশা গত কয়েকদিন থেকে সেলাই মেশিনে কাজ করতে করতে একেবারে ঘেমে উঠেছেন৷ অথচ ইনি গত এক সপ্তাহ আগেও সেলাই সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না৷ কিন্তু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাচ্ছে৷ ছাত্র-ছাত্রীদের লক্ষ্য খুব বেশি হলে ৮৭৬টি ব্যাগ তৈরি করার৷ আর এরই মধ্যে ১০০টা ব্যাগ বিক্রিও হয়ে গেছে৷
ছবি: Stefan Nöbel-Heise
পড়াশোনায় চেয়ে ব্যাগ তৈরিতেই বেশি মনোযোগ
ব্যাগ বিক্রি করা, বিক্রেতাকে পরামর্শ দেয়া, সেই সাথে দোকানের সবদিকে লক্ষ্য রাখা – একেবারে সহজ কাজ নয়৷ এরপরও বেন কিন্তু তাইই করছেন৷ বিক্রেতাদের ভিড়ে দোকানের দরজা প্রায় সবসময়ই খোলা৷ তাছাড়া ফেসবুকেও নানা প্রশ্ন এসে জমা হচ্ছে৷ গত কয়েকদিন এ সবের কারণে তেমন ঘুমোতেও পারেননি বেন৷ ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করলেও বর্তমানে বেনের সমস্ত চিন্তা-ভাবনায় শুধুই ‘‘চটের ব্যাগ’’৷
ছবি: Stefan Nöbel-Heise
প্রতীকী মূল্য
বারবারার মতো অনেক ব্যাগ ক্রেতা আছেন যাঁরা বন্যার সময় নিজেরা সাহায্য করেছেন এবং সেরকম অনেক মানুষকেই চেনেন৷ একটি ব্যাগের আসল মূল্য ৮,৭৬ ইউরো, তবে অনেকেই তার চেয়ে বেশি দাম দিয়েছেন ব্যাগের জন্য৷ এমনও মানুষ আছেন যাঁরা ২৫০ কিলোমিটার পথ গাড়িতে এসেছেন সীমিত সংখ্যক ব্যাগ থেকে একটি কেনার জন্য৷
ছবি: Stefan Nöbel-Heise
ছেড়া বস্তা
যে বালির বস্তাগুলো ড্রেসডেনবাসীকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করেছে, সেগুলো ময়লা, তৈলাক্ত পানিতে থাকার ফলে ছিড়ে বা নষ্ট হয়ে গেছে৷ তবে যে বস্তাগুলো সরাসরি পানিতে ছিল না, সেগুলোই ভালো করে ধুয়ে, বালি ছাড়িয়ে তারপর ব্যাগ তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বস্তা, কাপড় এবং বেল্ট – সবই দান
ব্যাগ তৈরির জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন সবকিছুই দান হিসেবে পাওয়া গেছে৷ ‘‘দোকানে এসে কেউ টুকরো কাপড় দিয়েছেন আবার কেউ বা সেলাইয়ে সাহায্য করতে চেয়েছেন৷ প্রথম কয়েকটি ব্যাগ কিনেছেন একটি পানশালার মালিক, যিনি বন্যার সময়ও আমাদের সাহায্য করেছেন, বললেন মিশা এবং বেন ৷’’
ছবি: Stefan Nöbel-Heise
সেলাই মেশিন এখন বন্ধ
এই মুহূর্তে বেল্ট না থাকায় সেলাই বন্ধ৷ কোনো একসময় যখন ৮৭৬টি ব্যাগ বিক্রি হবে তখন সংস্কৃতিক ও সামাজিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে অর্থ তোলা হবে তারপর ‘‘চটের ব্যাগ’’ প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে৷
ছবি: Stefan Nöbel-Heise
9 ছবি1 | 9
প্লাস্টিক জলে থাকে ৪৫০ বছর ধরে
অনেক ধরনের প্লাস্টিক নাকি সাড়ে চারশো বছর অবধি অবিকৃত থাকে, বলেন নাবু বিশেষজ্ঞ বনগার্ড৷ বর্তমানে সাগরে প্লাস্টিক দূষণের একটা বড় অংশ আসে রোজকারের ব্যবহারের প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি থেকে৷ মজার কথা: ‘‘(সাগরে পাওয়া) প্লাস্টিকের ব্যাগগুলির ৮০ শতাংশ আসে ডাঙা থেকে, পানি থেকে নয়৷ তার অর্থ, এই প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি জাহাজ থেকে পানিতে ফেলা হয়নি, বরং এগুলো এসেছে ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে, অধিবাসীদের কাছ থেকে, উপকূল থেকে, নদীনালা থেকে, বাতাসে বয়ে৷'' বিশেষ করে যে পাতলা ও হাল্কা প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়, যেগুলি সবার আগে আবর্জনার গাদায় গিয়ে পড়ে, সেগুলিই সবচেয়ে বেশি পথ অতিক্রম করে সাগরের জলে গিয়ে স্থান পায়৷
ইউরোপীয় কমিশন এবার প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার বিশেষভাবে সীমিত করার জন্য সদস্যদেশগুলোর ওপর চাপ দেবে বলে স্থির করেছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিবছর দশহাজার কোটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়! তার মধ্যে ৮০০ কোটির বেশি আবর্জনা হিসেবে মুক্ত প্রকৃতি গিয়ে পড়ে এবং ব্যাপক পরিবেশ সমস্যার সৃষ্টি করে – বিশেষ করে সেই জীবজন্তুদের মধ্যে, যারা এই প্লাস্টিকের টুকরো গিলে ফেলতে পারে৷ এ কথা বলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবেশ কমিশনার ইয়ানেস পোটোচনিক এবং গত সপ্তাহে ইইউ-এর প্যাকেজিং নিয়মাবলীর সংস্কারের একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন৷
ফিনল্যান্ডে মাথাপিছু চার, স্লোভাকিয়ায় সাড়ে চারশো
কিন্তু ইইউ-এর সব দেশে প্লাস্টিক ব্যাগের সমস্যা এক নয়৷ ডেনমার্ক আর ফিনল্যান্ডের বাসিন্দারা বছরে মাথাপিছু গড়ে সাকুল্যে চারটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করে থাকেন৷ সে তুলনায় পোল্যান্ড, পর্তুগাল কিংবা স্লোভাকিয়ার মানুষজন ব্যবহার করেন সাড়ে চারশো'র বেশি প্লাস্টিকের ব্যাগ৷ জার্মানির ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান হল ৭০: অর্থাৎ জার্মানির মানুষ বছরে মাথাপিছু গড়ে ৭০টি প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করে থাকেন৷
প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ করলেই তো হয়, এ কথা যাঁরা ভাবছেন, তাঁদের বিবেচনা করতে হবে, প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করাটা খুব জনপ্রিয় হবে না – প্রথমত সেই সব দেশে, যেখানে প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার বেশি; দ্বিতীয়ত জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের মতো দেশে, যেখানে প্লাস্টিক শিল্প বেশ গুরুত্বপূর্ণ৷ কাজেই আপাতত আয়ারল্যান্ডের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার কথা ভাবা যেতে পারে৷
আয়ারল্যান্ড ধাপে ধাপে প্লাস্টিকের ব্যগের উপর কর বাড়িয়েছে: এখন সেই কর দাঁড়িয়েছে ব্যাগ প্রতি ২২ সেন্ট৷ এর ফলে আয়ারল্যান্ডে প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার ৯০ শতাংশ কমে গেছে৷ আইরিশরা এখন বছরে মাথাপিছু ‘মাত্র' ১৮টি প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করে থাকেন৷ এছাড়া বিশ্বব্যাপী সমৃদ্ধি যত বাড়ছে, ততই ছড়াচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার৷ সেই বিশ্বব্যাপী সমস্যার মোকাবিলা করার ক্ষমতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের একার নেই৷