ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের মতো পর্যটনকেন্দ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে৷ একটি সংগঠনের উদ্যোগে এ বিষয়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে৷ সরকারের পাশাপাশি শিল্পজগতও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
আবর্জনার সমস্যা আজ অনেক দেশের জন্যই হুমকি৷ ইন্দোনেশিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়৷ বিশেষ করে বালি দ্বীপে এই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে৷ কুটা উপকূলের মতো বালির পর্যটন এলাকা প্রায়ই বিশেষ করে প্লাস্টিক জঞ্জালে ভরে যায়৷ কারণ এখনো অনেক স্থানীয় মানুষ ও পর্যটক ঠিকমতো জঞ্জাল ফেলেন না৷
প্লাস্টিক বর্জ্য যখন হুমকি
প্লাস্টিক বর্জ্য বিশেষ করে সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক৷ একইসঙ্গে ‘ঈশ্বরের দ্বীপ' বলে পরিচিত এই এলাকায় স্বাচ্ছন্দ্যও কমে চলেছে৷ প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে হুমকির বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা বদলানো শুরুতে কতটা কঠিন ছিল, ‘ট্র্যাশ স্টক' নামের আবর্জনা সাফাই সংগঠনের প্রধান হেন্দ্রা আরিমবাওয়া তা স্বীকার করেন৷
তিনি বলেন, ‘‘বেশি আলোচিত বিষয় না হওয়ায় মানুষকে শিক্ষা দেওয়াই ছিল আমাদের সামনে প্রথম বাধা৷ তখন মানুষ ভেবেছিল, ট্র্যাশ স্টক যা বলছে তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ তখন মানুষ আমাদের কথায় গুরুত্ব দেয় নি৷ বিশেষ করে ২০১০ সাল নাগাদ বালি দ্বীপে প্লাস্টিক-বিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে এমন অবস্থা ছিল৷ তাই বাইরের যে সব মানুষ বালির অবস্থা নিয়ে চিন্তিত, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ৷ তাঁরা দল বেঁধে বালির সৈকত পরিষ্কার করেছেন৷ তবে সে সময়ে ঘনঘন সাফাই হতো না৷ যেমন ট্র্যাশ স্টকে আমরা বল প্রয়োগ করে শিক্ষা দেই না৷ আমরা মানুষের উপর জোর খাটাই না৷ বলি না, জঞ্জাল ছড়িও না, এটা করো, ওটা কোরো না৷ ট্র্যাশ স্টকে বরং আমরা একটা আন্দোলন সৃষ্টির চেষ্টা করি, যাতে মানুষ তাঁদের শৈল্পিক যুক্তিবোধ কাজে লাগিয়ে দেখা, শোনা ও অনুভব করতে পারে৷''
পুরোনো প্লাস্টিক যেভাবে নতুন হয়
ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক সামগ্রী সংগ্রহ করে ঢাকার একটি কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়৷ কয়েক ধাপে শেষ হয় এই কাজ, এরপর তা বিদেশে রপ্তানি করা হয়৷ ছবিতে দেখে নিন পুরো প্রক্রিয়া৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mahmud Ove
বাছাই
ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়ি বাঁধ এলাকার কারখানায় প্লাস্টিকের পুরোনো বোতল বাছাই করছেন শ্রমিকরা৷ এরপর সেগুলোকে টুকরো টুকরো করা হবে৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mahmud Ove
কাটার জন্য তৈরি
বাছাই করা প্লাস্টিকের বোতলগুলো টুকরো করার জন্য নেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mahmud Ove
কাটাকাটি
মেশিনের সাহায্যে টুকরো করা হচ্ছে প্লাস্টিকের বোতল৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mahmud Ove
ধোয়া
প্লাস্টিকের টুকরোগুলো মেশিনের সাহায্যে প্রথমবার ধোয়া হচ্ছে৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mahmud Ove
দ্বিতীয় দফা ধোয়া
দুই ধাপে পানিতে ধুয়ে নিতে হয় প্লাস্টিকের টুকরোগুলো৷
শুকনা প্লাস্টিকের টুকরো বস্তায় ভরছেন শ্রমিকরা, যা বিদেশে রপ্তানি করা হবে৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mahmud Ove
আছে নারী শ্রমিক
মোহাম্মদপুরের প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত কারখানায় পুরুষদের সঙ্গে নারীরাও কাজ করেন৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mahmud Ove
8 ছবি1 | 8
সমাজের বিভিন্ন স্তরের জন্য ওয়ার্কশপ, গানের শো, আলোচনার মতো নানা শৈল্পিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ট্র্যাশ স্টক দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পর্কে সমাজে মানসিকতা বদলাতে চায়৷
প্রশাসনের হস্তক্ষেপ
একাধিক প্লাস্টিক-বিরোধী অভিযান চালিয়ে কিছু ফল পাওয়া যাচ্ছে৷ বালির স্থানীয় সরকার অবশেষে ২০১৮ সালে এক অধ্যাদেশ জারি করে প্লাস্টিকের ব্যবহারের উপর নানা বিধিনিষেধ চাপিয়েছে৷
সাধারণ মানুষ প্লাস্টিক ব্যাগ, স্টাইরোফোম ও প্লাস্টিক স্ট্রয়ের ব্যবহার সীমিত রাখার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে৷ বাজারহাট ও সুপারমার্কেটে আর প্লাস্টিকের ব্যাগ দেখা যাচ্ছে না৷ তার বদলে মানুষ পরিবেশবান্ধব থলে ব্যবহার করছে৷ শুধু ক্রেতা নয়, বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই এই উদ্যোগকে সমর্থন জানাচ্ছে৷
যেমন বিন্টাং সুপারমার্কেটের ম্যানেজার কাসরিয়ান্টো বলেন, ‘‘আমরা সরবরাহকারীদের সুপারমার্কেট, বিশেষ করে বিন্টাং সুপারমার্কেটে পণ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টির প্রতি নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছি৷ পরিবেশবান্ধব উপায়ে পণ্য প্রস্তুত করার কায়দাও শিখিয়েছি৷ আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মোড়ক হিসেবে কলাপাতা ব্যবহার করে৷ বিশেষ করে কিছু অরগ্যানিক বা হাইড্রোপোনিক পণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হচ্ছে৷ কারণ প্লাস্টিকের পাত্রের মধ্যেই সেই পণ্য বেড়ে ওঠে৷ ভবিষ্যতে আমরা পুরোপুরি প্লাস্টিক বর্জনের চেষ্টা করবো৷''
সমাজে পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে গভীর সচেতনতার পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য কমাতে শিল্পজগত ও সরকারের সহায়তার ফলে বালি দ্বীপের সৌন্দর্য্য ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়৷ বালি দ্বীপে মানুষের জীবন ও চারিপাশের পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে৷
মহাসমুদ্রে প্লাস্টিক, দায় কার?
অপচনশীল প্লাস্টিকের কারণে দূষিত হচ্ছে সমুদ্র-মহাসমুদ্র৷ রিসাইক্লিং অবকাঠামো সমৃদ্ধ ধনী দেশগুলো এই দূষণের দায় চাপাতে চায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কাঁধে৷ আসলে দায়ী কে?
ছবি: Getty Images/AFP/La Ode M. Saleh Hanan
সমুদ্র দূষণ
মুখে ধরা প্লাস্টিকের এই মগটি পেটে গেলেই মৃত্যু হতে পারে দীর্ঘজীবী কচ্ছপটির৷ প্লাস্টিক দূষণে এমন মারাত্মক অবস্থা তৈরি হয়েছে সমুদ্রতলে৷ ঝুঁকি বাড়ছে পানির তলদেশের জীবজগতে৷ গবেষণায় জানা গেছে, উৎপাদিত প্লাস্টিকের মাত্র নয় শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে৷ অবশিষ্ট অংশ হয় পোড়ানো হয়েছে, না হয় ফেলা হয়েছে প্রকৃতিতে৷ কোনো-না-কোনোভাবে এসব প্লাস্টিক যাচ্ছে সমুদ্রে৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
প্লাস্টিকের ব্যবহার
গরীব দেশগুলোর চেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেশি৷ কেনিয়া বা ভারতের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ প্লাস্টিক ব্যবহার করে জার্মানি এবং উত্তর অ্যামেরিকা৷ ইউরোপ, উত্তর অ্যামেরিকা, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পুনর্ব্যবহারে রপ্তানি করে থাকে৷ আবর্জনার ভার সইতে না পেরে প্লাস্টিক আমদানি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালেয়শিয়া ও ভিয়েতনাম৷
ছবি: Imago Images/J. Schicke
দায় কার?
বেশকিছু গবেষণায় দেখা যায়, সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের জন্য অন্যায়ভাবে এশিয়ার দেশগুলোর ওপর দায় চাপানো হয়৷ জার্মানির হেল্মহোল্টজ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ বলছে, এশিয়ার আটটি আর আফ্রিকার দুটি মিলিয়ে মোট ১০টি নদী দিয়েই সমুদ্রে প্লাস্টিক আসছে৷ কিন্তু জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যামবেক রিসার্চ গ্রুপ তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, ইউরোপ আর নর্থ অ্যামেরিকা প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করে দিলে দূষণও শেষ হয়ে যাবে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/NOAA Pacific Islands Fisheries Science Center
দুশ্চিন্তার বলিরেখা
চীন যখন প্লাস্টিক আবর্জনা আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিল, তখন ধাক্কা খেলো উন্নত বিশ্ব৷ কারণ, বিপুল পরিমাণ আবর্জনার ক্রেতা ছিল চিন৷ গত কয়েকমাসে মালেয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া আর ফিলিপাইনস প্লাস্টিক আবর্জনাবাহী অনেক কন্টেইনার ফেরত পাঠিয়েছে ইউরোপ আর উত্তর অ্যামেরিকায়৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশকিছু দেশ প্লাস্টিক আমদানি ও ব্যবহার থেকে সরে যাচ্ছে৷ আর তাতেই উন্নত দেশগুলোর কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Asfouri
দোষারোপের খেলা
প্লাস্টিক এমন এক বস্তু যা শত বছর ধরে অক্ষত থাকে৷ ১৯৫০ সাল থেকে হিসেব করলে দেখা যায়, অতীতে প্লাস্টিক ব্যবহার করেছে উন্নত দেশগুলো৷ এর বেশিরভাগের ঠিকানা হয়েছে সমুদ্র৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৌযান থেকে বা অন্য উৎস থেকে কী পরিমাণ প্লাস্টিক সাগরে গেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই৷ এ কারণে একটি অঞ্চল আরেকটি অঞ্চলের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে৷